স্বাস্থ্য খাতকে সর্বদা বিভিন্ন রকম ইমার্জেন্সি বা জরুরি পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। কখনো করোনার মতো বৈশ্বিক মহামারি; কখনো ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া কিংবা ডায়রিয়ার মতো স্থানীয় অতিমারি; কখনো বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসসহ নানা প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি; আবার কখনো বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড, রানা প্লাজার মতো ভবন ধসে পড়া, লঞ্চডুবি কিংবা বাস-রেল দুর্ঘটনার ফলে সৃষ্ট জরুরি পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়।
এসব জরুরি পরিস্থিতির ধরনে যেমন পার্থক্য রয়েছে, তেমনি রয়েছে এর মাত্রাগত পার্থক্য। আবার এগুলোর ব্যবস্থাপনার ধরনও একটি থেকে অন্যটা ভিন্ন। যেমন ডেঙ্গু একটি নিয়মিত রোগ হলেও এ বছর ডেঙ্গু অতিমারি আকারে ধারণ করছে।
গত বছর সিলেটে প্রলয়ংকরী বন্যায় জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল। আবার এ বছরে গ্রীষ্মকালের শুরুতে ডায়রিয়ার একটি বড় প্রকোপ দেখা দিয়েছিল। আবার কখনো কোনো হাসপাতালের গুরুত্বপূর্ণ চিকিৎসা সরঞ্জামাদি বিকল হওয়ার ফলে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। যেমন সম্প্রতি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সিটি স্ক্যান যন্ত্র বিকল হওয়ার ফলে জরুরি স্বাস্থ্যসেবা ব্যাহত হয়েছিল। তাই এসব ইমার্জেন্সি অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য একদিকে যেমন প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদিসহ প্রশিক্ষিত এবং দক্ষ জনবল প্রয়োজন, অন্যদিকে সহজে খরচযোগ্য অর্থায়ন প্রয়োজন।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতে লাইন আইটেমভিত্তিক ‘পরিচালন’ বাজেটের পাশাপাশি বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য পাঁচ বছর মেয়াদি পরিকল্পনার আওতায় ‘অপারেশন প্ল্যান’ নামে সহজে ব্যয়যোগ্য একধরনের অর্থায়ন ব্যবস্থা প্রচলিত আছে, যেখানে ‘থোক’ বরাদ্দ আকারেও বাজেট প্রাপ্তির সুযোগ আছে। এই ব্যবস্থায় কোনো নির্দিষ্ট বছরে বরাদ্দকৃত অর্থ খরচ করতে না পারলে তা পাঁচ বছর মেয়াদের মধ্যে অন্য বছরে খরচ করার বিধান আছে। কিন্তু পরিচালন বাজেটের অর্থ জুন মাসের মধ্যে খরচ করতে না পারলে তা পরবর্তী বছরে খরচ করার সুযোগ থাকে না।
কোন বছরে কোন ধরনের এবং কোন মাত্রার জরুরি পরিস্থিতি দেখা দেবে, তা যেহেতু আগে থেকে জানার সুযোগ নেই; সেহেতু লাইন আইটেমভিত্তিক পরিচালন বাজেটে জরুরি পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য অর্থ বরাদ্দ করার সুযোগ নেই। তাই ‘ফ্লেক্সিবল ফাইন্যান্সিং’সহ একটি ‘ডেডিকেটেড প্রোগ্রাম’ ছাড়া এসব জরুরি পরিস্থিতি ভালোভাবে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়।
কিন্তু বর্তমানে এ ধরনের কোনো ডেডিকেটেড প্রোগ্রাম না থাকার কারণে যখন কোনো জরুরি পরিস্থিতির আবির্ভাব হয়, তখন তা ব্যবস্থাপনার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে নিদারুণ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। এ ধরনের ব্যবস্থা না থাকার কারণে করোনার প্রথম দিকে অর্থায়নের অভাবে আমাদের চরম মূল্য দিতে হয়েছে। অবশেষে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, ইউএসএআইডিসহ বিভিন্ন বিদেশি উন্নয়ন সহযোগীর কাছে হাত পাততে হয়েছে, যা একটি মধ্যম আয়ের দাবিদার দেশের জন্য কোনোভাবেই মানানসই নয়।
আবার উন্নয়ন সহযোগীদের থেকে প্রাপ্ত অর্থ যে শর্তমুক্ত হয় না, তা আমাদের কারও অজানা থাকার কথা নয়। তাই করোনাকালে ‘ইমার্জেন্সি রেসপন্স প্রোগ্রাম’ নামের একটি প্রোগ্রাম চালুর পরামর্শও দিয়েছিলাম। আমরা আশা করেছিলাম, স্বাস্থ্য খাতের পঞ্চম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার জন্য তৈরি করা কৌশলগত বিনিয়োগ পরিকল্পনা বা ‘স্ট্র্যাটেজিক ইনভেস্টমেন্ট প্ল্যান’–এ এটি প্রস্তাব করা হবে। কিন্তু ওই পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হলেও সেখানে এ ধরনের কর্মসূচি চালুর কোনো প্রস্তাব নেই। এখন ‘অপারেশন প্ল্যান’ প্রণয়নের কাজ চলছে এবং তা–ও প্রায় চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। কিন্তু ‘জরুরি অবস্থা’ মোকাবিলার জন্য কোনো অপারেশন প্ল্যান প্রণয়নের কথা শুনতে পাইনি।
এ বছর ডেঙ্গুর মহামারি রূপ ধারণ আবারও মনে করিয়ে দিচ্ছে এ ধরনের একটা ইমার্জেন্সি রেসপন্স প্রোগ্রাম কতটা জরুরি। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রতিদিন একঝাঁক তাজা প্রাণ ঝরছে। সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ১৩ আগস্ট পর্যন্ত মৃত্যুর সংখ্যা ৩৯৮, যার বেশির ভাগই জুলাই ও আগস্টে। প্রতিদিন মৃত্যুর সংখ্যা দশের ওপরে। ডেঙ্গুর এই তীব্র প্রকোপ অক্টোবর পর্যন্ত বিদ্যমান থাকতে পারে। আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন যেভাবে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে, তাতে মৃত্যুর সংখ্যা ১ হাজার কিংবা তার বেশি হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যুর হার এ বছরে ২০১৯ সালের তুলনায় প্রায় ৭ গুণ বেশি। তাঁদের প্রায় ৭০ শতাংশের বয়স ৩০ বছরের মধ্যে এবং ৮০ শতাংশের বয়স ৪০ বছরের মধ্যে। যাঁদের মধ্যে রয়েছেন সরকারি কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী, চিকিৎসক, প্রকৌশলী কিংবা খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ। ডেঙ্গুর হাত থেকে যেন কারও নিষ্কৃতি নেই। তাঁরা প্রত্যেকে ছিলেন একেকটি পরিবারের স্বপ্ন, আশা এবং ভরসা। তাঁদের মৃত্যুতে তাঁদের পরিবারের স্বপ্ন, আশা এবং ভরসা ভেঙে খান খান। কিন্তু তা নিয়ে আমাদের কি কোনো ভাবান্তর আছে?
টাকার অভাবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ এবং ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনার কাজ সঠিকভাবে করতে না পারার অসহায়ত্ব প্রকাশ পাচ্ছে। জরুরি মুহূর্তে স্বাস্থ্য খাতের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের এই অসহায়ত্ব দূর করতে প্রয়োজন ইমার্জেন্সি রেসপন্স প্রোগ্রাম। তাই স্বাস্থ্য খাতের নীতিনির্ধারণী মহল, বিশেষ করে স্বাস্থ্যসেবা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব, স্বাস্থ্যমন্ত্রী এবং পরিশেষে প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ করছি স্বাস্থ্য খাতে একটি ইমার্জেন্সি রেসপন্স প্রোগ্রাম চালু করুন, যা দিয়ে হাসপাতালে উদ্ভূত জরুরি পরিস্থিতিসহ স্বাস্থ্যসংক্রান্ত সব ধরনের জরুরি অবস্থা মোকাবিলার অর্থায়ন সহজে করা যাবে।
ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক