৪২ বছর আগে দেশছাড়া এক প্রবাসীর বাংলাদেশ দর্শন

এই বিশাল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আরও যে সব অবকাঠামো ঢাকায় যুক্ত হয়েছে, তার একটি হলো ২০ কিলোমিটারের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েছবি : প্রথম আলো

প্রায় সাত বছর পর বাংলাদেশে গিয়েছিলাম এক মাস কাটানোর জন্য। বিদেশে আছি ৪২ বছরের বেশি।

এই ৪২ বছরে বহুবার দেশে গিয়েছি, দু-তিন বছর পরপর। কোনো কোনো সময় এক বছর পরও। একটানা সাত বছর পর এই প্রথম যাওয়া। কাজেই দেশের পরিবর্তন, বিশেষ করে ঢাকার পরিবর্তন চোখে লাগার কথা। অনেকটা তাক লাগানো পরিবর্তন।

সাত বছর আগে ঢাকার ভূদৃশ্য আর বর্তমানের দৃশ্যের মধ্যে অনেক তফাত। তখন না ছিল উড়ালসড়ক, না ছিল পদ্মা সেতুতে যাওয়ার উন্মুক্ত রাস্তা; যেখানে সহজে ২০ কিলোমিটার পথ ১০-১৫ মিনিটে পার হওয়া যায়।

সাত বছর আগে ঢাকায় এত উঁচু উঁচু ভবন ছিল না। এখন এসব ভবন ঢাকার প্রান্তিক এলাকায়ও ছেয়ে গেছে।

এত পণ্যের দোকান, যা সুপারমার্কেট নামে বিদেশে পরিচিত—সাত বছর আগে এত দেখিনি। যেখানেই গিয়েছি, নানা ধরনের খাবারের রেস্তোরাঁ দেখে শুধু অবাকই হইনি, তাতে খাবারের দাম আর খদ্দেরের প্রাচুর্য দেখেও অবাক হয়েছি। অবাক হয়েছি ঢাকার পণ্যের দোকানে বিদেশি পণ্যের সমাহার দেখে। অবাক হয়েছি বস্ত্রের দোকানে দেশে তৈরি পোশাকের উন্নত মান আর দাম দেখে।

এই পোশাক বিদেশে রপ্তানির জন্য নয়, দেশি ক্রেতাদের জন্য। ভাবলাম, আমি হয়তো ব্যাংকক বা সিঙ্গাপুরে চলে এসেছি। আমি যদি প্রবাসী বাঙালি না হয়ে একজন বিদেশি হতাম, তাহলে হয়তো এ ধরনের ভ্রান্ত ধারণা নিয়েই ফিরতাম।

কিন্তু আসলে আমি জন্মগতভাবে একজন বাঙালি। আমার প্রথম জীবন ও যৌবন কেটেছে বাংলাদেশে। আমি এ দেশেই আমার কর্মজীবন শুরু করেছিলাম। অযাচিত আর অভাবিত কারণে বিদেশে থাকি। তাই আমার বাংলাদেশ পুনর্দর্শন বিদেশি পর্যটকের চোখে নয়, একজন দেশি মানুষের চোখে।

কথা হচ্ছে, এ ঝুড়িটিকে কীভাবে পূর্ণ রাখা যায় আগামী প্রজন্মের জন্য। যে দেশের ১৯৭২-এ গড়পড়তা আয় ছিল ৫৭৬ ডলার, তা আজ ২ হাজার ৬৭৭ ডলারে দাঁড়িয়েছে। যদিও এটি পরিসংখ্যানের ব্যাপার এবং গড় আয় থেকে কখনোই সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় সম্পর্কে ধারণা করা যায় না, তবু আমার পরোক্ষ পর্যবেক্ষণে দেখেছি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক পরিবর্তন।

এক মাস কাটিয়ে বাংলাদেশের ওপর মন্তব্য করা অনেকটা অন্ধের হাতি দর্শনের মতো। যতটুকু দেখেছি, তাতে হাতির শুঁড় স্পর্শ করে হাতি সম্পর্কে মন্তব্য করার মতো হতে পারে। তাই আমার মন্তব্যগুলো সেভাবেই করছি।

প্রথম, বাংলাদেশের চাক্ষুষ উন্নতি আমি ঢাকায় আর ঢাকার বাইরে দুটি জেলা, সিলেট ও গাজীপুর ঘুরে দেখেছি। এর মধ্যে গাজীপুরকে প্রায় ঢাকার একটি উপনগর বলেও চলে। কারণ, এটি ঢাকা থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে।

সিলেট সত্যিকার অর্থে আরেকটি দূরবর্তী জেলা ও নগর। সুতরাং সিলেটকে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের উন্নয়নের আরেকটি পরিমাপক হিসেবে দেখা যায়।

এই চাক্ষুষ উন্নতি হিসেবে আসরে কী ঘটেছে এই সাত বছরে? উন্নতির সবটাই কি অবকাঠামোর? পদ্মা সেতু এই অবকাঠামোর একটি প্রধান সোপান, যা নির্মাণে সরকারি হিসাবে খরচ হয়েছে ৩২ হাজার কোটির বেশি (রেলসেতু বাদ দিয়ে), যা সরকার নিজের অর্থায়নে করেছে বলে দাবি করা হয়ে থাকে। এর সঙ্গে নির্মাণ করা হয়েছে ১২ কিলোমিটারের পদ্মা সেতু সংযোগ সড়ক, যা ঢাকা শহরের অলিগলির যানজট এড়িয়ে সোজা সেতুতে তুলবে যানবাহনগুলোকে।

এই বিশাল কর্মকাণ্ডের সঙ্গে আরও যেসব অবকাঠামো ঢাকায় যুক্ত হয়েছে, তা হলো ২০ কিলোমিটারের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, চার-চারটি উড়ালসড়ক, আর ঢাকা থেকে নতুন শহর পূর্বাচলের সঙ্গে আরও ২০ কিলোমিটারের ২৪ লেনের মহাসড়ক।

এ তো গেল সড়কের কেচ্ছা। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মিত হয়েছে দুটি বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে অংশীদারি মালিকানায় এবং ঋণে। পূর্বাচলের মহাসড়ক নির্মিত হচ্ছে একেবারে দেশি কারিগরি সাহায্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং শাখার তত্ত্বাবধানে। ২০ কিলোমিটার মহাসড়ক এখন প্রায় শেষ।

এর ওপর নির্মিত হয়েছে অভূতপূর্ব মেট্রোরেল, যা দুই দশক আগেও ছিল স্বপ্নের রাজ্যে। জাপানের অর্থায়নে ও কারিগরি সহায়তায় পরিকল্পিত ছয় লাইনের এই মেট্রোরেলের ২১ কিলোমিটারের একটি লাইন গত বছর থেকে চালু।

বাকিগুলো হয় নির্মাণাধীন, না হয় কারিগরি প্রযুক্তিতে আছে। মেট্রোরেলের প্রথম লাইনের আনুমানিক খরচ প্রায় ৩৩ হাজার কোটি অর্থাৎ পদ্মা সেতুর চেয়েও এক হাজার কোটি বেশি।

বাকি মহাপ্রকল্পগুলো ঢাকার বাইরে। তাই দেখতে পাইনি। পাইনি দেখতে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেল বা মহাসড়ক সম্প্রসারণ। কিন্তু যা দেখেছি, তাতেই বুঝেছি, বাংলাদেশে অবকাঠামোর উন্নতির এক মহা উদ্যোগ চলমান।

জানি না এ মহাপ্রকল্পগুলো বাস্তবায়নে আর পরবর্তী সময়ে সাহায্যকারী দেশ ও সংস্থাগুলোর ঋণ পরিশোধে সরকার কী ব্যবস্থা নেবে।

এই চাক্ষুষ উন্নতির আরেকটি দিক ছিল ঢাকা, গাজীপুর আর সিলেট শহরের ব্যাপক বিস্তৃতি, শহরগুলোর অবয়ব পরিবর্তন, বিপণিবিতান আর খাবারের স্থানের ছড়াছড়ি। এটাকে উন্নতি বলব নাকি নগরায়ণের অবশ্যম্ভাবী পরিণতি বলব, বুঝে উঠতে পারিনি।

প্রতিটি শহরে, বিশেষ করে ঢাকায় স্থানে স্থানে উঠেছে বহুতল ভবন, যার কারণে বহু জায়গায় লোক সূর্যের আলো দেখতে পায় না। ঢাকা শহর এত বিস্তৃত যে পাশের দুটি নগরী নারায়ণগঞ্জ আর গাজীপুরের মধ্যে সীমানা নির্ধারণ করা যায় না।

গাড়িঘোড়ার জট এত বেশি যে উড়ালসড়ক আর এক্সপ্রেসওয়ে থাকা সত্ত্বেও দুই কিলোমিটার যেতে আধা থেকে এক ঘণ্টা সময় লেগে যায় অনেক সময়। হবেই–বা না কেন। বাংলাদেশ মোটর ভেহিকেল রেজিস্ট্রেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গত বছর (২০২৩) ঢাকায় প্রায় ১ লাখ ৭৫ হাজার গাড়ি রেজিস্ট্রিভুক্ত ছিল।

একই সংস্থার পরিসংখ্যান থেকে জানা গেল, গত ১২ বছরে ঢাকা শহরে গাড়ি বেড়েছে ৬৩ শতাংশ। তার তুলনায় রাস্তা বাড়েনি। জনসংখ্যা বেড়েছে একই সময়ে ৬৬ শতাংশ। এত লোক এত গাড়ি, রাস্তায় যানজট হবে, সেটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু আরও অনেক জনবহুল শহর আছে পৃথিবীতে। তারা কি এ ধরনের সমস্যার সমাধান করে না?

পণ্যের সমাহার আর খাবার দোকানের বৈচিত্র্য বোধ হয় উন্নতির আরেকটি মাপকাঠি। সাত বছর আগেও এত দামি আর বৈচিত্র্যপূর্ণ বিপণিবিতান আর রেস্তোরাঁ আমি দেখিনি। বিপণিবিতানগুলো (বেশির ভাগ ঢাকার অভিজাত এলাকায়) উচ্চমূল্যের সঙ্গে উচ্চ মানের পণ্য রাখে।

দেখে মনে হলো, খদ্দেররা পণ্যের পরোয়া যতটা করেন, দামের ততটা পরোয়া করেন না। একই অবস্থা রেস্তোরাঁগুলোর।

যে ঢাকায় আমরা আমাদের সময় কাবাব আর পরোটা খেয়ে নিজেদের ধন্য মনে করতাম, যেখানে একটি-দুটি চায়নিজ খাবারের দোকান আমাদের কাছে অভিজাত রেস্তোরাঁ মনে হতো, সে ঢাকা আজ বিশ্ব খাবারকেন্দ্রে রূপান্তরিত।

শুধু অভিজাত এলাকায় নয়, ঢাকার চারদিকে ছড়িয়ে আছে বিভিন্ন দেশের রান্নাবান্না, দেশি খাবার থেকে শুরু করে পাশের দেশ ভারতীয়, নেপালি, শ্রীলঙ্কা, জাপান, চীন, ইতালি, ইরান, তুরস্ক, গ্রিস, লেবানন—কী নেই।

বাংলাদেশের লোকের খাবারের জন্য এ ধরনের বিশ্বপ্রেম দেখে অবাক না হওয়ার কোনো উপায় নেই। আর দামের ব্যাপারেও তাদের বিশেষ উৎকণ্ঠা দেখলাম না, বিশেষ করে অভিজাত এলাকাগুলোয়।

এ পরিবর্তন কি শুধু সার্বিকভাবে অর্থনৈতিক উন্নতির লক্ষণ, নাকি বিশেষ শ্রেণির লোকের অধিক অর্থায়নের ফল?

গাজীপুরে আমি বেশি সময় কাটাতে পারিনি যানজটের কারণে। ঢাকা থেকে প্রথম এক্সপ্রেসওয়ে ধরে পরে আরেকটি উড়ালসড়ক ধরে গাজীপুর পৌঁছালাম মাত্র ১৫ মিনিটে। এরপর শুরু হলো যানজট।

শহরের মুখ থেকে একটুকু ভেতরে গিয়ে ফিরে আসি। আমার স্মরণের সেই গাজীপুর থানা আজ গাজীপুর মহানগর। গাজীপুর এখন বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি তৈরি পোশাকশিল্পের প্রাণকেন্দ্র।

সিলেটের চাক্ষুষ উন্নতি ঢাকার মতো চোখে ধরা না হলেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে।
ছবি : প্রথম আলো

এটা নিশ্চয়ই উন্নতির আরও একটি প্রধান সোপান। কিন্তু এই প্রাণকেন্দ্রের বাসিন্দাদের যাতায়াত যদি প্রতিনিয়ত যানজটের মধ্যে কাটে, সময় যদি রাস্তায় দিতে হয়, কাজ করতে সময় কোথায়?

সিলেটের চাক্ষুষ উন্নতি ঢাকার মতো চোখে ধরা না হলেও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ঢাকার মতো বহুতল ভবন নেই (ধন্যবাদ সিলেট কর্তৃপক্ষকে) তবে শহর অনেক বিস্তৃত হয়েছে।

আমার গ্রামের বাড়ি যা শহর থেকে পাঁচ মাইল দূরে, সেখানে গাড়ি করে ১৫ মিনিটে যাওয়া যায়। সুরমা নদী, যা সিলেট শহরকে জেলার অন্যান্য অঞ্চলকে বিভাজিত করে তার ওপর এখন চারটি সেতু, যেখানে একটি সেতু ছিল আমাদের কালে।

কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় সরকারি ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া। বেসরকারি উদ্যোগে তবে সরকারি সাহায্যে নির্মিত হচ্ছে একটি কিডনি হাসপাতাল, যা দুই বছর ধরে একটি ভাড়া দালানের মধ্যে কাজ শুরু করেছে। নির্মাণকাজ চলছে চার লেনের ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের।

বিপণিবিতান আর রেস্তোরাঁ তো বাড়ছে আর বাড়ছে। তার সঙ্গে বাড়ছে যানজট, যদিও ঢাকার ধারেকাছে নয়। তবে সিলেটের এ উন্নতির পেছনে কাজ করছে সিলেটের বিরাট প্রবাসীদের পরিশ্রম আর অনুদান।

প্রথমেই বলেছিলাম, আমার মন্তব্যগুলো আমার এক মাসের নিরীক্ষণের ওপর। এক মাসে কোনো গবেষণামূলক লেখা সম্ভব নয়। তবু আমি বলব, প্রথম দশকের বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশে শত মাইলের তফাত। আজকের বাংলাদেশ তলাবিহীন ঝুড়ি নয়, বরং এ ঝুলি উপচে না পড়লেও এটা কানায় কানায় ভারী।

কথা হচ্ছে, এ ঝুড়িটিকে কীভাবে পূর্ণ রাখা যায় আগামী প্রজন্মের জন্য। যে দেশের ১৯৭২-এ গড়পড়তা আয় ছিল ৫৭৬ ডলার, তা আজ ২ হাজার ৬৭৭ ডলারে দাঁড়িয়েছে। যদিও এটি পরিসংখ্যানের ব্যাপার এবং গড় আয় থেকে কখনোই সাধারণ মানুষের প্রকৃত আয় সম্পর্কে ধারণা করা যায় না, তবু আমার পরোক্ষ পর্যবেক্ষণে দেখেছি বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক পরিবর্তন।

যেসব গ্রামে আমি গিয়েছি, সেখানে দেখেছি মাঠের কাজে লিপ্ত মানুষ, নির্মাণকাজে কর্মী, তা দালানকোঠায় হোক, কি রাস্তার কাজে, কি ইটের ভাটায়। এঁদের হাতেই গড়ে উঠছে বাংলাদেশ। তাঁদের ভাগ্যে অর্থনীতিবিদদের কথায় গড়পড়তা বিরিয়ানি খাওয়া না হোক, ভাত জুটছে।

যেটি এখন দরকার, তা হচ্ছে উন্নতির সোপানের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উন্নতির খরচের দিকেও সমান নজর দেওয়া। মহাপ্রকল্প নেওয়া ভালো, তবে নতুন নতুন প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে চলতি প্রকল্পগুলো শেষ করা দরকার।

আর দরকার, যে ঋণ দেশ নিচ্ছে, তার বোঝা যেন পরবর্তী প্রজন্মকে বহন করতে না হয়, সেদিকে নজর দেওয়া। সঙ্গে সঙ্গে দরকার দেশকে পরিচালনার জন্য পরিকল্পিতভাবে দক্ষ জনবল তৈরি করা, শিক্ষার মান উন্নত করা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মান উন্নত করা। এগুলো প্রকৃত উন্নতির স্তম্ভ।

  • জিয়াউদ্দিন চৌধুরী সাবেক বিশ্বব্যাংক ও ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মচারী