ইউরোপীয় পার্লামেন্ট নির্বাচনে চরম ডানপন্থী জনতুষ্টিবাদী দলগুলো অসাধারণ সাফল্য পেয়েছে। ফ্রান্স, ইতালি ও ইউরোপের অন্য তিনটি দেশে প্রথম স্থান অধিকার করেছে তারা। এই দলগুলো ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের প্রায় এক–চতুর্থাংশ আসন দখলে নিয়েছে। অর্থাৎ মধ্য ডানপন্থী দলগুলোর পরই তাদের অবস্থান।
ইউক্রেনে চলমান যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রে দ্বিতীয় ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্ট হওয়ার হুমকি, জীবনযাত্রার মানে নেমে আসা স্থবিরতা, জনকল্যাণমূলক পরিষেবা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়া এবং আবহাওয়ার চরম ভাবাপন্ন হয়ে ওঠার ঘটনায় ইতিমধ্যেই জর্জরিত ইউরোপের জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে উঠেছে জাতীয়তাবাদীরা।
এই দলগুলো প্রায়ই রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের প্রতি সহানুভূতিশীল। একই সঙ্গে তারা পরিবেশবান্ধব নীতি, অভিবাসী এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি চরম বিদ্বেষ ভাবাপন্ন।
এই চরম ডানপন্থী দলগুলোর আকস্মিক উত্থানের প্রতিক্রিয়ায় মূলধারার ইউরোপীয় মূল্যবোধপন্থী দলগুলোর সামনে তিনটি বড় বিকল্প রয়েছে। সেগুলো হলো ডানপন্থীদের উত্থানকে পাত্তা না দিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগা, ডানপন্থীদের গ্রহণ করে নেওয়া এবং পাল্টা আক্রমণ করা।
ইউরোপীয় অনেকের ভ্রান্ত ধারণা হলো, ইইউ পার্লামেন্ট নির্বাচন নিতান্ত অমূলক। তাঁদের বিশ্বাস, এই নির্বাচনের আদতে কার্যকারিতা নেই।
সম্ভবত সে কারণে জাতীয় নির্বাচনের তুলনায় এই নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতি অনেক কম থাকেন। যাঁরাওবা ভোট দিতে যান, তাঁদের মধ্যে অনেকে শুধু প্রতিবাদ হিসেবে শাসক দলগুলোর বিরুদ্ধে ভোট দিতে যান।
অবশ্য এর পরও ইইউ–পন্থী দলগুলো পরবর্তী পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছে। ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেনের নেতৃত্বে মধ্য-ডানপন্থী দল ইউরোপিয়ান পিপলস পার্টি (ইপিপি) আসলেই বেশির ভাগ আসনে জিতেছে।
লক্ষণীয় বিষয় হলো, ইউরোপের চরম ডানপন্থী দলগুলো গভীরভাবে বিভক্ত। তাদের কেউ কেউ পার্লামেন্টে প্রতিদ্বন্দ্বী দুটি পক্ষের কোনো একটিকে সমর্থন দিয়েছে, কেউ কেউ অন্য পক্ষকে সমর্থন দিয়েছে। কেউ আবার কোনো পক্ষের সঙ্গে নেই।
ইউক্রেন যুদ্ধ, অর্থনৈতিক নীতি, সমকামীদের অধিকার প্রশ্নে তাদের মধ্যে মতানৈক্য রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ইইউ ব্যবস্থায় কাজ করা উচিত হবে, নাকি এর বিরোধিতা করা দরকার, তা নিয়ে তাদের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। তাদের ভেতরে থাকা এ ধরনের ফাটল তাদের প্রভাবকে সন্দেহাতীতভাবে কমিয়ে দিচ্ছে।
২০১৫ সালে তৎকালীন জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল আশ্রয়প্রার্থী অভিবাসীদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার পর তাঁর সেই নীতিকে ইইউ স্বাগত জানিয়েছিল। চরম ডানপন্থী দলগুলো সে নীতির বিরোধিতা করেছিল। এখন আশ্রয়প্রার্থীদের প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দৃষ্টিভঙ্গি সর্বজনীন বৈরিতায় রূপ নিয়েছে।
কিন্তু জনতুষ্টিবাদীদের এই বিভক্তি নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগাটা খুব বিপজ্জনক হবে। মনে রাখতে হবে, কাছাকাছি মতাদর্শের অনেকগুলো দলের এক ছাতার তলায় অবস্থান নেওয়ার হিসাব ধরে বলা হচ্ছে যে মধ্যপন্থীরা তাদের অবস্থান টিকিয়ে রাখতে পেরেছে।
এই গ্রুপে শুধু ইপিপি এবং সোশ্যালিস্ট অ্যান্ড ডেমোক্র্যাটস (এস অ্যান্ড ডি) আছে তা-ই নয়, এই গ্রুপে রিনিউ ইউরোপ এবং গ্রিনসের মতো ধ্রুপদি ও সামাজিক উদারপন্থী দলও রয়েছে।
এ অবস্থায় ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট হিসেবে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার জন্য পার্লামেন্টে ভন ডার লেনের যথেষ্ট ভোট আছে বটে; কিন্তু গোপন ব্যালটে যেকোনো কিছু ঘটে যেতে পারে। এটি ইইউপন্থীদের শক্তিশালী ও স্থিতিশীল অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
আরও উদ্বেগের বিষয় হলো, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের এসব নির্বাচন ইইউর গুরুত্বপূর্ণ সদস্য রাষ্ট্রগুলোতে রাজনৈতিক পটভূমি বদলে দিচ্ছে।
জার্মানিতে চরমপন্থী দল অলটারনেটিভ ফার ডয়েচল্যান্ড (এএফডি) নব্য-নাৎসিবাদী প্রবণতার দিকে ঝুঁকলেও এবং রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে প্রশ্নবিদ্ধ সম্পর্কে জড়ালেও দলটি চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটস (এসপিডি) থেকে এগিয়ে থেকে দ্বিতীয় স্থান পেয়েছে।
ফ্রান্সে চরম ডানপন্থী দল ন্যাশনাল র্যালি ৩২ শতাংশ ভোট পেয়েছে যা প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর মধ্যপন্থী জোটের পাওয়া ভোটের দ্বিগুণেরও বেশি। এই বিপর্যয়কর পরাজয় মাখোঁকে আগাম নির্বাচন দিতে বাধ্য করেছে।
ইউরোপের সবচেয়ে শক্তিশালী এই দুই নেতার বিপর্যয়কর দুর্বলতা ইতিমধ্যেই অর্থনৈতিক দিক থেকে, নিরাপত্তাগত দিক থেকে এবং জলবায়ুর প্রভাবের দিক থেকে প্রচণ্ড চ্যালেঞ্জের মুখে পড়া ইউরোপকে দিশাহীন অবস্থার দিকে নিয়ে যেতে পারে।
দ্বিতীয় বিকল্পটি হলো অতি ডানপন্থীদের মূল স্রোতে স্থান করে দেওয়া। অনেক মধ্য ডানপন্থী দল চরম ডানপন্থীদের ভাষা ও নীতি গ্রহণ করে নিয়েছে। বিশেষ করে অভিবাসীদের ঠেকানো ও বিতাড়নের বিষয়ে তাঁরা ডানপন্থীদের নীতি সমর্থন করছে। এমনকি মধ্য বামপন্থীরাও এই ইস্যুতে কট্টর ডানপন্থীদের ভাষা ও নীতিকে গ্রহণ করছে। বেশ কয়েকটি সদস্যরাষ্ট্রে চরম ডানপন্থীদের সঙ্গে মধ্য ডান এবং মধ্য বামেরা জোট গড়ে সরকার পর্যন্ত গঠন করেছে।
ইইউ স্তরে বাস্তববাদীরা যুক্তি দিয়ে বলছেন, বাস্তবতা মেনে নিয়ে কিছু চরম ডানপন্থী দলকে রক্ষণশীল মূলধারায় মানিয়ে নেওয়া যেতে পারে।
কিন্তু ঝুঁকির বিষয় হলো, মধ্য ডানপন্থীরা চরম ডানপন্থীদের মূল স্রোতে টেনে নিলে একটা সময় চরম ডানপন্থীরা মধ্য ডানপন্থীদের গিলে ফেলতে পারে।
