আমার আশা ছিল, ৩৩তম আরব সম্মেলনের নাম দেওয়া হবে গাজা সম্মেলন। বাহরাইনে সম্প্রতি আরব দেশগুলোর এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। ২০১৮ সালে ২৯তম সম্মেলনে সৌদি আরবের বাদশাহ সালমান নাম দিয়েছিলেন ‘জেরুজালেম সম্মেলন’। ফিলিস্তিনিদের জন্য ১৫০ মিলিয়ন ডলার অনুদান ঘোষণা করে সৌদি বাদশাহ বলেছিলেন, ‘কাছের, দূরের সবার জানা প্রয়োজন যে ফিলিস্তিন ও সেখানকার জনগণ আরব ও মুসলিমদের হৃদয়ের গভীরে রয়েছে।’
বাহরাইনে হয়ে যাওয়া সম্মেলনের একটি কাকতালীয় দিক হচ্ছে, ১৯৪৮ সালের নাকবার ৭৬তম প্রতিষ্ঠবার্ষিকীতে এটি অনুষ্ঠিত হয়েছে। প্রথম নাকবার পর থেকে একের পর এক বিপর্যয় আর পরাজয় শেষ পর্যন্ত কি গাজা নাকবা সৃষ্টির পটভূমি তৈরি করেনি?
১৯৪৮ সালে সাড়ে সাত লাখ ফিলিস্তিনিকে তাঁদের ভিটেমাটি থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেটা ছিল একটা গণশুদ্ধি অভিযান। এখন আমরা দেখছি গত বছরের ৭ অক্টোবর শুরু করা জায়নবাদী শুদ্ধি অভিযানে ২০ লাখের বেশি ফিলিস্তিনি ঘরবাড়িহারা হয়েছেন। আর রাফায় হামলা শুরুর পর আট লাখের বেশি মানুষ সেখান থেকে পালিয়ে এসেছেন।
ফিলিস্তিনি সেন্ট্রাল ব্যুরো অব স্ট্যাটিসটিকসের তথ্যমতে, ১৯৪৮ সাল থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত দখল হওয়া ফিলিস্তিনে ১ লাখ ৩৪ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে ইসরায়েল। এ সময়ের মধ্যে তারা তিন হাজারটি গণহত্যা ঘটিয়েছে।
১৯৬৭ সালের নাকসার (পশ্চিম তীর ও গাজা উপত্যকার দখল নেয় ইসরায়েল) পর ১০ লাখের বেশি মানুষকে গ্রেপ্তার করা হয়। ফিলিস্তিনিরা অনেক দশক ধরে বিপর্যয়ের অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে আসছে, গত আট মাসেও তারই ধারাবাহিকতা চলছে।
শেষ আরব সম্মেলনের আরেকটি কাকতালীয় দিক হলো, সম্মেলন যখন চলছিল, তখন ইন্টারন্যাশনাল কোর্ট অব জাস্টিসে (আইসিজে) রাফায় হামলা শুরুর কারণে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকা নতুন পদক্ষেপ নেওয়ার আরজি জানিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকার পক্ষ থেকে করা আবেদনে ইসরায়েলকে দায়ী করে বলা হয়েছে যে দেশটি দায়মুক্তি নিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।
ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে আইসিজেতে মামলা করে দক্ষিণ আফ্রিকা। এরপর এই মামলায় পক্ষভুক্ত হয় মিসর, তুরস্ক, লিবিয়া, নিকারাগুয়া, কলম্বিয়া ও মালদ্বীপ। আয়ারল্যান্ড ও বেলজিয়ামও পক্ষভুক্ত হবে বলে অভিপ্রায় ব্যক্ত করে।
২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ট্রাম্প প্রশাসনের পৃষ্ঠেপোষকতায় সম্পাদিত আব্রাহাম অ্যাকর্ডের অংশ হিসেবে ইসরায়েলের সঙ্গে বাহরাইন সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। শেষ সম্মেলনে আরব দেশগুলোর সামনের সারির কিছু নেতা উপস্থিত ছিলেন না।
অংশগ্রহণকারীরা ঘুরেফিরে বলেছেন, তাঁরা বাস্তবতা অনুযায়ী ফিলিস্তিনিদের সমর্থন করছেন। তাঁরা বলেছেন, শান্তি একটা কৌশলগত ইস্যু। বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু আর তাঁর ডানপন্থী ঠগেরা যখন তাঁদের হাত ফিলিস্তিনিদের রক্তে রাঙা করছেন আর ইসরায়েলি বাহিনী যখন নতুন করে গণহত্যার জন্য রাফাকে ঘিরে ফেলেছে এবং ফিলিস্তিনিদের পালিয়ে যাওয়ার আর কোনো জায়গা নেই, তখন আরব নেতারা এটা বলছেন।
রাফার বাসিন্দাদের যখন হয় বোমায় নয়তো না খেয়ে মরা ছাড়া পথ নেই, সে সময় সীমান্তের অপর পাশে মিসরের ভাইয়েরা বসে বসে দেখছেন আর অন্য আরব দেশগুলো সম্মেলন করতে মানামায় সমবেত হচ্ছে। তাদের কেউই আক্রমণকারীকে বাধা দিতে পারেনি।
সম্মেলন শেষে মানামা ঘোষণায় আরব নেতারা শক্ত ভাষা ব্যবহার করে ইসরায়েলকে নিন্দা জানিয়েছেন। এই ঘোষণায় রয়েছে, গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলিদের বর্বর আগ্রাসন, গাজা যুদ্ধ স্থায়ীভাবে বন্ধের আহ্বান, বন্দীদের মুক্তি, জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুতির সব ধরনের প্রচেষ্টা বন্ধ এবং বাহরাইনের উদ্যোগে সমর্থন।
সম্মেলন থেকে জাতিসংঘের প্রস্তাবের ভিত্তিতে দুই রাষ্ট্রের সমাধানে একটা আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আহ্বান জানানো হয়, যাতে করে অঞ্চলটিতে ন্যায্য ও সমন্বিত শান্তি আনার পাশাপাশি ইসরায়েলের পাশে ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা যায়। আরব নেতারা দুই রাষ্ট্র সমাধান না হওয়া পর্যন্ত ফিলিস্তিন ভূখণ্ডে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী নিয়োগ করার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু এটা কোনো মূল্য বহন করে না।
সম্প্রতি ফিন্যান্সিয়াল টাইমস পত্রিকার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনে আরব দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন যে তারা যেন গাজায় ইসরায়েলের জাতিহত্যামূলক যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর সেখানে শান্তিরক্ষী বাহিনী মোতায়েন করে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের নিরাপত্তা বাহিনী গাজা উপত্যকার দায়িত্ব নেওয়ার উপযুক্ত হওয়ার আগপর্যন্ত শান্তিরক্ষীরা গাজায় দায়িত্ব পালন করবেন।
আরব সম্মেলন থেকে বাইডেনের এ আহ্বান নিয়ে কোনো কথা বলা হয়নি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো গাজায় শান্তি রক্ষায় তাদের সেনা পাঠাতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আরব দেশগুলোকে তাদের সেনা পাঠানোর দাবি জানিয়েছে। নেতানিয়াহু সরকার অবশ্য সেই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন।
প্রশ্ন হচ্ছে, এ ধরনের শান্তিরক্ষী বাহিনী কাদের নিয়ে গঠিত হবে? তারা কি ইসরায়েলের জন্য নিছক সীমান্তরক্ষী বাহিনী হবে?
গাজায় আন্তর্জাতিক কোনো বাহিনীর উপস্থিতি মানবে না বলে জানিয়ে দিয়েছে হামাস। কিন্তু ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ এখনো তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেনি। আবার আরব নেতারাও বলেননি যে তাঁরা আন্তর্জাতিক বাহিনীগুলোর সঙ্গে গাজায় শান্তিরক্ষী হিসেবে অংশ নেবেন কি না।
গাজায় যখন ইসরায়েল গণহত্যামূলক যুদ্ধ চালাচ্ছিল, সে সময়ই ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাস হামাসের সমালোচনা করেছিলেন ৭ অক্টোবরের হামলার জন্য। এটা ছিল দুঃখজনক ঘটনা। এ ধরনের বক্তব্যে ইসরায়েলকে গাজায় গণহত্যা চালানোর পক্ষে ন্যায্যতা দেওয়া হয়। হামাসের এক নেতা মাহমুদ আব্বাসের বক্তব্যের সমালোচনা করে বলেছিলেন, এটা দুর্ভাগ্যজনক।
বড় যে প্রশ্ন সবাইকে উদ্বেগে ফেলেছে, সেটি হলো, গাজার মর্যাদা কী হবে, গাজার ভবিষ্যৎই বা কী হবে? গাজায় ইসরায়েলের গণহত্যামূলক যুদ্ধ শেষ হওয়ার ‘পরদিন’থেকে হামাস ও ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ভূমিকা কী হবে?
এবারের আরব সম্মেলনটি ছিল নতুন বোতলে পুরোনো পানি। আরব দেশগুলো কিংবা ইসরায়েল কেউই মনে করে না যে আঞ্চলিক সমীকরণে ফিলিস্তিন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। সে কারণে তারা ফিলিস্তিনকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে না।
মিডলইস্ট মনিটর থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত
আবদুল্লাহ আল-শিজ, কুয়েত বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ে অধ্যাপক