২০২৩ সালের গ্রীষ্মে যখন ইতিহাসের এক অসহ্য দাবদাহে পুড়ছি আমরা, দেশের বাজার তখন অধিক উত্তপ্ত। প্রকৃতির ক্রুদ্ধ পরিবেশে জনদুর্ভোগ আরও বাড়িয়ে দিয়েছে ভয়াবহ বিদ্যুৎ–সংকট। মুদ্রাস্ফীতির পরিসংখ্যানের আড়ালে জীবনযাপনের পদে পদে অধিকাংশ মানুষের নীরব সঙ্গী এখন অর্থকষ্ট, যেখানে নতুন কর্ম ও আয়রোজগারের সুযোগ অপ্রতুল। স্বপ্ন দেখতে ভয় পায় মানুষ।
কেন আজকের এ অবস্থা? কোথায়, কখন, কীভাবে এর শুরু, কিংবা কে দায়ী—এসব বিতর্ক কিছুক্ষণের জন্য দূরে সরিয়ে রেখেও বলা যায়, জাতীয় অর্থনৈতিক ও ব্যবস্থাপনার সংকট আজ একটি বাস্তব পরিস্থিতি। তবে এর চেয়েও দীর্ঘমেয়াদি সংকট হলো দেশের নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে। অর্থনীতি যে রাজনীতি ও মানবিক অধিকারের ঊর্ধ্বে নয়, তা মানুষ জীবন দিয়ে টের পাচ্ছে। অথচ ক্ষমতার দ্বন্দ্ব এবং নির্বাচন নিয়ে নানা বাহাসের মধ্যে হারিয়ে যাচ্ছে একটি মৌলিক প্রশ্ন—ভোট দেওয়া কি বাংলাদেশের জনগণের অধিকার নয়?
সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থার অনুপস্থিতি সত্ত্বেও গত তিন থেকে চার দশকের রাজনৈতিক ঐকমত্য হচ্ছে—কেউই নির্বাচনে কারচুপি চান না, অন্তত জনসমক্ষে ও ভদ্র মহলে। ছলে-বলে-কৌশলে ক্ষমতায় যাওয়া বা থাকাটা কাউকে জনপ্রিয় বৈধতা দেয় না, উজ্জ্বল ভাবমূর্তি তো বহু দূরের কথা।
আজকের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট যে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ভোটারবিহীন মেকি নির্বাচনের পরিণতি, সেটি আজ এক নিষ্ঠুর সত্য। কার্যকর জনপ্রতিনিধিত্ব, সুশাসন ও ন্যায়বিচারের পরিবেশ থাকলে জাতি কী সুফল পেতে পারত, তা এই লেখায় নতুন করে আবিষ্কার করার দরকার নেই। বাংলাদেশের জন্য এখন পর্যন্ত পরীক্ষিত উন্নয়নের মন্ত্র হচ্ছে, গণতান্ত্রিক নির্বাচন ও জবাবদিহিমূলক সরকারব্যবস্থা।
তাত্ত্বিকভাবে বর্তমানে মাঠে থাকা সব রাজনৈতিক দলই নির্বাচনমুখী। চীনের মতো কমিউনিস্ট পার্টিকেন্দ্রিক দেশ যেমন বাংলাদেশ নয়, রাজনীতিকদেরও নিশ্চয়ই সিরিয়ার বাশার আল–আসাদের অনুসারী হওয়ার কথা নয়। ক্ষমতায় যাওয়ার উদ্দেশ্য এবং এমনকি ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই প্রতিটি দলের জন্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ নিশ্চিত করতে অবদান রাখা অপরিহার্য।
সুতরাং দেশের যেসব রাজনৈতিক দল বিশেষ করে ক্ষমতার দাবিদারেরা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে যে দুশ্চিন্তায় (!) পড়েছেন, তার প্রথমত কোনো গণভিত্তি নেই। প্রতিযোগী দলগুলো জনগণের রায় মানতে রাজি থাকলে কে আটকাবে তাদের, তা একেবারেই বোধগম্য নয়। আপনি যদি রাজতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্রের প্রতিনিধি না হন, তাহলে নির্বাচনী খেলার নিয়ম তো সবাই মিলেই ঠিক করার কথা, নিজে নিজে নয়।
