বুধবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছেন। তফসিল অনুযায়ী, ৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ। মনোনয়নপত্র বাছাই আগামী ১-৪ ডিসেম্বর, ১৭ ডিসেম্বর প্রার্থিতা প্রত্যাহারের শেষ তারিখ এবং প্রতীক বরাদ্দ ১৮ ডিসেম্বর।
তিনি এমন সময়ে তফসিল ঘোষণা করলেন, যখন বিরোধী দল সরকারের পদত্যাগের দাবিতে লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি পালন করছে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ উল্লাস করে তফসিলকে স্বাগত জানালেও বিরোধী দল প্রত্যাখ্যান করেছে।
বৃহস্পতিবার ৪৮ ঘণ্টার অবরোধ শেষ হওয়ার পর শুক্র ও শনিবার বাদ দিয়ে রোববার ও সোমবার হরতালের ডাক দিয়েছে বিএনপি। অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ঘোষণা দিয়েছে, নির্বাচনের আগপর্যন্ত তারা মাঠ দখলে রাখবে। তফসিল ঘোষণার দিন বিএনপির তেমন সক্রিয়তা দেখা না গেলেও জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বড় মিছিল করে নিজেদের শক্তির জানান দিয়েছে।
তফসিল ঘোষণার আগে মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লুর চিঠি নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বেশ আলোচনা হয়েছিল এবং সংলাপের বিষয়ে ক্ষীণ আশাবাদ জেগেছিল। জাতীয় পার্টি প্রকাশ্যে এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে। বিএনপিও ইতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছিল বিষয়টি। কিন্তু আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের চিঠি পাওয়ার পর বললেন, তফসিল ঘোষণার পর আর সংলাপের সুযোগ নেই।
সংঘাত ও সহিংসতা পরিহার করার একমাত্র উপায় হলো সংলাপের মাধ্যমে নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সংকটের সমাধান। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর সংলাপ হতে পারে না, এ রকম কোনো বিধান নেই। অতীতে তফসিল ঘোষণার পরও আলোচনা হয়েছে। বিরোধী দলের দাবি মেনে ভোটের তারিখও পরিবর্তন করা হয়েছে।
তফসিল ঘোষণার সময় প্রধান নির্বাচন কমিশনারও কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর মতৈক্য ও সংলাপের ওপর জোর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘পারস্পরিক প্রতিহিংসা, অবিশ্বাস ও অনাস্থা পরিহার করে সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা ও সমাধান অসাধ্য নয়। পরমতসহিষ্ণুতা, পারস্পরিক আস্থা, সহনশীলতা ও সহমর্মিতা টেকসই ও স্থিতিশীল গণতন্ত্রের জন্য আবশ্যকীয় নিয়ামক।’
আওয়ামী লীগের নেতারা এত দিন বলতেন, সংলাপ হতে পারে। তবে সেটি হতে হবে শর্তহীন। ডোনাল্ড লুর চিঠিতে শর্তহীন সংলাপের কথাই বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে ডোনাল্ড লুর চিঠি ও জাতির উদ্দেশে দেওয়া সিইসির ভাষণের মর্মার্থে খুব ফারাক নেই।
দুর্ভাগ্য হলো আমাদের বিভেদাত্মক রাজনীতি সবকিছু দলীয় স্বার্থের আয়নায় দেখতে অভ্যস্ত। যে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দিন নির্বাচন কমিশন কার্যালয়ের আশপাশে বিপুলসংখ্যক পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি সদস্য মোতায়েন করতে হয়, সেই নির্বাচন ক্ষমতাসীনদের ইচ্ছা পূরণ করতে পারলেও জনরায়ের প্রতিফলন ঘটাতে পারবে কি না, সে বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
আমরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কোনো বিদেশি শক্তির হস্তক্ষেপ চাই না। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব বরাবর এমন অবস্থা তৈরি করে, যাতে বিদেশিরা নাক গলানোর সুযোগ পায়। কোনো দেশের ‘হস্তক্ষেপে’ আনন্দে ডুগডুগি বাজানো আর কোনো দেশের হস্তক্ষেপে উষ্মা প্রকাশ রাজনৈতিক দ্বিচারিতা ছাড়া কিছু নয়। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব এতটাই পরিপক্ব ও প্রাজ্ঞ যে ৫২ বছরেও তাঁরা নির্বাচনের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারেননি।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যে চারটি তত্ত্বাবধায়ক বা নির্দলীয় সরকারের অধীনে, তিনটি সেনাশাসনের মধ্যে, চারটি দলীয় সরকারের অধীনে।
১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয় আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে। ওই সময় কিন্তু সংসদ বহাল ছিল না। সংসদ ভেঙে যাওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে আরেক সংসদ নির্বাচনের বিধান ছিল ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হওয়ার আগপর্যন্ত। ওই সংশোধনীতে বলা হলো, সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার আগের ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন হবে। এখানে মাঠ সমতল না থাকার গুরুতর প্রশ্নটি এসে যায়। একজন সংসদ সদস্য পদে থেকে নির্বাচন করবেন, অন্যরা বাইরে থেকে।
২০১৮-এর নির্বাচনে বিএনপিসহ সব দল অংশ নিলেও জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত হয়নি। অনেক জরিপ ও গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, ২০০৮ সালের পর যারা ভোটার হয়েছেন, সেই তরুণ প্রজন্মের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ভোট দিতে পারেননি। এই নির্বাচনের কোনো কোনো কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। আবার বিরোধী দলের অনেক প্রার্থী অনেক কেন্দ্রে শূন্য ভোট পেয়েছেন।
১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো অনিয়ম-কারচুপি না করলেও আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হয়ে পরবর্তী সরকার গঠন করত। কিন্তু ক্ষমতাসীন দলটি এতটাই অধৈর্য ছিল যে বিরোধী দলের অনেক প্রার্থীকে মনোনয়নপত্র দাখিল করতে দেয়নি। ব্যালট বাক্স ঢাকায় এনে খন্দকার মোশতাক আহমদকে জিতিয়ে আনা হয়েছিল জাসদ প্রার্থী ইঞ্জিনিয়ার আবদুর রশীদকে হারিয়ে। সত্তরে প্রাদেশিক পরিষদে জয়ী তরুণ ন্যাপ নেতা সুরঞ্জিত সেনগুপ্তসহ অনেককেই হারানো হয়েছিল জবরদস্তি করে।
১৯৭৫ সালের রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সামরিক শাসনের অধীনে যেসব নির্বাচন হয়েছে, সেগুলো ছিল সেনাশাসকদের ইচ্ছাপূরণ। এসব নির্বাচনে সদ্য গঠিত দলকে দুই-তৃতীয়াংশ আসনে জয়ী হতে হয়েছে সামরিক শাসনকে বৈধতা দেওয়ার জন্য।
আশা করা হয়েছিল, নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে গণতান্ত্রিক শক্তির বিজয়ের পর বাংলাদেশে নির্বাচন নিয়ে আর কোনো প্রশ্ন উঠবে না। প্রতিটি নির্বাচনে জনরায়ের প্রতিফলন ঘটবে। তিন জোটের রূপরেখায় সে রকম আকাঙ্ক্ষাই ব্যক্ত করা হয়েছিল।
কিন্তু বাস্তবতা হলো ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নির্বাচনে জয়ী হওয়ার জন্য নানা অনিয়ম ও কারচুপির আশ্রয় নিল। যখন যারা ক্ষমতায় থাকে, তারা প্রশাসন ও পুলিশকে বিরোধী দলের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। আর বিরোধী দল দাবি আদায়ের মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে হরতাল-অবরোধকে বেছে নেয়। দুই পক্ষের এই বিরামহীন যুদ্ধে যে-ই জয়ী হোক না কেন, গণতন্ত্র নির্বাসিত হলো।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার বাতিল হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে যে দুটি নির্বাচন (২০১৪ ও ২০১৮) হলো, সেটি যদি অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হতো, তাহলে নির্বাচন নিয়ে এত বিতর্ক হতো না। আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীরা এত দিন জোর গলায় বলে আসছিলেন যে ২০২৪ সালের নির্বাচন আগের দুটি নির্বাচনের মতো হবে না।
নিবন্ধিত ৩৯টি দলের মধ্যে মাত্র ১২টি দল ২০১৪ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়। বর্জন করে বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল। ওই নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, যা কেবল বাংলাদেশ নয়, বিশ্বের নির্বাচনী রাজনীতিতে ছিল নজিরবিহীন।
২০১৮-এর নির্বাচনে বিএনপিসহ সব দল অংশ নিলেও জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত হয়নি। অনেক জরিপ ও গবেষণায় বেরিয়ে এসেছে, ২০০৮ সালের পর যারা ভোটার হয়েছেন, সেই তরুণ প্রজন্মের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশই ভোট দিতে পারেননি। এই নির্বাচনের কোনো কোনো কেন্দ্রে শতভাগ ভোট পড়েছে। আবার বিরোধী দলের অনেক প্রার্থী অনেক কেন্দ্রে শূন্য ভোট পেয়েছেন।
এই প্রেক্ষাপটে দেশবাসীর প্রত্যাশা ছিল ২০২৪ এর নির্বাচনটি অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হবে। সব দল অংশ নেবে। কিন্তু পরিস্থিতি যে দিকে গড়াচ্ছে, তাতে সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন হওয়ার আশা ক্ষীণ।
মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ৩০ নভেম্বর। সে ক্ষেত্রে আগামী ১৩ দিনে নাটকীয় কিছু না হলে আমরা ধরে নিতে পারি, ২০১৪-এর মতো আরেকটি একতরফা নির্বাচন হতে যাচ্ছে। আর সেই নির্বাচন করা যে সহজ হবে না, সেটি তফসিল ঘোষণার পর বিভিন্ন স্থানে ট্রেন-বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনাই তার প্রমাণ। আন্দোলনের নামে বাসে-ট্রেনে আগুন দেওয়া যেমন কাম্য নয়, তেমনি একতরফা নির্বাচনও প্রত্যাশিত নয়।
গণতন্ত্রের মূল কথা হলো সমঝোতা, যা থেকে আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব যোজন-যোজন দূরে।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি। ই–মেইল: [email protected]