চমকে ওঠার মতোই সংবাদ বটে। উৎপাদন শুরু করার মাত্র ২৭ দিন পর বন্ধ হয়ে গেছে বহুল আলোচিত রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রথম ইউনিট। কারিগরি কোনো কারণে নয়, চলমান ডলার-সংকটের কারণে ইন্দোনেশিয়া কয়লা সরবরাহ বন্ধ করে দিয়েছে। ওদিকে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রেও কয়লা সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে। মূলত আমদানি মূল্য পরিশোধ করার মতো ডলার হাতে না থাকায় বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি কয়লা আমদানি করতে পারছে না।
ফলে পর্যাপ্ত কয়লার অভাবে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রই আপাতত সাদা হাতিতে পরিণত হয়েছে। অনেকটা আমাদের পাটকল ও চিনিকলগুলোর মতো অবস্থা। তাদের পেছনে এখন ব্যয় হয়, কিন্তু কোনো আয় নেই। রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য আমাদের এখন ব্যয় হবে, কিন্তু আবার কবে উৎপাদন শুরু হবে, তা নিশ্চিত নয়। তবে উৎপাদন না করলেও ক্যাপাসিটি পেমেন্ট হিসেবে বড় অঙ্কের অর্থ পরিশোধ করতে হবে। এ দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য মাসে প্রায় ১৬০ কোটি টাকা পরিশোধ করতে হবে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে উদ্ধৃত করে এ ধরনের সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ফলে ডলার ও অর্থনৈতিক সংকটের এ মুহূর্তে বিদ্যুৎ খাতের জন্য আপাতত কোনো সুখবর নেই। বরং আর্থিক ঘাটতি ও লোকসানের পরিমাণ দিন দিন আরও বাড়ছে। এমনিতেই বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বিপুল অঙ্কের ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হচ্ছে বসিয়ে বসিয়ে। এখন তথাকথিত সরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকেও ক্যাপাসিটি চার্জ দিতে হবে।
কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ ভবিষ্যতে আমাদের বড় ধরনের আর্থিক ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। আমাদের জ্বালানি নীতির পুনর্বিন্যাস করা উচিত ছিল। নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের দিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। যদিও নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে কাগজে-কলমে অনেক কথাই বলা হয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন একেবারেই নেই।
তথাকথিত সরকারি বলা হচ্ছে এই কারণে যে রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি ভারত ও চীনের সঙ্গে যৌথ অংশীদারত্বের ভিত্তিতে নির্মাণ করা হয়েছে। সরকারি হলেও অনেকটা বেসরকারি চরিত্রে পরিচালিত হচ্ছে বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি। চুক্তি বিস্তারিত শর্তাবলি আমরা জানি না, কিন্তু এ বিষয়ে প্রকাশিত সংবাদ পড়ে মনে হচ্ছে, দুটি কেন্দ্র নির্মাণে চীন ও ভারত ঋণ দিয়ে সহায়তা করলেও পরিচালনার যাবতীয় দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের। তবে লভ্যাংশ নিশ্চয়ই ভারত ও চীনের অংশীদারি প্রতিষ্ঠান নিয়ে যাবে। যে কারণে ভারত ও চীনের সঙ্গে আধাআধি মালিকানা থাকলেও ডলার-সংকটের সময় ভারতের ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ার কোম্পানি ও চীনের সিএমসি কয়লা আমদানিতে কোনো ধরনের সহায়তা করছে না। বরং এ সময় তাদের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হবে। এই ক্যাপাসিটি পেমেন্ট কেবল ভারতীয় ও চীনা প্রতিষ্ঠান না আমাদের প্রতিষ্ঠানও পাবে সে বিষয়ে আমার নিশ্চিত নই। ফলে দুটি বিদ্যুৎকেন্দ্রকে পুরোপুরি সরকারি মালিকানাধীন বলা যায় না। এতে সরকারের আধা শতাংশ মালিকানা থাকলেও কার্যত বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতোই মালিকানা ও লভ্যাংশ ভাগাভাগির চুক্তি করা হয়েছে সম্ভবত।
সার্বিক অবস্থা বিবেচনায় মনে হচ্ছে, আগামী শুষ্ক মৌসুমের আগেই রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি চালু হওয়ার সুযোগ কম। তবে সরকার সব সময়ই আশাবাদী যে দ্রুতই উৎপাদন ফিরতে পারবে বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি। তবে পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ চায়না পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেডের চীনা অংশীদার সিএমসি বকেয়া মূল্য পরিশোধ না করলে কয়লা সরবরাহ বন্ধ করার ঘোষণা দিয়েছে। সিএমসির বকেয়া পাওনার পরিমাণ হচ্ছে ১৫১.৫৩ মিলিয়ন ডলার। এমনকি বকেয়া মূল্য পরিশোধ করলেও আসন্ন শুষ্ক মৌসুমে কয়লা সরবরাহের নিশ্চয়তা দেয়নি সিএমসি।
রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন বন্ধ হওয়াকে কমপক্ষে তিনভাবে ব্যাখ্যা করা যায় বা বলা যায় তিনটি সংকটকে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরেছে রামপাল ও পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্র। প্রথমত, আমাদের অর্থনৈতিক সংকটের সর্বশেষ অবস্থাকে তুলে ধরছে। সরকার নানাভাবে এই সংকটকে আড়ালে রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু একের পর এক বিভিন্ন সমস্যা অর্থনৈতিক সংকটে বারবার সামনে নিয়ে আসছে।
দ্বিতীয়ত, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে বরাবরই সরকারগুলো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষা করে চুক্তি কর বলে অভিযোগ রয়েছে। রামপাল ও পায়রা কেন্দ্রেও ঠিক এমনটিই হয়েছে বলে অবস্থাদৃষ্টে মনে হয়।
উৎপাদন বন্ধ থাকলেও বিদেশি অংশীদারি প্রতিষ্ঠানকে ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে হবে। বলা যায়, ত্রুটিপূর্ণ ও বিদেশিদের স্বার্থ রক্ষাকারী চুক্তি এবং অপরিকল্পিত জ্বালানি নীতি কুফল ভোগ করছে পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র দুটি।
তৃতীয়ত অপরিকল্পিত ও পরিবেশ বিনাশী উন্নয়ন পরিকল্পনার বাজে দৃষ্টান্ত হচ্ছে পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র। সুন্দরবনের কাছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। পরিবেশবাদী ও অধিকারকর্মীরা শুরু থেকেই রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের বিরোধিতা করেছে। দীর্ঘ সময় ধরে আন্দোলন করেছে। জাতিসংঘও বিভিন্ন সময় প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন সুন্দরবনকে টিকিয়ে রাখতে রামপালে কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে নেতিবাচক মতামত দিয়েছে। কিন্তু সরকার কারও কোনো কথাই শোনেনি। অনেকটা রাষ্ট্রীয় শক্তি প্রয়োগ করে সব ধরনের বিরোধিতাকে উড়িয়ে দিয়েই সরকার শেষ পর্যন্ত রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছে।
শুধু রামপালই নয়, সারা দেশে সরকার এ ধরনের আরও কয়লানির্ভর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। মাতারবাড়ী ও বাঁশখালীতেও কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ নির্মাণের কাজ চলছে। বর্তমানে ১৫ শতাংশ বিদ্যুৎ কয়লাভিত্তিক কেন্দ্র থেকে আসে। ৫৬ শতাংশ আসে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো থেকে। এদিকে আমাদের গ্যাসের খনিগুলোতে মজুত কমে আসছে। ফলে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর জন্য বিকল্প জ্বালানি উৎস অনুসন্ধান করতে হবে। এ অবস্থায় সরকার ২০৩০ সাল নাগাদ ৫১ শতাংশ বিদ্যুৎ কয়লা দিয়ে উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে। আমাদের স্বল্প মূল্যে সবার জন্য বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু গ্যাসের বিকল্প হিসেবে স্বল্প মূল্যের কয়লা কখনোই নিরাপদ জ্বালানি উৎস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে না।
বরং কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ ভবিষ্যতে আমাদের বড় ধরনের আর্থিক ও পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হতে পারে। আমাদের জ্বালানি নীতির পুনর্বিন্যাস করা উচিত ছিল। নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎসের দিকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত ছিল। যদিও নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে কাগজে-কলমে অনেক কথাই বলা হয়ে থাকে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রতিফলন একেবারেই নেই।
জলবায়ু পরিবর্তনের এই সময় ক্রমে কয়লার ওপর নির্ভরশীলতা টেকসই কোনো নীতি নয়। আর্থিক দিক বিবেচনা করলেও খুব বেশি লাভজনক নয়, বরং এ ক্ষেত্রে জ্বালানি কূটনীতির শিকার হওয়ার ঝুঁকি থাকে। বাংলাদেশ কার্যত কয়লার ডাম্পিংল্যান্ডে পরিণত হতে যাচ্ছে।
জলবায়ু কূটনীতির বিভিন্ন বাধ্যবাধকতার কারণে চীন, ভারত, জাপানসহ অনেক দেশই এখন আগের জ্বালানি হিসেবে কয়লা ব্যবহার করতে পারবে না। তাই বিদেশি বিনিয়োগ ও সহায়তার নামে এসব দেশ আমাদের মতো বিদ্যুৎ ঘাটতির দেশে দূষিত কয়লানির্ভর প্রযুক্তি চাপিয়ে দিচ্ছে। এসব প্রযুক্তি সব দিক থেকেই বিপজ্জনক। এখন হয়তোবা আর্থিক সংকটের কারণে দুটি কেন্দ্রে উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। কিন্তু কয়লা নির্ভরতা বাড়ার কারণে বিদ্যুৎ খাতে বিপর্যয় অবশ্যম্ভাবী ছিল। আজকে আর্থিক সংকট দেখা দিয়েছে, এটা সাময়িক। কিন্তু শিগগিরই পরিবেশ ও প্রতিবেশের ওপর ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
ড. মারুফ মল্লিক লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক