দৈনিক প্রথম আলো সম্প্রতি অনুষ্ঠিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদে নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের (এমপি) পেশাগত দিক নিয়ে একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।
প্রতিবেদনটিতে ১৯৭৩ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত নির্বাচনগুলোয় সংসদ সদস্যদের মধ্যে ব্যবসায়ী ও আইনজীবীদের হার নিয়ে তুলনামূলক অনুপাত উল্লেখ করা হয়েছে। উল্লেখ্য, এখানে ব্যবসায়ী বৃহৎ অর্থে ব্যবহার করে শিল্পপতিদেরও করা হয়েছে অন্তর্ভুক্ত। অবশ্য তাঁদের অনেকে দুই ধরনের কাজেই রয়েছেন। এতে ১৯৮৬, ১৯৮৮ ও ১৯৯৬–এর ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের ফলাফলকে বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। বিবেচিত হয়েছে অবশিষ্ট ৯টি নির্বাচন।
এতে দেখা যায়, ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে ব্যবসায়ী ও আইনজীবীর হার ছিল যথাক্রমে ১৮ ও ৩১ শতাংশ। আর ২০২৪–এ এসে তা ঠেকেছে যথাক্রমে ৬৭ ও ৮ শতাংশে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে ১৯৯ জন ব্যবসায়ী নির্বাচিত হয়েছেন। পক্ষান্তরে ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ ও কৃষিজীবীদের সংখ্যা যথাক্রমে ২৪, ২৬ ও ১৪ জন। ফলে প্রতিবেদনটিতে যৌক্তিকভাবে শিরোনাম দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণ ব্যবসায়ীদের ‘দখলে’।
উল্লেখ করা হয়েছে, জাতীয় সংসদে ব্যবসায়ীদের ক্রমবর্ধমান আধিপত্য রাজনীতিতে রাজনীতিবিদদেরই কোণঠাসা করে ফেলছে। বিবেচ্য প্রতিবেদন অনুসারে, ২০০১ সাল থেকে ব্যবসায়ীরা সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পৌঁছেছেন। ২০০১, ২০০৮, ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ সালে যথাক্রমে তাঁদের অনুপাত দাঁড়ায় ৫৮, ৫৭, ৫৯, ৬২ ও ৬৭ শতাংশে।
ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক সাম্রাজ্য স্থাপনের বিষয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আক্ষেপ করে লিখেছিলেন ‘বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল পোহালে শর্বরী রাজদণ্ডরূপে’। সে কোম্পানি ধীরে ধীরে আধিপত্য বিস্তারে একপর্যায়ে পলাশী যুদ্ধ বিজয়ের মাধ্যমে রাজদণ্ড হস্তগত করে।
আমাদের দেশে রাষ্ট্রক্ষমতায় ব্যবসায়ীদের আধিপত্য বিস্তার আকস্মিকভাবে হয়নি। হয়নি কোনো বাঁকা পথে। রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়ন্ত্রণ ও নির্বাচনের জন্য মনোনয়ন প্রদানের ভূমিকায় রাজনীতিবিদেরাই ছিলেন এবং অনেক ক্ষেত্রে এখনো রয়েছেন। তাহলে বলা অসংগত হবে না, তাঁরাই ক্রমবর্ধমান হারে সংসদে নিয়ে আসছেন ব্যবসায়ীদের। ফলে শ্রেণি হিসেবে রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারণে ব্যবসায়ীরাই মূল ভূমিকায় রয়েছেন, এমনটা বলাই যৌক্তিক হবে।
আমাদের জাতীয় সংসদ রাষ্ট্রের আইন পরিষদ। পাশাপাশি নির্বাহী বিভাগ গঠন ও পরিচালনায়ও প্রকৃত ক্ষমতা সংসদেরই। মন্ত্রিসভার সদস্যদের ন্যূনতম ৯০ শতাংশ সংসদ সদস্য হতে হয়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোটারও শুধু তাঁরাই। আইন প্রণয়ন, করারোপ, সংযুক্ত তহবিল থেকে ব্যয় অনুমোদন, প্রশ্নোত্তর ও বিভিন্ন প্রস্তাব উত্থাপনের মাধ্যমে মন্ত্রিসভাকে তাঁরাই দায়বদ্ধ রাখেন। সুতরাং রাষ্ট্র পরিচালনায় ব্যবসায়ীদের কর্তৃত্ব অনেকটাই অপ্রতিহত।