২০১৫ সালে তৎকালীন জার্মানির চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল আশ্রয়প্রার্থী অভিবাসীদের জন্য সীমান্ত খুলে দেওয়ার পর তাঁর সেই নীতিকে ইইউ স্বাগত জানিয়েছিল। চরম ডানপন্থী দলগুলো সে নীতির বিরোধিতা করেছিল। এখন আশ্রয়প্রার্থীদের প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের দৃষ্টিভঙ্গি সর্বজনীন বৈরিতায় রূপ নিয়েছে। এর ফলে অভিবাসীদের বিষয়ে অতি ডানপন্থী দলগুলোর মতামত এখন স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা সমাজে গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে। গত বছরের ডাচ নির্বাচনে চরম ডানপন্থী গিয়ার্ট ভিল্ডার্সের দল পার্টি ফর ফ্রিডম (পিভিভি)-এর জয় সেটিই প্রমাণ করেছে।
সর্বোপরি অতি ডানপন্থীদের আলিঙ্গন করায় দৃশ্যমানভাবে হিতে বিপরীত কিছু ঘটতে পারে। উদাহরণ হিসেবে হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবানের ফিডেজ পার্টির কথা বলা যেতে পারে।
এই দলটি একবার ইপিপিতে জায়গা করে নেওয়ার পর এখন ওরবান একজন পুতিনপন্থী বিদ্রোহী হয়ে উঠেছেন যিনি ইউরোপের আইনের শাসন এবং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে অবজ্ঞার চোখে দেখেন।
এটি তৃতীয় বিকল্পটিকে সামনে নিয়ে আসে। অর্থাৎ চরম ডানপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াই চালানোর বিষয়টি বেছে নেওয়ার বিষয় হয়ে ওঠে। মাখোঁ একটি আগাম নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে মূলত সেই বিকল্প পথটিকেই বেছে নিয়েছেন।
যে মুহূর্তে মাখোঁ সাংঘাতিক অজনপ্রিয়তার মুখে পড়েছেন এবং ভোটারদের মেজাজ যে মুহূর্তে খুবই প্রতিকূল অবস্থায় রয়েছে, সে মুহূর্তে আগাম নির্বাচন দিতে যাওয়াটাকে খুবই ঝুঁকিপূর্ণ জুয়া হিসেবে দেখা হচ্ছে।
আগামী মাসে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে ফ্রান্স সম্ভবত একজন উগ্র ডানপন্থী প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করতে যাচ্ছে। সেটি হলে মাখোঁকে বাকি তিন বছর ল্যাংড়া ঘোড়া হয়ে গদিতে থাকতে হবে।
অবশ্য এ ছাড়া তাঁর কিছু করারও ছিল না। কেননা যে কোনো ক্ষেত্রেই তাঁর অবস্থান অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে এবং পার্লামেন্টে তাঁর নেতৃত্বাধীন শাসক জোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতাও নেই। অনাস্থা ভোটে ক্ষমতাসীন জোটের হেরে যাওয়ার ঝুঁকি ছিল। ফলে পার্লামেন্ট ভেঙে দিয়ে মাখোঁ অতি ডানপন্থীদের লড়াইয়ের মাধ্যমে পরাজিত করার সম্ভাব্য পথ তৈরি করেছেন।
মনে হচ্ছে, এই তৃতীয় বিকল্পটিকে বেছে নিয়ে মাখোঁর মতো অন্য সদস্যদেশগুলোতেও অতি ডানপন্থীদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নামা দরকার।
ফিলিপ লেগ্রেন ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্টের সাবেক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা যিনি বর্তমানে লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকসের ইউরোপিয়ান ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং সিনিয়র ফেলো।
সত্ত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট, অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ=