চাইলেই কলমের খোঁচায় লিখে দেওয়া যায়, চিনিকলগুলো বেসরকারি খাতে দিয়ে দেওয়া হোক। স্বৈরাচারী সরকারের সময় এ রকমই দেখে এসেছি। ২০২০ সালে দেশের ১৫টি রাষ্ট্রায়ত্ত চিনিকলের মধ্যে ৬টি বন্ধ করে দেওয়া হয়। এরপর থেকে বিভিন্ন ধরনের প্রস্তাব আসছে কখনো দেশীয় কোম্পানি, কখনো বিদেশি কোম্পানি থেকে।
বিদেশিরা এসে চিনিকলগুলো দেখে বিস্ময়ের সঙ্গে ফিরে যান। তাঁরা নাকি মন্তব্য করেন, এত পুরোনো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে যে এখনো চিনি উৎপাদন করা যায়, তা এক অলৌকিক ব্যাপার।
হ্যাঁ, বাংলাদেশে এমন অলৌকিক ব্যাপারই ঘটেছে এত দিন। এ খাতে সময়মতো বিনিয়োগ করা হয়নি। যন্ত্রপাতি আধুনিক করা হয়নি। যদি হতো, তাহলে ১০০ কেজি আখ থেকে ৫ কেজি নয়, ৮–১০ কেজি চিনি উৎপাদন করা যেত। চিনিশিল্পের বিপুল সম্ভাবনা বেশ কটি কারণে। আখ থেকে শুধু চিনিই হয় না।
চিনি তৈরির পর আখের ছোবড়া থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। বিশেষ ধরনের ওষুধও তৈরি হয় জাপানে। মোলাস থেকে অ্যালকোহল, পাওয়ার অ্যালকোহল, বার্নিশের উপাদান, স্যানিটাইজার, ইথানল, বেকারির ইস্ট, ভিনেগার ইত্যাদি তৈরি করা যায়।
এত কিছু ব্যবহারের পরও যেই বর্জ্য থাকে, তার সঙ্গে প্রেসমাড মিশিয়ে তৈরি করা যায় জৈব সার। আখ থেকে চিনি তৈরি করে যে লোকসানের কথা বলা হয়, তা হয় না যদি উপজাতগুলোকে সঠিকভাবে ব্যবহার করা যায়। পৃথিবীর বেশির ভাগ চিনিকল উপজাত ব্যবহার করেই টিকে আছে। কাজেই বাংলাদেশের চিনি খাতকে লোকসানি খাত বললে বলতে হবে কাঠামোগতভাবে একে লোকসানি প্রতিষ্ঠান বানিয়ে রাখা হয়েছে এত দিন কিছু বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থে।
২০০২ সালের আগে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থা চিনিকলগুলোয় চিনি উৎপাদনের পাশাপাশি নিজেরাই চিনি আমদানি ও পরিশোধন করে বিক্রি করত। তখন উৎপাদন কমবেশি হলে দাম নিয়ন্ত্রণে একটি জনমুখী ভূমিকা পালন করতে পারত তারা। ২০০২ সালের পর থেকে চিনি আমদানি করে পরিশোধনের সুযোগ দেওয়া হয় কয়েকটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে। ২০২০ সালে চিনিকলগুলো বন্ধ করে দেওয়ার আগে চিনির দাম ছিল ৬০ টাকা। ২০২৪ সালে এসে চিনির দাম হয়েছে ১৪০-১৬০ টাকা। সরকার কেন দাম নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছে?
একটি চিনিকল পুরোনো যন্ত্রপাতি মেরামত করে চালু করলে প্রায় ৫০ কোটি টাকা লাগবে। অন্তর্বর্তী সরকার বিনিয়োগ করে বন্ধ হয়ে যাওয়া চিনিকলগুলো ধীরে ধীরে চালু করতে পারে এবং বেসরকারি খাতের সম্ভাব্য দখলদারি থেকে মুক্ত করতে পারে। এতে শ্রমিক, কৃষক, ছোট ব্যবসায়ী, বিপণনকারীদের সামনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হবে।
নানান রকম সুবিধা দিয়েও চিনির দাম কমাতে পারেনি সরকার। অথচ ভারত থেকেই বাংলাদেশ ৭০ টাকা দরে চিনি আমদানি করে। এর একটা অংশ আবার চোরাচালান হয়ে আসে। ভারত যদি কম খরচে চিনি বিক্রি করতে পারে, বাংলাদেশ কেন পারবে না? বেসরকারি রিফাইনাররা কী করছে যে চিনির দাম এত বেশি? চিনির দাম বাড়লে তো রাষ্ট্রীয় চিনিকলগুলো এখন লাভে থাকার কথা। সেগুলো কেন বন্ধ? এগুলো খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।
এত দিন চিনিকলের বিপুল পরিমাণ জমির দিকে নজর ছিল বিভিন্ন লুটেরা গোষ্ঠীর। বিভিন্ন গোষ্ঠী সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর করেছে বন্ধ হওয়া চিনিকলের দায়িত্ব নেবে বলে। এমওইউ করে কিছু গোষ্ঠী ঋণ নেওয়ার কাজে ব্যবহার করেছে, কিন্তু চিনিকলের প্রকল্প শুরু করেনি। এগুলোরও অনুসন্ধান হওয়া দরকার। এখন আসি, কেন রাষ্ট্রীয় খাতকেই দেশি আখ ব্যবহার করে চিনি উৎপাদনের কাজ করতে হবে।
প্রথমত, আমাদের আধুনিক খাদ্যাভ্যাসে চিনি একটি অপরিহার্য খাদ্য উপাদান। এটি অন্যতম কৃষিভিত্তিক খাদ্যশিল্প, যা কৌশলগত কারণে সরকারেরই করার কথা। কিছু খাদ্য উপাদান আছে, যা পুরোপুরি আমদানিনির্ভর হয়ে গেলে খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মধ্যে পড়ে, দাম নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, ভোক্তাদের ওপর চাপ বাড়ে। বেশির ভাগ দেশ চিনিকে সেদিক থেকে কৌশলগত খাত হিসেবে বিবেচনা করে। লোকসান করলেও নানা ধরনের সাহায্য–সহযোগিতা ও পৃষ্ঠপোষকতায় চিনিশিল্পকে কৌশলগত কারণেই বাঁচিয়ে রাখা হয়।
দ্বিতীয়ত, চিনিশিল্প এমন একটি শিল্প, যার সঠিক ব্যবস্থাপনা নির্ভর করে অনেক ধরনের গোষ্ঠী ও প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে। কৃষক থেকে শুরু করে পণ্য পরিবহনকারী, অ্যাগ্রিকালচার এক্সটেনশন ওয়ার্কার, ইক্ষু গবেষণা ইনস্টিটিউট, শ্রমিক, বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠান, উপজাত থেকে নানান দ্রব্য উৎপাদনকারী—বহু ধরনের প্রতিষ্ঠান ও অংশীজনের সম্মিলিত প্রয়াসে ব্রিটিশ আমল থেকে চিনিশিল্প গড়ে উঠেছে।
এই বিশাল অবকাঠামো এক দিনে তৈরি হয়নি। আখ উৎপাদন করে কৃষক বহুদূর থেকে পরিবহন করে নিয়ে আসে মিল গেটে। প্রতিটি মিলে শ খানেক লোক কাজ করে শুধু কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে, পুঁজি বিতরণ, তদারকি ও সময়মতো আখ মিলে পৌঁছানোর ব্যাপারটি সমন্বয় করতে।
বহু ধরনের উপজাত থেকে বিভিন্ন দ্রব্য উৎপাদন, বাজারজাতকরণ, বিতরণ যুক্ত রয়েছে আরও অনেক মানুষ। এ ছাড়া চিনিকলগুলো থেকে সরকার বীজ ও সার সরবরাহ ও আখ চাষের জন্য ঋণ দেয়। এভাবে একেকটি শহরের মানুষের জীবন–জীবিকা, সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে আখ চাষ ও চিনিশিল্পকে কেন্দ্র করে। এর জন্য যে পরিমাণ বিনিয়োগ ও সমন্বিত প্রাতিষ্ঠানিক তৎপরতা প্রয়োজন, তা কোনো একক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে আশা করা কঠিন। আর তাই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগেই চিনিশিল্পের বিকাশ সম্ভব।
দ্য পাবলিক করপোরেশনস অর্ডিন্যান্স আইন, ১৯৮৬ অনুযায়ী সরকারনির্ধারিত দামে চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থার চিনি বিক্রির কথা। জনস্বার্থে যদি সরকার উৎপাদন খরচের চেয়ে কম দামে চিনি উৎপাদন করে, তাহলে যে লোকসান হবে, তা সরকারের দেওয়ার কথা। কিন্তু বহু বছর ধরে সরকার ভর্তুকি হিসেবে এই ট্রেডগ্যাপ (বিক্রয়মূল্য ও উৎপাদন খরচের পার্থক্য) পূরণ করতে ভর্তুকি না দিয়ে ঋণ দিয়ে আসছিল।
আর তাতে প্রতিবছর ঋণ শোধ করতে গিয়ে ঋণের পরিমাণ কিছু চিনিকলে দাঁড়িয়েছিল উৎপাদন খরচের ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। অব্যবস্থাপনা, পুরোনো যন্ত্রপাতি, আখ চাষে প্রণোদনার অভাব ইত্যাদির সঙ্গে সঙ্গে বছরের পর বছর ঋণ পরিশোধের খরচ উৎপাদন খরচের সঙ্গে যুক্ত হয়েই চিনিশিল্প লোকসানি খাতে পরিণত হয়েছে।
আইন অনুযায়ী বর্তমানে সরকারের কাছ থেকে চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থার ৮ হাজার ২৯০ কোটি টাকা প্রাপ্য। সরকার এই অর্থ পরিশোধ করলে চিনি ও খাদ্য শিল্প সংস্থা ব্যাংকের ঋণ পরিশোধ করতে পারে। এর পাশাপাশি চিনির উৎপাদন খরচও কমে আসে।
একটি চিনিকল পুরোনো যন্ত্রপাতি মেরামত করে চালু করলে প্রায় ৫০ কোটি টাকা লাগবে। অন্তর্বর্তী সরকার বিনিয়োগ করে বন্ধ হয়ে যাওয়া চিনিকলগুলো ধীরে ধীরে চালু করতে পারে এবং বেসরকারি খাতের সম্ভাব্য দখলদারি থেকে মুক্ত করতে পারে। এতে শ্রমিক, কৃষক, ছোট ব্যবসায়ী, বিপণনকারীদের সামনে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন হবে।
● মোশাহিদা সুলতানা সহযোগী অধ্যাপক, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়