ব্যবসায়ী হওয়া খারাপ কিছু নয়। প্রত্যেক ব্যক্তির জীবিকার জন্য একটি পেশা প্রয়োজন হয়। শিল্প স্থাপন, পরিচালনা, আমদানি–রপ্তানি, বেচাকেনা—সবকিছুই অতি প্রয়োজনীয় কার্যক্রম। এগুলোর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ভোক্তাদের চাহিদা মেটানোসহ অর্থনীতির গতিপ্রবাহের সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত। এর সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট আমাদের জীবনযাত্রা, পৃথক নয় রাষ্ট্রের সমৃদ্ধিও। কর্মসংস্থানসহ সব ক্ষেত্রে এতে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। সুতরাং এসব ব্যবসায় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাতেই রয়েছেন। তবে শুধু এ শ্রেণির নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ রাষ্ট্রের জন্য সুফলদায়ক হতে পারে কি না, এ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। এর সুযোগ নিয়ে তাঁদের কেউ কেউ শ্রেণিস্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হতে পারেন, এমন ধারণাকেও উপেক্ষা করা যাবে না।
এভাবে সংসদের কার্যক্রমের প্রধান দিকটিই যদি দেখা হয়, তাহলে বলা সংগত যে আইন প্রণয়নে নিরঙ্কুশ অধিকার শুধু একটি শ্রেণির হাতে থাকার ঝুঁকি রয়েছে। আইনসভায় সমাজের কোনো শ্রেণির আধিপত্য বিশেষ বিশেষ আইনকে তাঁদের অনুকূলে নিয়ে যেতে পারে। নিকট অতীতে, এমনকি সাম্প্রতিক কালেও এমনটি লক্ষ করা গেছে। সামনের দিকে ভিন্ন কিছু ঘটবে, এমন ধারণা করার সংগত কোনো কারণ নেই।
আইনপ্রণেতাদের সমাজের চাহিদার সঙ্গে সচেতন হওয়ার পাশাপাশি বলবৎ আইন, এর শূন্যতা কিংবা নতুন আইনের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে পেশাগত ধারণা থাকার আবশ্যকতা উপেক্ষণীয় নয়। আইনজীবীরা আইনশাস্ত্র পাঠ করে আদালতে এর চর্চা করেন প্রতিনিয়ত। এটি একটি ব্যবসা হলেও তা বিশেষায়িত। সমাজে প্রচলিত ব্যবসায়ীদের সংজ্ঞায় তাঁরা আসেন না। সুতরাং আইন প্রণয়নে আইনজীবীদের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ বলেই বিবেচনা করা যায়। তবে শুধু আইনজীবী দিয়েই সংসদ হয় না। কোথাও নেই। আমাদেরও ছিল না।
স্বাধীনতার পরপর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তাঁদের অনুপাত ছিল শতকরা ৩১ জন। অবশিষ্ট সদস্যরা ভিন্ন ভিন্ন পেশা থেকে এসেছিলেন এটা সহজবোধ্য।
উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পর গত অর্ধশতাব্দীতে দেশে বিভিন্ন পেশার প্রসার ঘটেছে। প্রয়োজনে এগিয়ে এসেছেন নতুন নতুন উদ্যোক্তা। অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য সামাজিকভাবে তাঁদের অবস্থান দৃঢ় হয়েছে ক্রমেই। সুতরাং তাঁদের প্রতিনিধিত্বের হারও বাড়বে, এমনটাই স্বাভাবিক।
তবে প্রশ্ন থাকবে, কতটা? তেমনিভাবে তো আইনের শিক্ষা ও পেশারও বহুমুখীকরণ হয়েছে। স্বাধীনতার পরপর আইনজীবীদের একটি অংশ ছিলেন মোক্তার। এখন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী আইনজীবী হাজার হাজার। বিলেতসহ পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশ থেকে আইনের উচ্চ ডিগ্রিধারীরাও আছেন অনেক। যুগবাহিত সম্মানিত অবস্থান ‘বার এট ল’ করেও শত শত ব্যক্তি এ পেশায় আসছেন। তাহলে সংসদে তাঁদের প্রতিনিধিত্ব এ হারে কমার কথা নয়।
