যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরো (এফবিআই) ৮ আগস্ট ফ্লোরিডায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের মালিকানাধীন মার-এ-লাগো এস্টেটে গোপন নথির সন্ধানে অভিযান চালায়। ট্রাম্প এই অভিযানকে ‘শুধুমাত্র তৃতীয় বিশ্বেই সম্ভব এমন একটি আক্রমণ’ বলে নিন্দা জানিয়েছিলেন। তিনি ক্রমাগত এই বলে বিলাপ করছিলেন যে, আমেরিকা ‘এখন সেই পর্যায়ের দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর একটি হয়ে উঠেছে যেখানে নজিরবিহীন দুর্নীতি দেখা যাচ্ছে।’
ট্রাম্পের ছেলে ডোনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র এই বিষয়টিকে মূল্যায়ন করার সুরে টুইট করেছেন: ‘আপনারা যেটি ঘটতে দেখলেন, তা শুধু তৃতীয় বিশ্বের ব্যানানা রিপাবলিকেই (‘ব্যানানা রিপাবলিক’ বলতে এমন একটি রাষ্ট্রকে বোঝানো হয় যেটি বিদেশি ব্যবসায়ী কিংবা প্রতিষ্ঠানের কাছে বন্দী হয়ে পড়েছে। সাধারণত ‘ব্যর্থ রাষ্ট্র’ বোঝাতে এই জোড়া শব্দ ব্যবহৃত হয়) এটিই ঘটতে দেখেছেন!’
এফবিআইয়ের গোপন নথি জব্দ করা যেমন আমেরিকান গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে খাপ খায় না, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রে কর না দেওয়া কোনো শত কোটিপতির প্রেসিডেন্ট হওয়া বা একটি কুটিল অলিগ্যার্কিক করপোরেটতন্ত্র হিসেবে রাষ্ট্র পরিচালিত হওয়ার বিষয়টিও আমেরিকান গণতন্ত্রের সঙ্গে যায় না।
ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে এবারই প্রথম একটি ‘তৃতীয় বিশ্বের দেশ’-এর সঙ্গে তুলনা করেছেন, বিষয়টি এমন নয়। ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জো বাইডেনের কাছে হারার পরও তিনি এই কথা বলেছিলেন।
‘ট্রাম্প অ্যান্ড কোং’ মার্কিন শাসকগোষ্ঠীর একমাত্র সদস্য নয় যারা এই শব্দভান্ডার ব্যবহার করেছে; ইউএস ক্যাপিটলে ২০২১ সালের জানুয়ারিতে হামলার পর আফগানিস্তান ও ইরাকের সভ্যতা ধ্বংসকারী জর্জ ডব্লিউ বুশ থেকে শুরু করে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের মুখেও নিন্দাসূচক ‘তৃতীয় বিশ্ব’ ও ‘ব্যানানা রিপাবলিক’ কথাটি উচ্চারিত হয়েছে।
অনুন্নত দেশগুলোকে এককভাবে উপহাস করার মাধ্যমে মার্কিন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে প্রথম স্থানে রাখতে ‘ব্যানানা রিপাবলিক’ শব্দবন্ধটি তারা ব্যবহার করে আসছে। একইভাবে ‘তৃতীয় বিশ্ব’ কথাটাকে তারাই জিইয়ে রেখেছে।
‘ব্যানানা রিপাবলিক’ বা ‘কদলি প্রজাতন্ত্র’ শব্দবন্ধটি ১৯০৪ সালে মার্কিন লেখক ও’ হেনরি মধ্য আমেরিকান দেশ হন্ডুরাসের উল্লেখ করে প্রথম ব্যবহার করেছিলেন।
প্রতিবেশী গুয়াতেমালার মতো হন্ডুরাস দখলদার মার্কিন পুঁজিবাদ এবং করপোরেট শোষণের প্রাথমিক শিকার ছিল। গুয়াতেমালার অর্থনীতি ছিল কলা চাষের ওপর নির্ভরশীল। আর এই কলা চাষের পুরোটাই নিয়ন্ত্রণ করত ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি। ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানি ব্যবসায়িক কার্যক্রম এতটাই প্রসার ঘটিয়েছিল যে তারা সেখানে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে এবং একসময় দেখা যায়, গুয়াতেমালার প্রায় অর্ধেক জমি তাদের হাতে চলে এসেছে।
আর স্নায়ুযুদ্ধের সময় নিকারাগুয়া থেকে অ্যাঙ্গোলা পর্যন্ত মার্কিন-সমর্থিত হত্যাকাণ্ডের বৈধতার জন্য ‘তৃতীয় বিশ্ব’ তকমাটির জন্ম হয়েছিল। প্রাণঘাতী আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপকে বৈধতা দিতে বৈশ্বিক পরাশক্তি দরিদ্র দেশগুলোকে ‘তৃতীয় বিশ্ব’ হিসেবে আখ্যায়িত করে তাদের প্রতি দাতব্য হাত প্রসারিত করতে থাকে। এটি আদতে নব্য করপোরেট ঔপনিবেশিকতারই একটি আদল।
অনুন্নত দেশগুলোকে এককভাবে উপহাস করার মাধ্যমে মার্কিন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে প্রথম স্থানে রাখতে ‘ব্যানানা রিপাবলিক’ শব্দবন্ধটি তারা ব্যবহার করে আসছে। একইভাবে ‘তৃতীয় বিশ্ব’ কথাটাকে তারাই জিইয়ে রেখেছে।
যদিও ট্রাম্প মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে একটি ‘ভাঙা, তৃতীয় বিশ্বের’ দেশ হিসাবে আখ্যায়িত করেছেন এক ধরনের শ্লেষ থেকে, তবে এতে সত্যের উপাদানও রয়েছে। পছন্দ করুন বা না করুন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র অনেক ক্ষেত্রেই তৃতীয় বিশ্বের প্রথাগত ধরনের সঙ্গে খাপ খায়। এই সত্য কেবলমাত্র তার শাসন ব্যবস্থার অলিগার্কিক কায়দার ক্ষেত্রে নয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেকে বৈশ্বিক ‘উন্নয়নের’ অগ্রগামী হিসেবে প্রচার করে, কিন্তু দেশের স্বাস্থ্যসেবা, দারিদ্র্য এবং অন্য সূচকগুলো প্রতি-উন্নয়নের আভাস দেয়।
২০১৭ সালে জাতিসংঘের চরম দারিদ্র্য এবং মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার ফিলিপ অ্যালস্টন দুই সপ্তাহের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সফরে গিয়েছিলেন। সফর শেষে একটি বিবৃতিতে তিনি কীভাবে ‘অস্বাভাবিক উপায়ে বিপুল সম্পদ থাকা দেশটিতে মানবাধিকারের প্রতি প্রতিষ্ঠিত প্রতিশ্রুতির সঙ্গে বিস্ময়করভাবে বিরোধপূর্ণ’ অবস্থা খুঁজে পেয়েছেন তা দেখিয়েছিলেন।
চীন, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য এবং একক অন্যান্য বৃহৎ শক্তির চেয়ে যুক্তরাষ্ট্র ‘জাতীয় প্রতিরক্ষার’ পেছনে অনেক বেশি অর্থ ব্যয় করলেও বাস্তবতা হলো সেখানে চার কোটি মানুষ দরিদ্র দশায় আছে।
মৃত্যুহারের কথা বললে বলা যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে শিশুমৃত্যুর হার ৬০ বছরেরও বেশি সময় মার্কিন নিষেধাজ্ঞার অধীনে কাটানো দ্বীপ রাষ্ট্র কিউবার চেয়ে বেশি। কিউবা ‘ব্যানানা রিপাবলিক’ মডেল থেকে বেরিয়ে নিজেদের সার্বভৌমত্ব সংহত করতে চেয়েছিল। এর সাজা হিসেবে ট্রাম্প নিজেই কিউবানদের বিরুদ্ধে কমপক্ষে ২৪৩টি নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে গেছেন এবং কিউবাকে আবারও সন্ত্রাসবাদের রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকদের কালো তালিকায় ফিরিয়ে এনেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্র নামের এই ‘মুক্ত দেশে’ গৃহহীনতার মাত্রা এমন ভয়ংকর জায়গায় গেছে যা অনেক ‘অনুন্নত’ দেশেও দেখা যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র নামক এই দেশটি দীর্ঘ সময় ধরে বিশ্বের সর্বোচ্চ বন্দিত্বের হার ধরে রেখেছে।
নিয়তির পরিহাসে এখন দেখা যাচ্ছে, তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ নিপীড়নের জন্য দায়ী বৈশ্বিক মোড়লকে তার নিজ জনগণের একটি উল্লেখযোগ্য অংশকে তৃতীয় বিশ্বের নাগরিকদের দশায় রাখতে হচ্ছে।
আল জাজিরা থেকে নেওয়া
ইংরেজি থেকে অনূদিত
বেলেন ফার্নান্দেজ জ্যাকবিন ম্যাগাজিনের কন্ট্রিবিউটিং এডিটর