এ দেশের মানুষ যে ভোট দিতে প্রবলভাবে আগ্রহী, তা নিয়ে কারও সন্দেহ থাকার কারণ নেই। একই কারণে ‘ক্ষমতাসীন-বিরোধী’ ধারাও কার্যকর থাকে নির্বাচনে। এই ভয় আসলে দল হিসেবে আপনার রক্ষাকবচও বটে, যদি আপনি ভবিষ্যৎ সুযোগের চিন্তা করেন। আর জনগণকে ভয় পেলে নির্বাচনমুখী রাজনীতি করাটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে দাঁড়ায়। মনে রাখা দরকার, যে চেতনা নিয়ে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল, সেটিও কিন্তু গণতন্ত্র।
গণতান্ত্রিক নির্বাচন নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে আলোচনা করতে হচ্ছে সম্ভবত এ জন্য যে, অগণতান্ত্রিক নির্বাচনও একটি পদ্ধতি, কারও কারও বিবেচনায়। তাহলে ভেবে দেখুন তো আপনি কি কোনোভাবেই বাংলাদেশের জনগণের পক্ষের মানুষ?
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নাগরিকদের ভোট দেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে কি না, সেটি ইনিয়ে-বিনিয়ে টেলিভিশন বিতর্কের বিষয় হবে কোন অধিকারে! যাঁরা সংবিধান মানেন, তাঁরা ধারা–৭ তো জানেন, যাতে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। সেই মালিকদের প্রাপ্য, তাদের প্রতিনিধি পছন্দ করার সুযোগ এবং তাতে দ্বিমত থাকার নৈতিক অধিকার কারও নেই।
সে ধরনের রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যবস্থা জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি মীমাংসিত বিষয়। এর ঐতিহাসিক দৃষ্টান্তও রয়েছে। সেগুলো হলো: স্বৈরাচারী এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিন জোটের রূপরেখা ও পরবর্তীকালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থার অধীন চারটি (১৯৯১, ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮) মোটামুটিভাবে গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন।
এসব নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পরিবর্তন হয়েছিল এবং নির্বাচিত সংসদ দেশে-বিদেশে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিল। এর অন্যথা যখনই হয়েছে সরকারকে অভ্যন্তরীণ কায়েমি স্বার্থের সঙ্গে এবং আন্তরাষ্ট্রীয় দর-কষাকষিতে আপস করতে হয়েছে অনেক বেশি।
বাইরের শক্তি যদি গণতান্ত্রিক নির্বাচনের শর্ত জুড়ে দেয়, সেটা আমাদের জাতীয় দেউলিয়াত্বই প্রকাশ করে। একই সঙ্গে আমরা জানি এটা কতটা জনপ্রিয় ইস্যু। আপনি যদি গণ-অধিকারের বিপক্ষে কথা বলতে বা অবস্থান নিতে না চান, তাহলে অর্থপূর্ণ আলোচনার সুযোগ থাকে আপনার সামনে। দেশের ভেতরে যদি অচলাবস্থা দীর্ঘায়িত করার ইচ্ছা কারও না থাকে, বিশ্বদরবারে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবেই পরিচিতি পেতে পারি আমরা।
দেশের বাইরের শুভাকাঙ্ক্ষীরা যা–ই বলুন না কেন, গত দুটি নির্বাচনের ভ্রান্তি যেন জাতিকে আবার পেয়ে না বসে, সেটা কি কাম্য নয়? যেহেতু অতীতে ফিরে যাওয়া যায় না, তাই ২০১৪ বা ২০১৮ সালের ইতিহাস পরিবর্তন করতে পারবে না কেউই। কিন্তু অতীত ভুলের সংশোধন তো করা যেতেই পারে। সেই সাহস আর সদিচ্ছা কি দেখাতে পারবেন প্রতিপক্ষের রাজনীতিকেরা?
এ ক্ষেত্রে সংলাপ হতে পারে সমাধানের কার্যকর পথ। তবে ‘রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই’—এ জাতীয় পুরোনো যুক্তি যদি উপস্থাপন করা হয়, আলোচনা কিয়ামত পর্যন্ত চললেও বা জাতিসংঘের মহাসচিবের নেতৃত্বে আলোচনা হলেও তাতে অগ্রগতির সম্ভাবনা কম।
এতে অ্যাজেন্ডা হতে হবে জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগ, সাংবিধানিক সংস্কার, জাতীয় সমঝোতা, পেশাদার আমলাতন্ত্র, গণমুখী বিচারব্যবস্থা, মুক্ত গণমাধ্যম ও প্রতিদিনের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণের মতো বিষয়গুলো। আগামীর বাংলাদেশ এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রতিষ্ঠান গড়ার অঙ্গীকার আলোচনায় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
সুখী দেশ, ডিজিটাল সুবিধাদি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, বিচারপ্রাপ্তি, ব্যবসার পরিবেশ, দুর্নীতি, অর্থ পাচার রোধ ইত্যাদি বিষয়ের সূচকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দেশের কিশোর-যুবকদের গর্বিত করে না। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে তাঁদের দরকার একটি মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ, যেখানে তাঁরা বিস্তারিতভাবে চিন্তা করতে পারবে। বাংলাদেশ স্বপ্নের প্রজ্বলন ঘটতে পারে প্রত্যেক নাগরিকের উত্থানের মধ্য দিয়ে। গণতন্ত্র ব্যক্তিকে সেই বিকাশের সুযোগ দেয়, যা আমাদের সন্তানদের অবচেতন মনের প্রত্যাশা।
আজকাল অনেক তরুণ তাঁরা কখনো ভোট দিতে পারবেন কি না তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জার এবং শঙ্কার। এ মুহূর্তে ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সী প্রজন্মের জন্য আগামী জাতীয় সংসদ একটি বিশেষ মাত্রা যোগ করতে পারে।
সুখী দেশ, ডিজিটাল সুবিধাদি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, বিচারপ্রাপ্তি, ব্যবসার পরিবেশ, দুর্নীতি, অর্থ পাচার রোধ ইত্যাদি বিষয়ের সূচকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান দেশের কিশোর-যুবকদের গর্বিত করে না। এ অবস্থা থেকে পরিত্রাণ পেতে তাঁদের দরকার একটি মুক্ত গণতান্ত্রিক পরিবেশ, যেখানে তাঁরা বিস্তারিতভাবে চিন্তা করতে পারবে। বাংলাদেশ স্বপ্নের প্রজ্বলন ঘটতে পারে প্রত্যেক নাগরিকের উত্থানের মধ্য দিয়ে। গণতন্ত্র ব্যক্তিকে সেই বিকাশের সুযোগ দেয়, যা আমাদের সন্তানদের অবচেতন মনের প্রত্যাশা।
আজকের নেতৃত্ব ও রাজনীতিকেরা চাইলে সম্মিলিতভাবেই সেই ভবিষ্যৎ গড়তে অবদান রাখতে পারেন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, কোন বাংলাদেশ উপহার দেবেন বা রেখে যাবেন তাঁদের বংশধরদের জন্য। আজকের কর্মই তাঁদের পরিচয় করিয়ে দেবে আগামী প্রজন্মের সঙ্গে। কোনো সমীক্ষা ছাড়াই চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা যায়, আজকের বাংলাদেশে মানুষ গণতন্ত্র বিনির্মাণের প্রত্যাশাই করছে।
খাজা মাঈন উদ্দিন সাংবাদিক