বালুবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায় রোববার রাতে (১৬ জুলাই) ঢাকার সদরঘাটের কাছে বুড়িগঙ্গা নদীতে ডুবে যায় ওয়াটার বাস। নারায়ণগঞ্জ থেকে উদ্ধারকারী জাহাজ ‘রুস্তম’ এসে ১২ ঘণ্টা পর ওয়াটার বাসটি টেনে তোলে। ওয়াটার বাসটি ডুবে যাওয়ার পর সাঁতার কেটে অনেকে তীরে উঠতে পারলেও নিখোঁজ হন কয়েকজন। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, এ দুর্ঘটনায় চারজনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, নিখোঁজ রয়েছেন একজন।
এ দুর্ঘটনায় মৃতদেহ শনাক্তকরণ ও সৎকারের পর্ব শেষ হওয়ার আগেই সিরাজগঞ্জে আরেকটি বাল্কহেড দুর্ঘটনার খবর এসেছে। বাল্কহেডটি সিরাজগঞ্জ থেকে টাঙ্গাইলের দিকে বালু নিয়ে যাচ্ছিল। এটি নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর ৬ নম্বর পিলারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে সঙ্গে সঙ্গে ডুবে যায়। এ সময় চালকসহ ছয়জন দ্রুত সাঁতরে পাড়ে উঠে আসেন। ঘটনায় কেউ হতাহত হননি।
বাল্কহেড কী
বাল্কহেড শব্দটি জাহাজনির্মাণের অভিধান থেকে এসেছে। জাহাজের মধ্যে জলরোধক বেষ্টনী/ বিভাজক বা পার্টিশনকে বাল্কহেড বলে। মূলত জাহাজের কাঠামোগত অনমনীয়তা বাড়ানোর জন্যই বাল্কহেড ব্যবস্থার উদ্ভাবন। তবে সেই নামে আমাদের নদীতে যেগুলো চলাচল করে, সেসব স্রেফ বালুসহ বিভিন্ন মালামাল বহনকারী ইঞ্জিনচালিত ট্রলার। নামের সঙ্গে চেহারা বা গড়নের কোনো মিল নেই।
রাতে ঢাকা-বরিশাল নৌপথে মেঘনাসহ অধিকাংশ নদীতে মিটমিট করে জ্বলতে থাকে লালবাতিগুলোই বাল্কহেডের অবস্থান নির্দেশ করে। নদীতে কোনোরকমে মাথা জাগিয়ে চলা এসব যানের রাতের চলাফেরায় একটা বেপরোয়া ভাব ফুটে ওঠে। যদিও যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল নির্বিঘ্ন করতে সন্ধ্যার পর বাল্কহেড চলাচল নিষিদ্ধ করেছে বিআইডব্লিউটিএ। কিন্তু কার কথা কে শোনে?
ঝুঁকিপ্রবণ এলাকা
চলনে-বলনে বেপরোয়া বাল্কহেডের কারণে সাধারণভাবে ঢাকার বুড়িগঙ্গা থেকে মেঘনা নদীর বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জ উপজেলার কালীগঞ্জ পয়েন্ট পর্যন্ত নৌপথ এখন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে। তারপরও লঞ্চের চালক ও মাস্টাররা কিছু এলাকাকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করে থাকেন। ফতুল্লার মোড়ে অধিকাংশ সময় দুই থেকে তিনটি বড় ট্যাংকার নোঙর করে রাখা হয়। ফলে এই স্থানেরও নৌপথ সরু হয়ে ক্রমে একটা অতি ঝুঁকিপূর্ণ প্রণালিতে পরিণত হয়েছে। এখানে বাল্কহেডকে সাইড দিতে গিয়ে হামেশায় দাঁড়িয়ে থাকা ট্যাংকের সঙ্গে বা অতিক্রমরত বাল্কহেডের সঙ্গে লঞ্চের ঠোকাঠুকি হয়। তা ছাড়া মুন্সিগঞ্জ মোড় থেকে মোহনপুর পর্যন্ত দিনে-রাতে বালুবাহী বাল্কহেড চলাচল করায় লঞ্চচালকেরা বেশ সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।
গত বছর এক সরকারি হিসাবে ৪ হাজার ৭০০টি নিবন্ধিত বাল্কহেডের কথা বলা হয়েছিল। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা, সারা দেশের নদীতে প্রায় ১১ হাজারের বেশি বাল্কহেড চালু আছে। এগুলোর কোনোটি ৩ থেকে ৪০ হাজার ঘনফুট ধারণক্ষমতাসম্পন্ন। এসব বাল্কহেডে চাঁদপুরের হরিণাসহ বিভিন্ন বালুমহাল থেকে উত্তোলন করা বালু নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ, কাঞ্চন, বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে আশুলিয়া, টঙ্গী, গাবতলীতে আবাসন কোম্পানি ও গদিঘরে সরবরাহ করা হয়।
ফিটনেস দূরে থাক, এসব অবৈধ বাল্কহেড চলছে দক্ষ মাস্টারের পরিবর্তে অদক্ষ সুকানি দিয়ে। চালকদের প্রায় সবাই করতে করতে শিখেছেন। প্রশিক্ষণ বলে কোনো কিছুর কথা তাঁরা কখনো শোনেননি।
প্রায়ই অবৈধ বাল্কহেড ধরার ‘টম-জেরি’ খেলা চলে। গত জুনে চাঁদপুরের মতলব উত্তরে পদ্মা ও মেঘনা নদীতে অভিযান চালিয়ে অবৈধ ৫০টি বাল্কহেড জব্দ করা হয়েছিল। সেই সময় জব্দ করা নৌযানে থাকা এক শর বেশি ব্যক্তিকে আটক করে নৌ পুলিশ। বলাবাহুল্য, আটক ব্যক্তিদের সবাই খেটে খাওয়া দিনমজুর। এর আগের পাঁচ মাসে আরও ১৫৫টি বাল্কহেড জব্দ করে মামলা দেওয়া হয়েছিল। তবে চাঁদপুরের সেই অভিযান ছিল অবৈধ বালু ব্যবসার বিরুদ্ধে। আদালত শক্ত অবস্থান নেওয়ার পর শুরু হয়েছিল অভিযান।
বাল্কহেড নিয়ন্ত্রণ ছাড়া নদীপথকে বিপদমুক্ত রাখা যাবে না
এই সত্য সবাই জানেন। কোনো কোনো সময় আমলও করেন। গত পবিত্র ঈদুল ফিতরের সময় যাত্রীদের নিরাপত্তা ও দুর্ঘটনা এড়াতে ২০ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত সব ধরনের বাল্কহেড চালানো বন্ধ ঘোষণা করেছিল পুলিশ। সেই মোতাবেক সব নৌ পুলিশ ফাঁড়িতে নির্দেশ পৌঁছে দেওয়া হয়। কথা ছিল, তারা এবার ঘড়ি ধরে জবরদস্ত তদারকি করবেন। সেটা হলে ২৬ এপ্রিল শিশু ওশানার সলিলসমাধি হতো কি? পঞ্চম শ্রেণির ওশানা ২৬ এপ্রিল বানিয়াদী খেয়াঘাট (নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ) পারাপারের সময় পাথরবাহী বাল্কহেডের ধাক্কায় তাদের নৌকাটা ডুবে যায়। এ সময় স্থানীয় মাঝিরা ডুবে যাওয়া নৌকার মাঝিসহ ১০ জন যাত্রীকে উদ্ধার করলেও শিশু ওশানা নিখোঁজ থাকে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিস ও নৌ পুলিশের সদস্যরা উদ্ধারের চেষ্টা করেও সেদিন ওশানার সন্ধান পাননি। তাঁর মৃতদেহ পাওয়া যায় দুই দিন পর রূপগঞ্জ উপজেলার বানিয়াদী স্লুইসগেট থেকে।
প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা
রাতের মেঘনায় চারদিকে অগণিত বাল্কহেডের টিপটিপ করে জ্বলতে থাকা আপাতদর্শনীয় লালবাতিগুলো যে কী ভয়ানক হতে পারে, সেটা আগে কখনো চিন্তায় আসেনি। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২০২২ মুন্সিগঞ্জের কলাগাছিয়ায় মেঘনা-ধলেশ্বরী নদীর মোহনায় ঢাকা থেকে বরিশালগামী লঞ্চ সুরভী-৭-এর সঙ্গে এক বাল্কহেডের সংঘর্ষে হয়েছিল। পাঁচ শ বেশি যাত্রী ছিল সেই লঞ্চে। দেখছি লঞ্চের বাঁ পাশ ধরে পাশাপাশি দুটি বাল্কহেড বেপরোয়া গতিতে ধলেশ্বরী নদীতে প্রবেশ করছে। ডান পাশ থেকে আসা আরেকটি পণ্যবাহী জাহাজ সামনে পড়ে যাওয়ায় একটা বাল্কহেড নিজেকে বাঁচাতে সুরভী-৭ লঞ্চের সামনে দিয়ে হঠাৎ আড়াআড়ি হয়ে অতিক্রম করতে শুরু করে। বাল্কহেডটি আচমকা সামনে পড়ে যাওয়ায় লঞ্চের গতিনিয়ন্ত্রণ করতে পারেননি সারেং। ফলে ধাক্কা লেগে বাল্কহেডটি ডুবে যায়। লঞ্চের সামনের দিকে ফুটো হয়ে যায়। হু হু করে পানি ঢুকতে থাকে। প্রবল ধাক্কা সামলাতে না পেরে অনেকে আহত হন। শেষ পর্যন্ত সারেং অনেক কসরত করে লঞ্চটি নিরাপদে তীরে ভেড়াতে পারলেও নদীর মধ্যে যে ভীতিকর অবস্থা আর আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছিল, তা সহজে ভোলার নয়। সংঘর্ষে বাল্কহেডের এক শ্রমিক পানিতে তলিয়ে যান। লঞ্চের সার্চলাইটে সেই বিভীষিকাময় দৃশ্য অনেকেই সেদিন প্রত্যক্ষ করেছেন আর এখনো শিউরে ওঠেন।
এমভি মানামী এমভি যুবরাজ-৭-এর ভাগ্য সুরভী-৭-এর মতো প্রসন্ন ছিল না। মে ২০২১-এর এক ঝঞ্ঝা-বিক্ষুব্ধ রাতে বাল্কহেডের সঙ্গে তাদের সংঘর্ষে তারা প্রায় ডুবতে বসেছিল।
করণীয় কি এখন
বাল্কহেডের ক্ষেত্রে সূর্যাস্ত আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা। সন্ধ্যার আগেই সব বাল্কহেডকে তাদের চলাফেরা বন্ধ করে দিতে হবে। ডিজিটাল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সদরঘাটের একটা ঘরে বসেই কে কোথায়, তা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব।
এটা ঠিক, আইনের শাসন আলাদা করে এক জায়গায় প্রতিষ্ঠা, লালন ও বিকশিত করা সম্ভব নয়। গত বছর প্রথম আলোর প্রতিনিধির কাছে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক বাল্কহেডের মালিক বলেছিলেন, প্রতি মাসে বিআইডব্লিউটিএ ও নৌ পুলিশকে ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা মাসোয়ারা দিয়ে তঁারা বাল্কহেড পরিচালনা করছেন। নকশা নিয়ে জটিলতা, হয়রানি ও বড় অঙ্কের টাকা উৎকোচ দাবি করায় অনুমোদন বা নিবন্ধন নিতে আগ্রহী হননি।
নিবন্ধন ও নকশা অনুমোদনের কাজটা সহজ করলে মানুষ অযথা হ্যাপার মধ্যে যাবে না। নিবন্ধনহীন বাল্কহেড দুর্ঘটনা ঘটিয়ে পালিয়ে গেলে তাকে খুঁজে পাওয়া কঠিন হয়ে যায়।
নিয়ন্ত্রণকারী কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে তারা মামলা করতে দেরি করে না। কিন্তু মামলার নিষ্পত্তি কি সময়মতো হয়? এদিকেও একটু নজর দেওয়া উচিত।
● গওহার নঈম ওয়ারা লেখক গবেষক