একসময় যাকে ‘মধ্য ডানপন্থা’ বলা হতো, এ বছরই তার চূড়ান্ত পতন ঘটেছে। এদের কখনোই সুসংগঠিত কোনো রাজনৈতিক দর্শন ছিল না। সাধারণত বড় ব্যবসায়িক স্বার্থের চাহিদাকে প্রাধান্য দেওয়া, তথাকথিত ঐতিহ্যবাহী মূল্যবোধকে সমর্থনের মিশ্রণ ছিল এদের দর্শন। সর্বোপরি, এরা একটা বেষ্টনী তৈরি করার দাবি করত, যাতে আরও চরম কোনো ডানপন্থা রাজনৈতিকভাবে বাড়তে না পারে।
কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়নি। ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ নাইজেল ফারাজ দাবি করছেন যে তাঁর জনতুষ্টিবাদী ডানপন্থী রিফর্ম পার্টির সদস্যসংখ্যা এখন টোরিদের চেয়ে বেশি। তা যদি সত্যি হয়, তাহলে ব্রিটিশ ইতিহাসে প্রথমবার কোনো ডানপন্থী দলের সদস্যসংখ্যা কনজারভেটিভ পার্টির সদস্যদের ছাড়িয়ে গেছে। প্রায় দুই দশক আগে, তৎকালীন টোরি নেতা ডেভিড ক্যামেরন ‘পাগল, উদ্ভট এবং গোপন বর্ণবাদী’ বলে ফারাজকে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ ক্যামেরনের পার্টি তাদের তুলনাতেই পিছিয়ে পড়ল।
এই পরিবর্তনের পেছনে কী রয়েছে? এক দশকের বেশি সময় ধরে টোরি অর্থনৈতিক নীতির কারণে যুক্তরাজ্যে জীবনের মান স্থবির হয়েছে। ধ্বংসের মুখে পড়েছে সরকারি অবকাঠামো। নিজেদের সৃষ্ট সমস্যাগুলো সমাধান করতে অনিচ্ছুক টোরি পার্টি বিভাজনমূলক বিষয়গুলো ব্যবহার করে জনসাধারণের মনোযোগ ভিন্ন দিকে সরিয়ে নিয়েছে। দোষ চাপানোর জন্য বলির পাঁঠা তৈরি করেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী মার্গারেট থ্যাচারের থ্যাচারবাদ প্রস্তাব করেছিল সরকারি বাড়ি বিক্রি ও বেসরকারীকরণ বাড়াতে। এতে স্বল্প মেয়াদে কিছু সুবিধা হলেও দীর্ঘ মেয়াদে ভয়াবহ ব্যয় বেড়েছিল। তবে তা তখনকার ভোটারদের কিছুটা শান্ত করেছিল। আজ সেই ধরনের কোনো বিকল্প নেই। এর পরিবর্তে টোরি পার্টি এমন একধরনের রাজনীতির অনুকরণে বাধ্য হচ্ছে, যা একসময় তারা অত্যন্ত চরমপন্থী বা অমার্জিত বলে মনে করত।
ডেভিড ক্যামেরন ব্রিটিশ রাজনীতিতে অভিবাসনকে এক বিষাক্ত ব্যাপারে পরিণত করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি ছিলেন ব্রেক্সিটের একজন মূল স্থপতি। টোরি পার্টির সাবেক চেয়ার সাঈদা ওয়ার্সি। তিনি ব্রিটিশ মুসলমানদের নিয়ে ক্যামেরনের ঘনিষ্ঠ সহযোগী মাইকেল গোভের মতামত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিলেন। লন্ডনের মেয়র পদের জন্য জ্যাক গোল্ডস্মিথের জঘন্য ইসলামোফোবিক প্রচারণা ক্যামেরনের শাসনকালের সময়েই হয়েছিল। ডানপন্থী উগ্রবাদী লিজ ট্রাসকেও ক্যামেরন একসময় কম তোয়াজ করেননি।
যুগান্তকারী ব্রেক্সিটের সময় দেখা গেছে কীভাবে টোরিরা জনতুষ্টিবাদের আশ্রয় নিয়ে যুক্তি-বুদ্ধির অবশিষ্ট প্রতিরোধের প্রাচীর ভেঙে দিয়েছিলেন। থেরেসা মে তাঁর ২০১৬ সালের কুখ্যাত বক্তৃতায়, বরিস জনসনের ডানপন্থী চরমপন্থীদের তোষণ তাতে হাত লাগিয়েছে। লিজ ট্রাস তাঁর প্রধানমন্ত্রিত্বের পতনের পর মার্কিন ডানপন্থী বক্তাদের জোটে যোগ দিয়েছেন। তবে কেবল ব্রিটেনেই যে এমন ঘটছে তা নয়। রিপাবলিকান পার্টির ট্রাম্পীয় দখলদারির দিকে নজর দিন। এটি সম্ভব হয়েছিল দলের প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্ব নিজেই ষড়যন্ত্রবাদ এবং ইসলামভীতি প্রচার করার ফলে। ২০০৯ সালে বারাক ওবামার জন্মসনদ নিয়ে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব প্রচারে লিপ্ত হয়েছিলেন লিজ চেনি। সেই চেনিকেই এখন ‘মধ্যপন্থী’ হিসেবে দেখা হয়।
ইউরোপজুড়ে একই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। অস্ট্রিয়ার পিপলস পার্টি ২০০০ সালে ডানপন্থী ফ্রিডম পার্টির সঙ্গে প্রথম জোট গঠন করে। ২৪ বছর পর, আরও চরমপন্থী হওয়া ফ্রিডম পার্টি নির্বাচনে প্রথম স্থান অর্জন করে। আর পিপলস পার্টি আরও ডান দিকে সরে গেছে। হাঙ্গেরিতে শাসক ফিদেস পার্টি মধ্য ডানপন্থা থেকে প্রাক্-ফ্যাসিস্টে রূপান্তরিত হয়েছে। ইতালিতে তথাকথিত মধ্য-ডানরা ডানপন্থী নেতৃত্বাধীন সরকারের ছোট অংশীদার। জার্মানির ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটরা ডান দিকে সরে গেছে আর দেশটির চরম ডানপন্থীরা বাড়ছে।
এমন এক জায়গায় নিয়ে আসতে সাহায্য করেছে সাবেকি সংবাদমাধ্যম কিছু অংশ। বিশেষ করে রুপার্ট মারডকের নেতৃত্বাধীন গণমাধ্যমগুলো। তারা সংখ্যালঘুদের—মুসলিম, অভিবাসী, শরণার্থী ও ট্রান্সজেন্ডারদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে একটানা প্রচারণা চালিয়েছে। আজ ইলন মাস্ক তাঁর প্ল্যাটফর্ম এক্স (পূর্বের টুইটার) ব্যবহার করছেন ডানপন্থী উগ্রবাদ ছড়ানোর অস্ত্র হিসেবে। এত কিছু বলার মানে পুরোনো মধ্য-ডানপন্থী রাজনীতির প্রতি কোনো নস্টালজিয়া প্রকাশ করা নয়। ১৯৮০-এর দশক থেকে তারা ক্রমে ‘নিজের দায়িত্বে টিকে থাকা’ অর্থনীতি এবং সামরিক হস্তক্ষেপকে উৎসাহিত করেছে। এখন গণতান্ত্রিক আদর্শ আর জনপ্রিয় নয়। অতি চরমপন্থীদের নিয়ে আগের ঐকমত্য পড়েছে ভেঙে।
আটলান্টিকের দুই প্রান্তেই রাজনীতি ও প্রচারমাধ্যমে প্রকাশ্য বিদ্বেষ, ভুল তথ্য ছড়ানো এবং বিরোধীদের জাতির জন্য বিপজ্জনক শত্রু হিসেবে চিত্রিত করার মতো কাজ এখন সাধারণ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর শেষ কোথায়? এর কোনো সুস্পষ্ট উত্তর নেই। কারণ, মূলধারার ডানপন্থার সীমা এখন আর নিয়ন্ত্রিত নয়। মর্মান্তিক সত্য হলো পশ্চিমা বিশ্ব সম্ভবত এ ধরনের মতাদর্শের ফলাফল না দেখে এ থেকে মুক্তি পাবে না। সামনে এক ভয়াবহ হিসাব–নিকাশ অপেক্ষা করছে।
● ওয়েন জোন্স গার্ডিয়ান–এর কলাম লেখক
গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত