ব্রিটিশ অথবা ফ্রান্সের রাজনীতিবিদদের মতো ওলাফ শলৎজের কোনো আড়ম্বর নেই। তিনি কোনো চমকও সৃষ্টি করতে পারেন না। হাসতে চেষ্টা করলে চোখ ছোট হয়ে যায়, এমন একজন মানুষ জার্মান চ্যান্সেলর। তিনিই অনমনীয় দৃঢ়তা দেখিয়ে গত রোববার বার্লিনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টকে স্বাগত জানিয়েছেন।
গত কয়েক দিন রোম থেকে প্যারিস হয়ে লন্ডন পর্যন্ত ইউরোপীয় নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে চলেছেন ভলোদিমির জেলেনস্কি। এর মধ্যে জার্মান সফরই তাঁর কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হবে। তাঁর বার্লিন সফরের প্রাক্কালে জার্মানি ইউক্রেনে সামরিক সহায়তা দ্বিগুণ করার ঘোষণা দেয়। শীতলতা ভেঙে জার্মানি এখন মোট ৫ বিলিয়ন ডলার সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এর ফলাফল যুদ্ধক্ষেত্রে ফলতে হয়তো কয়েক মাস সময় লেগে যাবে, কিন্তু ভূকৌশলনীতির বিবেচনায় এর তাৎক্ষণিক প্রভাব রয়েছে।
জেলেনস্কি ভালো করেই জানেন, রাশিয়া ২০১৪ ও ২০২২ সালে ইউক্রেনের যে পরিমাণ ভূখণ্ড দখল করে নিয়েছে, তা পুনরুদ্ধারের জন্য পাল্টা আক্রমণ চালানোর জন্য তার হাতে মাত্র ছয় থেকে আট মাসের মতো সময় আছে। জেলেনস্কি জানেন, এ বছরের মধ্যে তিনি যদি এ কাজটি করতে না পারেন, তাহলে আগামী বছর আরও বেশি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে।
ওলাফ শলৎজ দেখিয়ে দিলেন যে ইউক্রেন ইস্যুতে চীন, ফ্রান্স ও অন্যরা যে প্রদর্শনমূলক কূটনীতি চালিয়ে যাচ্ছে, সেটা প্রয়োজনীয় নয়। একই সঙ্গে তিনি এ ব্যাপারে যথেষ্ট সচেতন যে অনেক দেশের জনমত খুব নড়বড়ে অবস্থায় রয়েছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, ডোনাল্ড ট্রাম্প দৃশ্যপটে এলে যুদ্ধের গতিপথ কীভাবে পাল্টে যাবে, তা তিনি ভালো করেই দেখতে পাচ্ছেন।
শলৎজের চারপাশের লোকজন যুক্তি দিচ্ছেন তিনি যদি আরও যুদ্ধংদেহী হতে চান তাহলে জার্মানির জনগণকে তিনি সঙ্গে করে নিতে পারেন না। ইত্যবসরে তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নিরাপত্তাহুমকি ও ব্যবসার সুযোগ এই প্রহেলিকার মাঝেই শুধু রাশিয়ার সঙ্গে নয় চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
সে কারণেই ইউরোপ এবং বিশেষ করে জার্মানিতে ইউক্রেন ইস্যু নিয়ে বিতর্কটা এত গুরুত্বপূর্ণ। অতীত নিয়ে জার্মানরা গর্ববোধ করেন। সাম্প্রতিককালে, জার্মান সমাজের বিভিন্ন অংশে, বিশেষ করে শলৎজের সামাজিক গণতন্ত্রীদের মধ্যে একটি ভুল শিক্ষা চালু রয়েছে। শান্তিবাদীরা ‘আবার কখনো নয়’ এই শব্দবন্ধকে তাঁদের মতো ব্যাখ্যা করে নিয়ে বলেছেন, ‘আর কখনোই যুদ্ধ নয়।’ এমনকি স্বৈরশাসকদের সঙ্গেও সংঘাতের ক্ষেত্রেও এই নীতির কথা তাঁরা বলেন। ইরাক আগ্রাসনের ভয়াবহ পরিণতি এই ধারণাকে আরও জোরালো করেছে।
ইউক্রেন–রাশিয়া যুদ্ধ কয়েক প্রজন্মের সেই ধারণাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে। কিন্তু এ অবস্থানে পৌঁছাতে দুটি বড় ঘটনা প্রভাবকের ভূমিকা পালন করেছে। প্রথমটি হলো, ইউক্রেন পুতিনের আগ্রাসন শুরুর তিন দিন পর ওলাফ শলৎজের দেওয়া ভাষণ। সে সময় তিনি সামরিক খাতে জার্মানির নতুন দৃষ্টিভঙ্গি ঘোষণা করেন। জার্মানির সামরিক বাহিনীর উন্নয়নে আরও ১০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের ঘোষণা দেয়।