আলোচনায় প্রাসঙ্গিক যে উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও পাকিস্তান আন্দোলনের নায়কেরা প্রায় সবাই ছিলেন আইনের উচ্চতর ডিগ্রিধারী। আইনের পেশা থেকে তাঁদের কারও কারও আয় ঈর্ষণীয় পরিমাণে ছিল। সামাজিক অবস্থানও তাঁদের ছিল গৌরবোজ্জ্বল। সে পেশা স্থায়ী বা সাময়িকভাবে ছেড়ে তাঁরা আসতেন রাজনীতিতে। নির্বাচিত হতেন আইনসভাগুলোয়। এগুলোর নেতৃত্ব ছিল তাঁদেরই হাতে। এখানে শ্রেণিগত স্বার্থের সংঘাত হওয়ার আশঙ্কা ছিল খুবই কম। তাঁরা ‘উকিল রাজ’ কায়েম করেছিলেন, এমন অভিযোগ শোনা যায়নি। বরং আমরা জানি, ওকালতি পেশা ছেড়ে মন্ত্রিত্ব করতে এসে তাঁদের অনেকেই ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়তেন। আর সে ঋণ শোধ করা হতো মন্ত্রিত্ব চলে যাওয়ার পর আবার ওকালতি করে।
কিংবদন্তিসম সেসব নেতার ধারাবাহিকতায় জাতীয় ও স্থানীয় পর্যায়ের নেতৃত্বে ছিলেন প্রধানত আইনজীবীরা। বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইনশাস্ত্রই অধ্যয়ন করছিলেন। নিম্নস্তরের কর্মচারীদের পক্ষে যৌক্তিক আন্দোলন করতে গিয়ে ছাত্রত্ব হারান। হয়নি আইনের ডিগ্রি নেওয়া। তবে তাঁর প্রধান সহচরদের প্রায় সবাই ছিলেন আইনের ডিগ্রিধারী। কেউ কেউ ছিলেন সফলকাম ও স্বনামধন্য আইনজীবী। সে ট্রেনটির হাতে থাকা রাজনীতি সব ক্ষেত্রে বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল, এমনটি নয়। তবে আইনপ্রণেতার ভূমিকায় তাঁদের অবদান গৌরবোজ্জ্বল ছিল, এমনটা বলা যেতেই পারে।
বলা চলে আইনজীবী কিংবা ব্যবসায়ী বা অন্য কোনো শ্রেণি সংসদের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব থাকবে, এমনটা যথাযথ নয়। ব্যবসায়ী শ্রেণির এমনতর বিকাশ যখন ঘটছে, তখন দেশের আর্থিক ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি আমরা লক্ষ করছি। এ সময়ে খেলাপি ঋণ মাত্রাতিরিক্তভাবে বৃদ্ধি পায়। ধারণা করা হয়, তাঁদের প্রভাবে সে খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য জোরালো উদ্যোগ নেই। বরং অভূতপূর্বভাবে তাঁদের নগণ্য পরিমাণ কিস্তিতে সেটা নবায়ন করার সুযোগ দিয়ে ব্যাংকব্যবস্থাকে বিপর্যয়ে ফেলা হয়েছে।
মুদ্রাস্ফীতি, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ–সংকট, বিদেশে অর্থ পাচারসহ এ ধরনের অবস্থা এত প্রকটভাবে আগে ছিল না। এতে সব ব্যবসায়ী লাভবান হচ্ছেন, এমনও নয়। ঋণখেলাপি না হয়েও সফলভাবে ব্যবসা করছেন এ দেশে অনেক সম্মানিত ব্যবসায়ী।
আমরা নির্বাচনব্যবস্থাকে সংস্কারের জন্য বরাবর দাবি করে আসছি। আর সেটা যদিও হয়, রাজনৈতিক সংস্কৃতির পরিবর্তন না ঘটলে সংসদে শ্রেণিগত প্রতিনিধিত্বের হারে তেমন কোনো পরিবর্তন আসবে—এমন ধারণা করা যায় না। দুঃখজনকভাবে দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে শুধু ব্যবসায়ীদের নেতৃত্বে ঠেলে দিচ্ছেন রাজনীতিবিদেরাই। প্রত্যাশা করব, সবাই বিষয়টি ভাবনায় নেবেন। চেষ্টা করবেন এর প্রতিকারের।
● আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব