প্রথম আলোর প্রথম পৃষ্ঠায় (৩০ মে, ২০২৪) একটা ছবির দিকে তাকিয়ে আছি। খুলনার কয়রার দশালিয়া এলাকায় কপোতাক্ষ নদের পাড়ে সাধারণ মানুষ একটা ভেঙে যাওয়া বাঁধ নিজেরা মেরামতের চেষ্টা করছেন। শত শত মানুষ হাত লাগিয়েছেন। ঘূর্ণিঝড় রিমাল বাংলাদেশের অনেক অঞ্চলে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। জানমালের ক্ষতি হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন। খেতের ফসল নষ্ট হয়েছে। লোনাপানি ঢুকে পড়ায় এই সব জমিতে ভবিষ্যতে ফসল ফলানো কঠিন হয়ে পড়বে।
মাছের ঘের ভেসে গেছে। মানুষ মারা গেছে। গবাদিপশুর ক্ষতি হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে সরাসরি মারা গেছেন ১৫–১৬ জন। অতীতে এই দেশে ঘূর্ণিঝড়ে-জলোচ্ছ্বাসে লাখো মানুষ মারা গেছেন। সে প্রেক্ষাপটে আজকের ক্ষতিকে রবীন্দ্রনাথের কবিতার মতো সামান্য ক্ষতি বলে ফেলা হলে খুব বড় ভুল করা হবে। যার গেছে, তার সবই গেছে। যিনি মারা গেছেন, তাঁর তো পুরোটাই গেছে। তাঁর পরিবারের যে ক্ষতি, তা তো পাহাড়সমান। কিন্তু যাঁরা ঘরবাড়ি হারিয়েছেন, খেতের ফসল যাঁদের তলিয়ে গেছে, মাছের ঘের ভেসে গেছে, তাঁদের রইলটা কী?
যে ছবিটা দেখছি, তাতে বাঁধের যে অংশটা ভেসে গেছে, তার দৈর্ঘ্য মিটারে মাপা যাবে। এই ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধটাকে কি আগেই ঝুঁকিমুক্ত করা উচিত ছিল না? আমরা ঢাকায় বসে, টেবিল বা ক্যামেরার সামনে এই রকম বড় বড় কথা বলতে পারি। কিন্তু কপোতাক্ষ নদের মানুষ আমাদের মতো খালি কথায় চিড়া ভেজাচ্ছেন না। তাঁরা নিজেরা নেমে পড়েছেন। প্রথমে পানিতে তাঁরা খুঁটি পুঁতছেন দুই পাশে, সার করে। এরপর তার মধ্যে মাটি ভরছেন।
এখানে এসে বুক ভেঙে আসতে চায়। এই দেশের সাধারণ মানুষ এই রকম অপরাজেয়, এই রকম সংশপ্তক। এদের কি ডেকে বলব, ভাই ও বোনেরা, আপনারা যে বুকে আগলে বাঁধ রক্ষা করতে চাইছেন, আপনারা কি জানেন, আপনাদের এই বাঁধের নিচে অবিরাম ছিদ্র বানানো হচ্ছে? ইঁদুর আমাদের মাটির বাঁধগুলোর নিচে অসংখ্য ছিদ্র বানিয়ে রাখে, পানি বাড়লে বাঁধগুলো যে সহজেই ভেঙে যায়, তার একটা কারণ ইঁদুরের বানানো গর্ত। আমার এই তথ্য জানা থাকলে আপনারা এলাকার মানুষ, ভুক্তভোগী, আপনাদের এই তথ্য না জানার কোনোই কারণ নেই।
কিন্তু আমি ইঁদুরের কথা বলছি না। আমি বলছি মহাজাগতিক ইঁদুরের কথা। যারা দেখতে মানুষের মতো। সেই সব মানুষ, যাদের দাঁত ইঁদুরের চেয়েও ধারালো, যাদের হাঁ গন্ডারের হাঁ–এর চেয়েও বড়, যাদের ক্ষুধা অজগরের ক্ষুধার চেয়ে সহস্র গুণ বেশি। আপনাদের এই জীবনবাজি রেখে লড়াই করে দেশকে রক্ষার জন্য বাঁধ নির্মাণের মতো শত শত উদ্যোগ চেষ্টার নিচে তারা গর্ত বানাচ্ছে, বিশাল অজগরের মতো তারা গিলে খাচ্ছে সব উন্নয়নচেষ্টা, মানুষের সমুদয় উদ্যোগ।