এত নাটকীয়ভাবে অবস্থান বদলের পর, জার্মান চ্যান্সেলর তাঁর দ্বিতীয় পদক্ষেপ ঘোষণার আগপর্যন্ত আবার খোলসে ঢুকে পড়েন। দলের ভেতর থেকেই পেছন থেকে ছুরি মারা হয় কি না, সেই ভয় ছিল তাঁর। ফলে ইউক্রেনের সঙ্গে সম্পর্ক এতটাই তিক্ত হয়ে ওঠে যে জার্মান প্রেসিডেস্ট ফ্রাঙ্ক-ভাল্টার স্টাইনমায়ারের কিয়েভ সফর শেষ মুহূর্তে বাতিল করতে হয়।
জেলেনস্কি জার্মান ছাড়া অন্য যে কারও কিয়েভ সফরকে উষ্ণ হৃদয়ে স্বাগত জানান। তাঁর অভিযোগ হলো, জার্মানির মতো অন্যতম বড় সামরিক সমর্থন দাতা দেশের সহযোগিতা তাঁরা ঠিকমতো পাচ্ছেন না। জার্মানি ইউক্রেনকে সামরিক খাতে ২ বিলিয়ন ডলারের বেশি সামরিক সমর্থন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। সমস্যা হলো, খুব কৃপণের মতো দেওয়া সেই প্রতিশ্রুতি খুব ধীরে ছাড় করা হচ্ছিল।
গেল শরতে জার্মানির তৈরি করা লিওপার্ড–২ ট্যাংক সরবরাহ নিয়ে অচলাবস্থা চরমে পৌঁছায়। সে সময় শলৎজ শুধু ট্যাংক পাঠাতে অস্বীকৃতি জানাননি, অন্য দেশ যাতে ইউক্রেনে লিওপার্ড–২ ট্যাংক পাঠাতে না পারে, সে জন্য পুনঃ রপ্তানির লাইসেন্স স্থগিত করেন।
সুতরাং কী এমন ঘটল যে জার্মানি সেই অবস্থান বদল করল? অবশ্য সাম্প্রতিক মাসগুলোয় এমন কিছু ঘটনা ঘটেছে, যাতে করে মনে হচ্ছিল জার্মানি ও ইউক্রেনের মধ্যকার সম্পর্ক পরিবর্তন হচ্ছে। প্রথমটি হলো, বরিস পিস্টোরিয়াসকে তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। ন্যাটো জোটে জার্মানি প্রধান একটি সামরিক ক্রীড়নক হিসেবে আবির্ভূত হতে চাইছে সে সময় দায়িত্ব পেয়েছেন বরিস।
গত সপ্তাহে একটি সম্মেলনে জার্মানির শীর্ষ কূটনীতিক থমাস বাগা বলেছেন, ‘আমাদের দেশ সবচেয়ে বড় ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার পর এখন ঠিক পথেই চলছে।’ ইউক্রেনের জন্য নতুন করে ৩ বিলিয়ন ডলার সহায়তা প্যাকেজ ঘোষণাকালে পিস্টোরিয়াস বলেন, ‘জার্মানি তাদের পক্ষ থেকে যত দিন পর্যন্ত প্রয়োজন তত দিন পর্যন্ত ইউক্রেন সহায়তা করে যাবে।
শলৎজের চারপাশের লোকজন যুক্তি দিচ্ছেন তিনি যদি আরও যুদ্ধংদেহী হতে চান তাহলে জার্মানির জনগণকে তিনি সঙ্গে করে নিতে পারেন না। ইত্যবসরে তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নিরাপত্তাহুমকি ও ব্যবসার সুযোগ এই প্রহেলিকার মাঝেই শুধু রাশিয়ার সঙ্গে নয় চীনের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।
রোববার সন্ধ্যায় মধ্যযুগের সুন্দর শহর আখেনে ইউরোপীয় মেধা পুরস্কার দেওয়া হয় জেলেনস্কিকে। এ সময় দেওয়া বক্তব্যে তিনি যুদ্ধ নিয়ে শুধু বলেননি, ইউরোপীয় ইউনিয়নে ইউক্রেনের অবস্থানের কথাও বলেন।
এ কারণেই এ যুদ্ধে অনেক বড় যদির পরও ইউক্রেন যদি জেতে তাহলে দেশটির সবচেয়ে বড় অর্জন হবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে যুক্ত হতে পারা। এবং সে ক্ষেত্রে জার্মানি, ফ্রান্স ও পোল্যান্ডের ভূমিকা হবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জন ক্যাম্পফার লেখক ও সম্প্রচারকর্মী
দ্যগার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত