কাজী হাবিবুল আউয়াল প্রধান নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিজের সফলতা কতটা প্রমাণ করতে পেরেছেন তা বিতর্কের বিষয়। তবে তিনি রাজনীতিক না হলেও ইতিমধ্যে রাজনীতির ভাষায় কথা বলার কৌশল রপ্ত করে ফেলেছেন।
আমাদের রাজনীতিকেরা সব সময় হাওয়া বুঝে কথা বলেন। কর্মী সমর্থক তথা দর্শক শ্রোতারা যা শুনতে পছন্দ করেন, তা বলে বাজিমাত করতে চান। তাঁরা এমনভাবে কথা বলেন, যাতে দলের বিবদমান দুই পক্ষই খুশি মনে ঘরে ফিরে যায়।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বক্তৃতা বিবৃতিতেও সে রকম চালাকি বা কৌশল আছে বলে অনেকে মনে করেন। কয়েক দিন আগেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও তার সহযোগী কমিশনারদের বলতে শুনেছি, রাজনৈতিক দলগুলোকে নির্বাচনে আনার বিষয়ে কমিশনের কিছুই করার নেই। নির্বাচনে কোন দল এল না এল সে নিয়ে তাদের মাথা ব্যথা নেই। রাজনৈতিক সংকট রাজনৈতিক নেতৃত্বকেই সমাধান করতে হবে।
সিইসি ও তাঁর সহযোগী কমিশনারদের এই বক্তব্য নৈতিকভাবে একেবারে অগ্রহণযোগ্য। আইনিভাবেও কতটা গ্রহণযোগ্য তা নিয়েও বিতর্ক আছে। নির্বাচন তো কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়। কমিশন তফসিল ঘোষণা করল, আর ভোটের দিন কাউকে বিজয়ী ঘোষণা করে দিল। নির্বাচন হলো জনগণের ইচ্ছের প্রতিফলন, প্রতিনিধি বাছাইয়ের উন্মুক্ত সুযোগ। সে ক্ষেত্রে যদি জনগণের বড় অংশের প্রতিনিধিত্ব করে এমন কোনো দল বা দলসমূহ নির্বাচনে অংশ না নেয়, সেটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হতে পারে না।
বর্তমানে বাংলাদেশে এমন কোনো দল নেই, যারা বলেছে, তারা নির্বাচনী ব্যবস্থায় বিশ্বাস করে না। আওয়ামী লীগ বলেছে, তারা সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। বিএনপি বলেছে, তারা সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলন করছে। তাহলে সমস্যাটি কোথায়, সেটাই আগে নির্বাচন কমিশনকে খতিয়ে দেখতে হবে। সমস্যার মূলে যেতে হবে। মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে এটাই প্রথম ও শেষ নির্বাচন নয়।
আইনের দৃষ্টিতে কোনো নির্বাচনকেই হয়তো অবৈধ বলা যাবে না, যদি কমিশন একবার গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করে দেয়। বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, বিরোধী দল বিএনপিসহ অনেক দলই চতুর্থ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। আওয়ামী লীগ, মহাজোটসঙ্গী জাতীয় পার্টি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের সহযাত্রী জামায়াতে ইসলামীসহ প্রায় সব দল ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করেছিল। এই নির্বাচনের পর গঠিত সংসদ তত্ত্বাবধায়ক সরকার আইনও পাস করে, যার ভিত্তিতে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় আসা সম্ভব হয়। তা সত্ত্বেও এই দুটি নির্বাচন জাতির কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি।
নির্বাচন কমিশন কী মনে করে? যদি তারা মনে করে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, তাহলে ২০১৪,২০১৮ কিংবা ১৯৯৬ (১৫ ফেব্রুয়ারি) ও ১৯৮৮ এর মতো আরও একটি নির্বাচন করার ঝুঁকি নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে এই কমিশনের নামও সাদেক-নুরুল হুদা-রকিব কমিশনের সঙ্গে যুক্ত হবে।
ওই দুটি নির্বাচন বর্জন করার পক্ষে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধান যুক্তি ছিল ক্ষমতাসীনেরা জয়ী হওয়ার জন্য প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে কাজে লাগিয়েছেন। অর্থাৎ সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বা মাঠ সমতল রাখা প্রয়োজন সেটা ছিল না। একই যুক্তিতে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট ২০০৭ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনও বর্জন করেছিল (যদিও ১ / ১১ এর পালাবদলের কারণে সেই নির্বাচনটি আর হয়নি)। জনগণের ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা ছিল না বলেই তারা বর্জন করেছিল। এবং যৌক্তিকভাবেই।
নির্বাচন কমিশন বলেছে, রাজনৈতিক বিরোধের মীমাংসা করা তাদের দায়িত্ব নয়। কিন্তু সেই বিরোধের উৎস যদি ভোট হয়, তাহলে সেই দায়িত্ব তারা এড়াবেন কীভাবে?
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচন দৃশ্যত ‘সুষ্ঠু’ হয়েছে, এ জন্য কমিশন বেশ আহ্লাদিত। কিন্তু সেই সুষ্ঠু নির্বাচনের পেছনে যে বড় অসুষ্ঠু ব্যাপার ছিল, তাও দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। নির্বাচন মানে প্রতিদ্বন্দ্বিতা, নির্বাচন মানে প্রতিযোগিতা। যেখানে এক বা একাধিক প্রতিযোগীকে বাইরে রেখে ভোট হয়, সেটাকে কোনোভাবে সুষ্ঠু বলা যেতে পারে না।
প্রতিযোগিতাহীন ভোট হলে পরিস্থিতি কী হয় সেটা নিশ্চয়ই নির্বাচন কমিশন ঢাকা-১৭ ও চট্টগ্রাম-১০ এর উপনির্বাচনে টের পেয়েছে। বাংলাদেশে মানুষ ভোটকে দেখে উৎসব হিসেবে, ২০০৮ সালের নির্বাচনে গড়ে ভোট পড়েছিল ৮৬ শতাংশ। আর দুই আসনের উপনির্বাচনে ১২ শতাংশেরও কম। এই ধারা চলতে থাকলে কোনো ভোটারকেই আর কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিতে হবে না। নির্বাচন কমিশনেরও দরকার হবে না।
মঙ্গলবার নির্বাচন কমিশনে ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠকের পর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল যে কথা বলেছেন, এরসঙ্গে তাঁর সাম্প্রতিক কথার মিল নেই। তাঁর ভাষ্য, ‘আমরা বলেছি, ওনারাও বিশ্বাস করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ডায়ালগ প্রয়োজন। ডায়ালগ ছাড়া এই সংকটগুলো আসলে রাজপথে মীমাংসা করার বিষয় নয়। কমিশন মনে করে, রাজনৈতিক দলগুলোর এক টেবিলে বসা উচিত, একসঙ্গে চা পান করা উচিত। তারপর আলোচনা করে সংকট নিরসনের চেষ্টা করা উচিত।’
সিইসি বলেন, ‘যে সংকট বিরাজ করছে, তা রাজনৈতিক। এর সঙ্গে আমাদের কাজের কোনো সংঘাত নেই। কিন্তু এ সমস্যাগুলো যদি রাজনৈতিকভাবে সমাধান হয়ে যায়, তাহলে আমাদের জন্য নির্বাচন আয়োজন অনেক কমফোর্টেবল হবে।’
নির্বাচনের বিষয়টি তো পুরোপুরি রাজনৈতিক। সংবিধান অনুযায়ী জনগণই সিদ্ধান্ত নেবে, কে রাষ্ট্র পরিচালনা করবে? সেখানে যদি কোনো দল বা পক্ষকে কৌশলে নির্বাচনের বাইরে রাখা হয়, তাহলে তো জনগণ স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হবে। তারা বহুর মধ্য থেকে একজনকে বেছে নিতে পারবে না।
নির্বাচন নিয়ে যে একটি রাজনৈতিক সংকট চলছে, সিইসি সেটা স্বীকার করেছেন। যেহেতু সংকটটি নির্বাচন নিয়ে, আর নির্বাচনটি করার দায়িত্ব কমিশনেরা তাহলে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের আগে তারা কীভাবে নির্বাচন করবেন? নির্বাচন করার জন্য যে সুষ্ঠু পরিবেশ দরকার সেটা তো তারা এখনো তৈরি করতে পারেনি।
রাজনৈতিক দলগুলোর এক টেবিলে বসা উচিত, চা খাওয়া উচিত—এমন বোধোদয় যথেষ্ট নয়। সিইসিকে এসব বলে থেমে থাকলেই হবে না। তিনি তো প্রতিযোগী দলগুলোকে চা পানের আমন্ত্রণ জানাতে পারেন। বলবেন, এর আগেও তারা আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কিন্তু বিএনপি আসেনি। কেন আসেনি। বিএনপি তো বলেছে, দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। বিএনপি আমলে আওয়ামী লীগও একই কথা বলেছিল এবং নির্দলীয় সরকারের দাবি আদায় করেছিল।
নির্বাচন কমিশন কী মনে করে? যদি তারা মনে করে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব, তাহলে ২০১৪,২০১৮ কিংবা ১৯৯৬ (১৫ ফেব্রুয়ারি) ও ১৯৮৮ এর মতো আরও একটি নির্বাচন করার ঝুঁকি নিতে পারে। সে ক্ষেত্রে এই কমিশনের নামও সাদেক-নুরুল হুদা-রকিব কমিশনের সঙ্গে যুক্ত হবে।
আর যদি সেটা না করে তাহলে তাদের স্পষ্ট করে বলতে হবে, ‘আগে আপনারা রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করুন। তারপর নির্বাচন হবে। আমরা কোনো সাজানো বা একতরফা নির্বাচনের অংশ হতে পারব না।’
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কবি। ই–মেইল: [email protected]