বিদেশিদের বানানো একটা ইউটিউব ভিডিওর একটা দৃশ্য আমি ভুলতে পারি না। অস্ট্রেলিয়া থেকে আসা এক ফুড-ব্লগার আমাদের কারওয়ান বাজারের মাছের আড়ত দেখিয়ে ট্রেনে চড়ে চলে গেছেন ময়মনসিংহ। সেখানে মাছের চাষ দেখাবেন। এরপর তিনি উঠে পড়লেন লোকাল ট্রেনের ছাদে। একজন মাছের পোনা বিক্রেতার সঙ্গে। পোনা বিক্রেতা ময়মনসিংহের হ্যাচারি থেকে পোনা কিনে দুটো পাতিলে রেখেছেন, এরপর সেগুলো নিয়ে উঠে পড়েছেন ট্রেনের ছাদে। ট্রেন থেকে নেমে তিনি যাবেন একটা লোকালয়ের হাটে। সেখানে পোনা বিক্রি হবে। এই পুরোটা পথ এই ব্যবসায়ী সারাক্ষণ দুই পাতিলের পানি নাড়ছেন। তিনি যদি পানি নাড়া বন্ধ করেন, পোনা মারা যাবে। এক পলকের জন্যও তিনি পানি নাড়া বন্ধ করছেন না।
আপনারা কি জানেন, যখন আপনাদের এই অনুকরণীয় বাঁধ রক্ষাচেষ্টা আমাদের আশাবাদী করে, তখনই অন্য দেশের সরকারি কাগজে আমাদের দেশের বড় কর্তার দুর্নীতির বিবরণ প্রকাশিত হয় এবং তাঁর ও তাঁর পরিবারের ওপরে নিষেধাজ্ঞার খবর আমাদের পাঠ করতে হয়! আমাদের মুখ নিচু হয়ে যায়।
বাংলাদেশের গরিব মানুষ, সাধারণ মানুষ, কৃষক-শ্রমিক, আমাদের অভিবাসী শ্রমিকেরা, আমাদের গার্মেন্টসের মেয়েরা সারাক্ষণ পানি নাড়ছেন, যাতে পানিতে অক্সিজেন মিশতে পারে, যাতে বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ অক্সিজেন-বিহনে মারা না যায়। কী অমানুষিক এই পরিশ্রম। তাঁদের কারণে রেমিট্যান্স আসছে, তাঁদের কারণে পোশাকশিল্প ডলার আনছে, তাঁদের কারণে আমরা খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ, তাঁদের কারণে আমাদের মুখে ডিম-দুধ-মাছ উঠছে, তাঁদের কারণে বাজারভর্তি মৌসুমি ফল।
আর আমাদের ভদ্রলোকেরা সাধারণ মানুষের এই বিরামহীন অতন্দ্র অক্সিজেন সরবরাহচেষ্টা নামক বাঁধের নিচে লাগিয়ে রেখেছে কোটি কোটি ক্ষুধাতুর, ধূর্ত, তীক্ষ্ণ-দন্ত ইঁদুর। তারা মাটি কাটছে। তারা বাংলাকে ছোবড়া বানিয়ে ফেলছে।
এই বাস্তবতায় সাধারণ মানুষের এই লড়াই দেখলে শুধু মায়াই লাগে। প্রিয় লড়াকু দেশবাসী, আপনারা কি জানেন, আপনারা বাঁধে মাটি ফেলে ফেলে আমাদের লুটেরাদের পেটের মধ্যে ডলার ভরছেন। আপনি আপনার দুই কাঠার ভিটে যখন বাঁচাতে পারছেন না, তখন একজন সাবেক সরকারি অফিসার শত শত বিঘা জমি কিনে ফেলছে।
আপনারা কি জানেন, এই দেশে সর্বোচ্চ বেতন পান রাষ্ট্রপতি, তা ১ লাখ ২০ হাজার টাকা; আর সব সরকারি কর্মচারী এর চেয়ে কম বেতন পান। একজন পুলিশ কর্মকর্তা গড়ে ৬০ হাজার টাকা বেতন পেলে মাসে ১০ হাজারের বেশি সঞ্চয় করতে পারবেন বলে মনে হয় না। সে ক্ষেত্রে ২৫ বছর চাকরিতে তাঁর সর্বোচ্চ সঞ্চয় হওয়ার কথা ৩০ লাখ টাকা মাত্র। কিন্তু খবরের কাগজে যা লেখা হচ্ছে, তাতে মনে হচ্ছে, এঁরা প্রতিদিনই ৩০ লাখ টাকা খরচ করে থাকেন।
আপনারা কি জানেন, যখন আপনাদের এই অনুকরণীয় বাঁধ রক্ষাচেষ্টা আমাদের আশাবাদী করে, তখনই অন্য দেশের সরকারি কাগজে আমাদের দেশের বড় কর্তার দুর্নীতির বিবরণ প্রকাশিত হয় এবং তাঁর ও তাঁর পরিবারের ওপরে নিষেধাজ্ঞার খবর আমাদের পাঠ করতে হয়! আমাদের মুখ নিচু হয়ে যায়। আপনারা কি জানেন, আপনাদের এলাকার তিনবারের এমপি সম্পর্কে সোনা চোরাচালানসহ মারাত্মক সব অপকর্মের ফিরিস্তি বের হচ্ছে এবং তখনই সংগত প্রশ্ন বিজলির চমকের মতো আকাশ বিদীর্ণ করছে—এই মানুষ তিন তিনবার মনোনয়ন পান কী করে?
আপনারা বুকে আগলে বাঁধ বাঁচাবেন, দেশ বাঁচাবেন, আর এই তস্কর-রত্নাকর-মহাজাগতিক ইঁদুরেরা কোটি মানুষের সারা বছরের পরিশ্রমের অর্জন কলমের এক খোঁচায়, মোবাইলের এক কলে তুলে নিয়ে বিদেশে পাচার করে দেবে? তার ফলে, আপনার পানির দাম বাড়বে, আপনার বিদ্যুতের দাম বাড়বে, আপনার ডলারের দাম বাড়বে, আপনার জিনিসপাতির দাম বাড়বে; এবং এরা আপনার দুঃখ-দুর্দশাকেও পুঁজি করে আরেক দফা মুনাফা লুটে নেবে!
১৯৭৫ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে বঙ্গবন্ধু এক ভাষণে বলেছিলেন, ‘শিক্ষিতদের কাছে আমার একটা প্রশ্ন। আমি এই যে দুর্নীতির কথা বল্লাম, তা কারা করে? আমার কৃষক দুর্নীতিবাজ? না। আমার শ্রমিক? না। তাহলে ঘুষ খায় কারা? ব্ল্যাক মার্কেটিং করে কারা? বিদেশি এজেন্ট হয় কারা? বিদেশে টাকা চালান দেয় কারা? এই আমরা যারা শতকরা ৫ জন শিক্ষিত। এই আমাদের মধ্যেই রয়েছে ঘুষখোর, দুর্নীতিবাজ। আমাদের চরিত্রের সংশোধন করতে হবে, আত্মশুদ্ধি করতে হবে। দুর্নীতিবাজ এই শতকরা ৫ জনের মধ্যে, এর বাইরে নয়।’
হে কপোতাক্ষ নদতীরের লড়াকু মানুষ, আপনারা এই ৫ ভাগ দুর্নীতিবাজ আর তাঁদের তোষক-পালক-পোষকদের বিরুদ্ধে কিছুই করতে পারলেন না, পারবেন না। আপনারা মার খেয়েছেন, খেতেই থাকবেন। প্রকৃতির মার, জলবায়ুর মার, সিস্টেমের মার। বাঁধকাটা ইঁদুরের বিরুদ্ধে নিশ্চয়ই ব্যবস্থা নিতে পারবেন, কিন্তু এই মহাজাগতিক ইঁদুরের হাত থেকে আপনারা বাঁচবেন কী করে?
আনিসুল হক প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক ও সাহিত্যিক