ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বকাপ–উচ্ছ্বাস কতটা বাড়াবাড়ি

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো বিশ্বকাপ জ্বরে কাঁপছে, বিশ্বকাপ ঝড়ে উড়ছে
ছবি : প্রথম আলো

উনিশ শ নব্বইয়ের ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনাল ম্যাচ। সেদিন আমাদের ক্লাসের একটি পরীক্ষা পড়ে গিয়েছিল। আমরা পরীক্ষা পেছানোর আবেদন জানালাম। বিভাগে সেই দাবি অগ্রাহ্য হলো। উপাচার্য ছিলেন মনিরুজ্জামান মিঞা। আমরা তাঁর কাছে গেলাম। তিনি হেসে হেসে প্রস্তাব দিলেন, ‘বরং চলো এক কাজ করি, পুরো বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিই। সবাই মিলে খেলা উপভোগ করি।’ প্রস্তাবের অর্থ পরিষ্কার। আমরা বিফল মনোরথ হয়ে ফিরলাম। এক বন্ধু ঘটনাটি মনে করিয়ে দিল। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বড় পর্দায় হাজার হাজার ছাত্রের ফুটবল খেলা দেখা পছন্দ করছেন না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও দেখলাম বিষয়টির পক্ষে-বিপক্ষে দুই দল দাঁড়িয়ে গেছে। বিদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বা চাকরিরতদের কেউ কেউ লিখেছেন, কোনো বিশ্ববিদ্যালয়েই এমন ‘উন্মাদনা’ নেই। অনেকে লিখেছেন, যেসব দেশে আছে, সেসব দেশ বিশ্বকাপের প্রতিযোগী। অথচ প্রতিযোগীদের দেশগুলোতে আগ্রহ, উল্লাস, উচ্ছ্বাস মাতামাতি যথেষ্ট থাকলেও বাংলাদেশের কাছাকাছিও নয়, দৃষ্টিকটুও নয়। 

উষ্মা প্রকাশকারীদের যুক্তিকে আবার অত্যন্ত কড়া ও তির্যক ভঙ্গিতে বিদ্রূপের তুড়ি মেরে পাল্টা যুক্তিতে হটিয়ে দিতে চাইছেন উদ্‌যাপনপন্থীরা। এই সময়ে যুক্তির নিরিখে একটি নির্মোহ সমাজভাবনার দরকার। প্রথমেই বলে নেওয়া দরকার, সমালোচনাকারীরা তো বটেই, পত্রপত্রিকা ও টিভি সাংবাদিকদের অনেকেও ‘উন্মাদনা’ শব্দটি ব্যবহার করে চলেছেন। আনন্দ উদ্‌যাপন ‘উন্মাদনা’ হতে যাবে কেন? বেখেয়ালি শব্দের প্রয়োগ পাঠক-শ্রোতাদের ভুল মনোছবি তৈরির দিকে ঠেলে দেয়। 

  ২. 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো বিশ্বকাপ জ্বরে কাঁপছে, বিশ্বকাপ ঝড়ে উড়ছে। পছন্দের দলগুলোর জার্সি, রঙে বানানো পোশাক, পতাকা, ব্যানার, পোস্টার, ফেস্টুন, গান-বাদ্য, রম্য-রগড়, তর্ক-বিতর্ক বাজি ধরাধরি—কোনো কিছুই বাকি নেই। বিশাল বড় পর্দায় খেলা প্রদর্শন চলছে। পর্দায় চোখ আটকে থাকা দর্শক জমায়েতের যেসব ছবি পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়েছে, সেগুলো চোখ কপালে ওঠার মতো, সন্দেহ নেই। 

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যাঁরা বিষয়টিকে চরম বাড়াবাড়ি ভাবছেন, তাঁদের যুক্তি—এক. এভাবে মেতে থাকা মানে জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণা শিকেয় উঠেছে। দুই. সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলনে তো অত বড় জমায়েত দেখা যায় না! ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী কি তাহলে সমাজ পরিবর্তনের কোনো দায়ই বোধ করে না? তিন. বিশ্ববিদ্যালয় কীভাবে অনুমতি দিতে পারল? একবার নজির তৈরি হয়ে গেলে ভবিষ্যতে বিপদ হবে। স্থূল বিনোদনের জন্য আয়োজনের আবেদন পড়লে বিশ্ববিদ্যালয় ‘না’ বলবে কোন মুখে? চার. আয়োজক করপোরেটদের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন। তাদের অনুমতি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় নীতিজ্ঞান শূন্যতা দেখিয়েছে। পাঁচ. ভোটের অধিকারের দাবিতে সারা দেশে বিরোধী দলগুলোর কর্মসূচিতে জনসমাগম বাড়ছে। খেলা দেখানোর ফাঁদে আটকে ফেলে একদল তরুণ-যুবাকে সুকৌশলে দূরে সরিয়ে রাখতেই এসব জমজমাট উদ্যোগ। ছয়. একদিকে দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি। কৃচ্ছ্রসাধন করতে বলা হচ্ছে। এই প্রদর্শনের পেছনের খরচগুলো কি অপব্যয় নয়? 

সরকারদলীয় রাজনীতির একাধিপত্য যে ভীতিকর বিভাজন তৈরি করে রেখেছিল, তার জায়গায় দল পছন্দের বিভাজন একটি প্রীতিকর খুনসুটির পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে। বন্ধুদের ভিন্ন ভিন্ন দলকে সমর্থন, প্রিয় দলের পক্ষে বিতর্ক-যুক্তি, অন্য দল বিষয়ে কৌতুক-রগড় ইত্যাদি দারুণ সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার সুযোগই তৈরি করে দিয়েছে। খেলাকে কেন্দ্র করে কত গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস ভাবনা যে কতজনের মনে ঝিলিক দিয়ে চলছে, অনুভব করা দরকার। বিশাল সমাবেশটিকে বরং সম্ভাবনা হিসেবে দেখাই ভালো।

৩. 

আপাত–সরল ও আপাতযৌক্তিক এই আক্ষেপগুলোর বেশির ভাগের ভিত্তিই দুর্বল। আর্থিক অনিয়মের সঙ্গে কারও জড়িত থাকার অভিযোগ থাকলে, আঁকশি চেপে ধরার কথা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের বা দুর্নীতি দমন কমিশনের। বিশ্বময় করপোরেট হাউসগুলো বিজ্ঞাপনের বিকল্প হিসেবেই এ রকম আয়োজন করে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘নজির’ তৈরির ভয় খানিকটা যৌক্তিক মনে হলেও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ‘নজির’-এর উদাহরণ টেনে একই ধরনের দাবিকে খুব সহজেই ‘না’ বলে দিতে পারে। নজির মানা খানিকটা চাপ হতে পারে, বাধ্যবাধকতা নয়। ‘আগে কোথাও দেখা যায়নি’ অথবা ‘অন্য কোনো দেশে বাড়াবাড়ি নেই’ মাত্রাতিরিক্ত সরলীকরণ। আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই বামবা নামের গানের ব্যান্ডগুলোর সমিতির অনুষ্ঠানে দর্শক হতো ১৫-২০ হাজার। দর্শকদের অর্ধেকের বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরের এলাকা থেকে এসে যোগ দিত। এবারের দর্শকদেরও অর্ধাংশ বহিরাগত ধরে নেওয়াই যায়। ‘পড়াশোনা আর গবেষণা করবে কখন’ একটি অপ্রয়োজনীয় ও অতি সুনীতিবাদী অবস্থান। অক্সফোর্ড-হার্ভার্ডেও গবেষণার ছাত্রছাত্রীরা স্নাতকোত্তর পর্যায়ের একটি ক্ষুদ্র অংশমাত্র। ধরে নিতে অসুবিধা কি, গবেষণাকারীদের গবেষণার চাপ থাকলে তাঁরা খেলা দেখতে যাননি? ‘দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি’ বলে বিশ্বকাপ তো বন্ধ থাকেনি। ম্যাচগুলোও অ-অনুষ্ঠিত থাকবে না। 

ক্রীড়াবিদ্যা, খেলাধুলার মনোবিদ্যা এবং খেলাধুলার সমাজতত্ত্ব নামে তিনটি বিশেষায়িত জ্ঞানের ধারা রয়েছে। তিনটিরই মূল ভাষ্য, আদর্শ চিন্তা দিয়ে ক্রীড়ামোদীর আবেগ ব্যাখ্যা অসম্ভব। উষ্মা প্রকাশকারীদের ভাষায়, ‘বাড়াবাড়ি’ বা তথাকথিত ‘উন্মাদনা’ আসলে নিতান্তই স্বাভাবিক মনোদৈহিক চাহিদা। উষ্মা প্রকাশকারীরা চেষ্টা করলেই এ-সংক্রান্ত অসংখ্য গবেষণা পাবেন। আপাতত দেখতে পারেন রিচার্ড প্রিঙ্গল ও সহসম্পাদকদের গবেষণা সংকলন ‘স্পোর্ট অ্যান্ড দ্য সোশ্যাল সিগনিফিকেন্স অব প্লেজার’। গ্ল্যাডিয়েটর যুদ্ধ, চাতালি, উন্মত্ত ষাঁড়ের সঙ্গে যুদ্ধ (স্ট্যাম্পিড), চ্যারিয়ট রেসসহ আরও অসংখ্য প্রাণসংহারী খেলা দেখতে সব নারী-পুরুষ কেন জড়ো হতো? উল্লাস কেন করত? সবাই কি নৃশংস ও বোধ বুদ্ধিহীন, যে কাজকর্ম ফেলে এসব হিংস্রতা দেখতে যোগ দিত? এখনো সুপার বৌল, রাগবি বা ইউরোপীয় ক্লাব লিগগুলোর খেলার মূল শক্তি ‘ফ্যানডম অ্যাড্রেনালিন রাশ’ (ফ্যানদের তুমুল উত্তেজনা)। উন্মুক্ত স্থানে বড় পর্দায় সেসব দেখানোও হয়। মারামারিও হয়। 

আরও পড়ুন

৪. 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর সারা দেশের নজর থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ঘিরে দেশের মানুষের নানা রকম আবেগীয় প্রত্যাশা থাকে। প্রতিষ্ঠানটিকে দেশের ভূত-ভবিষ্যতের ভাব-ভাবনা কান্ডারিদের সমাবেশকেন্দ্র মনে করা হয়। তাই বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম শুনলেই অগ্রজ নাগরিকেরা সাম্প্রতিক যেকোনো ঘটনাকেও তুলনা করার চেষ্টা করেন ভাষা আন্দোলন, ছয় দফা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, উনসত্তর ও নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থান এবং শিক্ষা সংস্কারের আন্দোলনের সঙ্গে। অনেক সময় তাঁরা ভুলে বসেন, সময় বদলেছে। প্রজন্ম বদলেছে। প্রজন্মের ভাবনায়ও পরিবর্তন এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয়টি বিচ্ছিন্ন গ্রাম নয়, বরং বিশ্ব মানের প্রযুক্তির সঙ্গে সংযুক্ত। হাজার হাজার ছাত্রছাত্রীর জীবনও ফুলশয্যা নয়, বরং অনেকেই জীবনসংগ্রামে বিধ্বস্ত। কর্মজীবনে আটকে পড়ার আগে চার বছরে মাত্র একবার পাওয়া আনন্দময় সময়টি দেহ-মনের পরিচর্যাও হয়ে উঠতে পারে। সবচেয়ে সম্ভাবনাময় দিক সংহতি ও সামাজিক বন্ধনের সুযোগ।

সরকারদলীয় রাজনীতির একাধিপত্য যে ভীতিকর বিভাজন তৈরি করে রেখেছিল, তার জায়গায় দল পছন্দের বিভাজন একটি প্রীতিকর খুনসুটির পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে। বন্ধুদের ভিন্ন ভিন্ন দলকে সমর্থন, প্রিয় দলের পক্ষে বিতর্ক-যুক্তি, অন্য দল বিষয়ে কৌতুক-রগড় ইত্যাদি দারুণ সামাজিক মিথস্ক্রিয়ার সুযোগই তৈরি করে দিয়েছে। খেলাকে কেন্দ্র করে কত গান, কবিতা, গল্প, উপন্যাস ভাবনা যে কতজনের মনে ঝিলিক দিয়ে চলছে, অনুভব করা দরকার। বিশাল সমাবেশটিকে বরং সম্ভাবনা হিসেবে দেখাই ভালো। খেলা দেখতে যাঁরা এভাবে জড়ো হতে পারেন, দেশের বৃহত্তর প্রয়োজনেও যে তাঁরা জড়ো হতে পারবেন, ছাত্রছাত্রীর ওপর এই আস্থা রাখাই বেশি দরকারি।

 ● হেলাল মহিউদ্দীন অধ্যাপক, সেন্টার ফর পিস স্টাডিজ, পলিটিক্যাল সায়েন্স অ্যান্ড সোশিওলজি; নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়