গাজায় যুদ্ধ চলছে। এই যুদ্ধ মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর সামনে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার সমুন্নত রাখার প্রশ্নে একটি নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। মুসলিম–অধ্যুষিত দেশের নাগরিকেরা তাঁদের সরকারগুলোকে বলে আসছেন, গাজায় যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হচ্ছে এবং সে কারণে ফিলিস্তিনিদের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাঁরা তাঁদের সরকারগুলোকে বলছেন, এ বিষয়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে। জনগণের সেই আহ্বানে এখন সেই সরকারগুলোর সাড়া দেওয়ার একটা সুযোগ তৈরি হয়েছে।
ইসরায়েল টানা ৮৫ দিন গাজায় বোমা ফেলে আট সহস্রাধিক শিশু, ছয় সহস্রাধিক নারীসহ ২২ হাজারের মতো ফিলিস্তিনিকে হত্যা করেছে। হাসপাতালসহ অগণিত ভবন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়ে ১৯ লাখ ফিলিস্তিনিকে ভিটেছাড়া করেছে। এ অবস্থায় জেনোসাইড কনভেনশনে (গণহত্যা সনদ) সই করা দেশ দক্ষিণ আফ্রিকা আন্তর্জাতিক বিচার আদালতকে (আইসিজে) ইসরায়েলের গণহত্যার অভিযোগকে খতিয়ে দেখার জন্য আবেদন জানিয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার নেওয়া এই দীর্ঘ-প্রতীক্ষিত পদক্ষেপটি আন্তর্জাতিক সংঘাত সমাধানে এবং মানবাধিকার সুরক্ষায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ভূমিকাকে এগিয়ে নেবে—এমনটাই মনে করা হচ্ছে। এই পটভূমিতে অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন (ওআইসি) এবং আরব লিগের সদস্যদেশগুলো এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ চৌমাথায় এসে দাঁড়িয়েছে।
আইসিজেতে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে দক্ষিণ আফ্রিকার আইনি পদক্ষেপ নেওয়াকে তারা সমর্থন দিয়ে আন্তর্জাতিক আইন ও ন্যায়বিচার সমুন্নত রাখায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে নাকি বরাবরের মতো গাজা ইস্যুতে নির্বিকার থাকবে, সেটি এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর চালানো গণহত্যার বিরুদ্ধে আইসিজেতে যখন গাম্বিয়া মামলা করেছিল, তখন আরব লিগ এবং ওআইসি পূর্ণাঙ্গ সমর্থন দিয়েছিল। একইভাবে দক্ষিণ আফ্রিকার এই আবেদনেও তাদের সমর্থন দেওয়া উচিত।
আইসিজের কাছে দক্ষিণ আফ্রিকা যে সূক্ষ্ম ও আইনগত ভিত্তিযুক্ত আবেদন করেছে, সেটি এই প্রভাবশালী দেশগুলোর সামনে ন্যায়বিচার সমর্থনের সুযোগ এনে দিয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকাকে সমর্থন দেওয়ার মাধ্যমে তারা রাজনৈতিক হস্তক্ষেপমুক্ত ও আইনিভাবে গঠিত ফোরামে গুরুতর অভিযোগগুলোকে স্পষ্ট করতে পারে।
আইসিজেতে দক্ষিণ আফ্রিকার এই আবেদনকে নিছক একটি অভিযোগ বলা যাবে না। এটি তার চেয়ে বেশি কিছু। এটি ৮৪ পৃষ্ঠার একটি বিশদ নথি, যা আইসিজের ওয়েবসাইটে রয়েছে। এটি যে কেউ চাইলে যখন ইচ্ছা পেতে পারে।
দক্ষিণ আফ্রিকার এই পদক্ষেপ কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে সহযোগিতার বহিঃপ্রকাশ কিংবা ইহুদিবিদ্বেষমূলক কাজ নয়। এটি জেনোসাইড কনভেনশনের বাধ্যবাধকতা পূরণের আবেদন। তবে ইসরায়েল বলছে, এটি নাকি সন্ত্রাসীদের সহযোগিতার নামান্তর।
আদতে এটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের নীতিগুলোর প্রতি দায়িত্ব পালনের অংশ। এই আবেদনের মধ্য দিয়ে আইসিজের হস্তক্ষেপ নিশ্চিত করা গেলে ইসরায়েলের হাতে আরও প্রাণহানি ঠেকানো সম্ভব হবে। কোনো রাষ্ট্রই যে আন্তর্জাতিক আইনের ঊর্ধ্বে নয়, এর মাধ্যমে সেটি প্রমাণ করা সম্ভব হবে।
ওআইসি ও আরব লিগের সদস্যদের সামনে বাক্সর্বস্ব ভূমিকার বাইরে কার্যকর কিছু করার সুযোগ এনে দিয়েছে।
প্রতিদিন টেলিভিশন স্ক্রিনে আমরা ইসরায়েলের মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের যেসব ছবি দেখি, তার বিরুদ্ধে এসব দেশের সরকারগুলো সরব হলে এবং আইসিজেতে দক্ষিণ আফ্রিকার নালিশ জানানোকে জোরেশোরে সমর্থন দিলে তারা তাদের জনগণের কাছে আগের চেয়ে আস্থাশীল হতে পারবে।
আইসিজে বাইরের চাপ থেকে মুক্ত থেকে স্বাধীনভাবে কাজ করে। দক্ষিণ আফ্রিকার আবেদনে ইসরায়েলের কোনো আপত্তি থাকলে তা আদালতে আইনি প্রক্রিয়ায় উপস্থাপন করা উচিত।
আইনি প্রক্রিয়ার বাইরে গিয়ে আদালতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা ন্যায়বিচার ও নিরপেক্ষতার নীতিগুলোকে দুর্বল করে। ইসরায়েল আইনি প্রক্রিয়াকে পাশ কাটিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার আবেদনের নিন্দা জানাচ্ছে। এ বিষয়টিকেও ওআইসি এবং আরব লিগের দেশগুলোকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে।
বিরোধ নিষ্পত্তিতে আন্তর্জাতিক আইনের প্রয়োগকে পুনরায় সংজ্ঞায়িত করতে পারে এবং বৈশ্বিক মঞ্চে ন্যায়বিচার ও জবাবদিহির নীতিগুলোকে সমুন্নত রাখতে পারে—এমন একটি ঐতিহাসিক আইনি প্রক্রিয়ার অংশ হওয়ার সুযোগ আরব দেশগুলোর সামনে এসেছে। এই সুযোগ তাদের হাতছাড়া করা উচিত হবে না।
● তাইয়েব আলী ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার অব জাস্টিস ফর প্যালেস্টিনিয়ানসের পরিচালক
মিডল ইস্ট আই থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনূদিত