শিশুরা বড় হয়ে কেন কিছু হতে চায় না

রক্তমাংসের মানবশরীর নিয়ে আইকনরা কি আর আগের মতো অনুপ্রাণিত করতে পারছে না? দুই দশক আগেও এত এত মোটিভেশনাল স্পিকার বা অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তব্যদাতা ছিল না। সাকল্যে বই পড়ে কিংবা অল্প কিছু বায়োপিক দেখে হয়তো শিশুরা তাদের আইডল, আইকন বেছে নিত। এখন তো গেজেট হাতে নিলেই মোটিভেশনের ফোয়ারা।

মাঝেমধ্যে শিশুদের, বড় হয়ে কী হতে চাও, জিজ্ঞেস করলে কেউ কেউ কিছু সময় চুপ থেকে উত্তর দেয়, কিছুই হতে চাই না। অথচ সেসব শিশুর কেউ বিজ্ঞানী, কেউ ট্রাভেল ভ্লগার হতে চাইতো। এই বয়সে একটা শিশুও তার প্রাক্‌-নির্ধারিত ধারণা বদলাতে চাইছে। কী নিদারুণ অনিত্যতা আমাদের এই আধুনিক সময়ে। তা কি দুশ্চিন্তার নয়?

সৃজিত মুখার্জির সিনেমা ‘গুমনামি বাবা’। সুভাষ চন্দ্র বোসকে নিয়ে বানানো বায়োপিকে একটা অংশ আছে, সুভাষ বোসের মৃত্যুরহস্য নিয়ে। বলা হয়, মহাত্মা গান্ধী আর রবীন্দ্রনাথের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ওয়েল ডকুমেন্টেড না হলে পোড়া দেশে আইকনের যে অভাব, তা-ই এখনো ভাবা হয় ফিরে এসে দেশের হাল ধরবেন সুভাষ।

বাস্তব আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দুই পরতে আমাদের জীবন এখন। হইহুল্লোড় আর দেখনদারির এক রাংতা মোড়ানো জীবন, যেটি দেখানোর আর একটি লুকিয়ে রাখা, চেপে রাখা জীবন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমাদের কথা বা লেখা যেন চিন্তাহীন ফাঁপা উচ্ছ্বাস। লাইক আর রিয়েকশনের বিরামহীন শোভাযাত্রা।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমরা যে উচ্ছ্বাস দেখাই, তা কি আমাকে প্রতিনিধিত্ব করে? সব কেমন ওপর ওপর। শাহরুখ খান এক ইন্টারভিউতে বলেছেন, এই প্রজন্ম ডিমোশনাল (ইমোশনাল নয় কিন্তু)। ডিটাচড (সংযোগহীন) আর ইমোশনাল (আবেগপ্রবণ), ডিটাচড আর ইমোশনালের যৌথতায় ডিমোশনাল।

আমাদের ব্যবহার করা ভাষার ভেতরের অর্থ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে শব্দগুলো এখন ফাঁপা আওয়াজমাত্র। আমাদের শব্দ ও বাক্যগুলো তাদের শিকড়বিচ্ছিন্ন। আমাদের ভাব ও ভাষা এক নয়। আমাদের বৌদ্ধিক প্রবণতা, আমাদের মনন প্রণালি পথহীন। আর আমাদের সেই বিকৃত ও দুর্বল বুদ্ধিহীনতা পুঁজি করেছে ইলন মাস্ক আর জাকারবার্গরা।

গোটা বিশ্ব অহেতুক অপ্রয়োজনীয় খরচের গিরিখাতে। আলঝেইমার রোগনিয়ন্ত্রণে যত টাকা খরচ করা হয়, তার পাঁচ গুণ টাকা খরচ করা হয় পুরুষের যৌন উত্তেজনা বৃদ্ধিতে আর নারীর স্তন উন্নতকরণ কাজে। লাতিন চিন্তক এদুয়ার্দো গালিয়ানো ভবিষ্যদ্বাণী করেন, আর পাঁচ বছরের মধ্যে সুবিশাল স্তনধারী বৃদ্ধা ও ঋজু পুরুষাঙ্গ নিয়ে পুরুষের সংখ্যা অনেক পাওয়া যাবে, কিন্তু মুশকিল হলো, তাঁরা কিছুতেই মনে করতে পারবে না ওগুলো দিয়ে তারা কী করবে। এমন চিন্তার পূর্বসূরি যাদের সেসব উত্তরসূরির শিশুরা বড় হয়ে কিছু না হতে চাইতেই পারে।

উদারতাবাদের উন্নীতকরণের ফলে এসেছে নব্য উদারতাবাদ। কথিত এই ‘নব্য উদারতাবাদ’ প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোগুলো দুর্বল করে নির্দিষ্ট শ্রেণির কাছে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করেনি কেবল, অনেক দেশের সার্বভৌমত্ব আপস, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রভাব বিস্তার, শ্রমের বিভাজন, মানুষের জীবন প্রণালির পরিবর্তন, সামাজিক বন্ধন, চিন্তার রীতিনীতি ও পারিবারিক কাঠামো ইত্যাদির ক্ষেত্রে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে।

আদতে এটি মানুষের আর্থিক বিষয়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি সমাজের অন্তর্গত সব বিষয়ে এর সরব উপস্থিতি সব ওলটপালট করেছে। চিন্তা দারিদ্র্যের পুনরুত্থান, মহামারির মতো নিঃসঙ্গতায় আক্রান্ত, জলবায়ু বিপর্যয়, সামাজিক পুঁজি অবলোপন, এমনকি দেশে দেশে লোকরঞ্জনবাদের উত্থান ইত্যাদিকে নব্য উদারতাবাদের সংকটের ফলাফল হিসেবে উল্লেখ করেন সমাজতাত্ত্বিকেরা।

এমন এক সময় এসেছে, আইনশৃঙ্খলার প্রধান কিংবা উচ্চপদস্ত আমলা থেকে নিচু স্তর পর্যন্ত ধনতন্ত্র দ্বারা দুর্বৃত্তায়ন ঘটিয়েছেন। অর্থনীতিতে ভরসার লোকজন ও বাছাই করা কিছু পুঁজিপতিদের সম্পদ বৃদ্ধির বিকৃত ও অবৈধ প্রচেষ্টায় যারা রক্ষক হওয়ার কথা, তারাই এখন দুর্বৃত্তায়নের প্রিয় দোসর যেন। সবাই এ প্রচেষ্টাকে অন্যায় বলে স্বীকার করেও এই বিকৃত, অন্যায় ও হীন উদ্যোগকে অর্থনৈতিক কলাকৌশলের স্তরে উন্নীত করেছে এবং জাতীয় স্বার্থে পরিপূর্ণ আস্থার সঙ্গে এই নীতি প্রকাশ্যে অনুসরণ করা হচ্ছে।

কয়েক দশক আগে দক্ষিণ কোরিয়ার সরকার সে দেশে শিল্পায়নের জন্য স্যামসাং, এলজির মতো টেক করপোরেট সংস্থাগুলোকে প্রণোদনা দিয়েছিল নানাভাবে ও উৎসাহিত করেছিল। আমাদের সরকারও ভুঁইফোড় কিছু কোম্পানিকে উৎসাহিত করছে। কিন্তু দক্ষিণ কোরিয়া ও যুদ্ধবিধ্বস্ত জাপানের সরকারিনীতির সঙ্গে আমাদের পার্থক্য আকাশ-পাতাল। ওখানে ছিল কাঠামোবদ্ধ, আর এখানে নিতান্ত অশুভ আঁতাতের। তাদের জন্য সরকারি বা বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবারিত দ্বার। বন্ধ দরজা অবলীলায় খুলে যায় কৌশলী কড়া নাড়ায়। অন্যদিকে মাত্র হাজার টাকার ঋণের কিস্তি অনিয়মিত হলে হালের গরু আর চালের টিন হারাতে হয় গ্রামের গরিবদের।

শোষণ চলে নানাভাবে। মতাদর্শের মাধ্যমে শোষণযন্ত্র চালু রাখতে এক কার্যকর পন্থা ব্যবহারের কথা বলছেন আলথুসার। এর নাম ‘আইডিওলজিক্যাল স্টেট অ্যাপারেটাস’, যাকে বাংলায় ‘মতাদর্শিক রাষ্ট্রীয় প্রযুক্তি বা কাঠামো’ বলে। এ প্রযুক্তি বা কাঠামোগুলো দৃশ্যমান কোনো সহিংসতা ছাড়াই মানুষকে শোষণ মেনে নিতে শেখায়। মতাদর্শিক রাষ্ট্রীয় কাঠামোর অন্তর্ভুক্ত আমাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠান শিক্ষালয়, গণমাধ্যম ও পরিবারও। এসব কাঠামো ব্যক্তির ক্ষমতাসীন শ্রেণির অধীন হিসেবে গড়ে তোলার কাজ করছে বলে মনে করেন আলথুসার। এই সমূহ অনাচারের কারণে শিশুরা আইকন না পেয়ে আজিজ–বেনজীর-আছাদুজ্জামান–মতিউর–মাহমুদ ফয়সাল হওয়ার চেয়ে কিছু না হতে চাওয়াই শ্রেয়। যেহেতু শুভবোধের অন্ত্যেষ্টি সম্পন্ন হয়েছে।

  • এম এম খালেকুজ্জামান আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট, বাংলাদেশ