ইউরোপে কর্মসংস্থানের আশায় বাংলাদেশের তরুণদের ঝুঁকি নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। আর এভাবে ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত্যু বা নিখোঁজের ঘটনাও ঘটছে নিয়মিত।
সর্বশেষ ৯ আগস্ট রাতে লিবিয়া হয়ে ইতালি যাওয়ার পথে ভূমধ্যসাগরে নৌকাডুবির ঘটনায় নিখোঁজ হয়েছেন নরসিংদীর বেলাব উপজেলার ৯ তরুণ। এর আগে ২৪ জুন লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি যাওয়ার পথে স্পিডবোট ডুবে নরসিংদীর এক তরুণের মৃত্যু হয় এবং নিখোঁজ হন আরও ১৩ তরুণ।
দেশে এক যুগের বেশি সময় ধরে হাজার হাজার কোটি টাকার অবকাঠামো নির্মাণের কাজ হয়েছে। টাকার অঙ্কে জিডিপি ও মাথাপিছু আয়ও বেড়েছে। ক্ষমতাসীন সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা বিভিন্ন সময় দাবি করেছেন, অর্থনৈতিক উন্নয়নে বাংলাদেশ সিঙ্গাপুর কিংবা মালয়েশিয়াকে ছাড়িয়ে গেছে।
কিন্তু এ দেশের শ্রমজীবী তরুণেরা নিশ্চিত ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে পারেন—এ রকম কোনো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা কি গড়ে উঠেছে? ব্যয়বহুল অবকাঠামোকেন্দ্রিক উন্নয়নের ডামাডোলের মধ্যেও মারাত্মক ঝুঁকি নিয়ে, এমনকি নৌকায় করে সাগর পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশের তরুণদের ধারাবাহিক বিদেশ গমনের পরিসংখ্যান তো ভিন্ন কথা বলে।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার (আইওএম) বরাতে বণিক বার্তার প্রতিবেদন অনুসারে, লিবিয়া হয়ে ভূমধ্যসাগরের ঝুঁকিপূর্ণ পথে নৌকায় করে ইতালিগামী বাংলাদেশি অভিবাসীর সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। ২০১৯ সালে এই পথে অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে বাংলাদেশি ছিল ৫ শতাংশ, ২০২১ সাল শেষে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ শতাংশ এবং ২০২২ সাল শেষে তা ১৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
এই অভিবাসনপ্রত্যাশীরা তুরস্ক, মিসর বা মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ হয়ে প্রথমে আফ্রিকার গৃহযুদ্ধবিপর্যস্ত দেশ লিবিয়ায় যান, তারপর লিবিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর হয়ে ইতালির পথে যাত্রা করেন।
আইওএমের হিসাব অনুযায়ী, ২০২২ সালে ইতালিতে এ পথ ধরে প্রবেশ করেছেন ১৫ হাজার ২২৮ বাংলাদেশি। আগের বছর এ সংখ্যা ছিল ৭ হাজার ৮৩৮। বর্তমানে ইতালিমুখী ‘বোট পিপলের’ উৎস দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অবস্থান তৃতীয়।
ভূমধ্যসাগরীয় রুটের পর বাংলাদেশিরা বেশি ব্যবহার করেন বলকান রুট। গত কয়েক বছরে এ রুট দিয়ে ছয় হাজারের বেশি বাংলাদেশি ইউরোপে গেছেন। এভাবে ঢুকতে গিয়ে বসনিয়ার জঙ্গলে বাংলাদেশিদের আটকে থাকার ঘটনাও ঘটেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, ভূমধ্যসাগর, জঙ্গল আর মরুভূমি পেরিয়ে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি তরুণ কেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবে অভিবাসী হতে চাইছেন। কেউ কেউ দাবি করেন, দারিদ্র্য বা রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে বাংলাদেশ থেকে এসব অভিবাসন হচ্ছে না, এটি হচ্ছে মূলত উচ্চাকাঙ্ক্ষা থেকে।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, এই তরুণেরা দেশের ভেতরে যদি ভালো কর্মসংস্থানের সুযোগ পেতেন, যদি সুন্দরভাবে বাঁচার মতো আয়ের সুযোগ পেতেন, যদি তাঁদের কর্মস্থলগুলো নিরাপদ হতো, তাহলে তাঁরা এ রকম মরিয়া হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সাগর পাড়ি দিতেন? এ প্রশ্নের উত্তরের জন্য আমরা সংবাদমাধ্যমে আসা কয়েকজন অভিবাসনপ্রত্যাশীর প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার দ্বারস্থ হতে পারি।
শরীয়তপুরের জুমন আহমেদ প্রথমে আকাশপথে দুবাই হয়ে তুরস্ক যান, তারপর তুরস্ক থেকে লিবিয়া হয়ে বিপৎসংকুল ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালি পৌঁছান। এই ঝুঁকিপূর্ণ যাত্রার আগে জুমন আহমেদ মিরপুরের একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে চাকরি করতেন। প্রায় তিন বছরে সেখানে কোনো নিয়োগপত্র দেওয়া হয়নি তাঁকে। বেতনও পেতেন মালিকের ইচ্ছেমতো। তিনি বণিক বার্তাকে জানান, কেবল উচ্চমাধ্যমিকের গণ্ডি পার হওয়ায় চাইলেও চাকরি পরিবর্তন করতে পারছিলেন না। সে কারণেই ঝুঁকিপূর্ণ অভিবাসনের সিদ্ধান্ত নেন।
সার্বিয়া হয়ে ইতালিগামী বাংলাদেশি অভিবাসনপ্রত্যাশী তরুণ আরাফাত রহমান ইনফোমাইগ্রেন্টস নামের অভিবাসনবিষয়ক একটি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, সরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে নিম্ন বেতনের কম্পিউটার অপারেটরের চাকরির জন্য বিপুল পরিমাণ ঘুষ দেওয়ার বদলে সেই টাকা খরচ করে ইতালি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।
বাংলাদেশের তরুণ শ্রমজীবীদের জন্য দেশের ভেতর যত দিন পর্যন্ত মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান, ভালোভাবে বাঁচার মতো মজুরি ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা না যাবে, তত দিন পর্যন্ত এই ভূমধ্যসাগরের পথে ঝুঁকিপূর্ণ ইউরোপ-যাত্রা বন্ধ হবে না।
২০১৯ সালে নৌকায় করে লিবিয়া থেকে ইতালি যাওয়ার পথে নৌকা ডুবে মারা যাওয়া সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার তরুণ খোকন আহমেদ কেন এই ঝুঁকি নিয়েছিলেন? ডয়চে ভেলের কাছে খোকনের ভাই লিটনের দেওয়া বক্তব্য থেকে জানা যায়, তাঁদের দোকানদার বাবা পাঁচ বেকার সন্তানের মধ্যে তুলনামূলক শিক্ষিত খোকনকে ভালো কর্মসংস্থানের প্রত্যাশায় দোকান বন্ধক রেখে টাকা ধার করে ইতালির পথে পাঠান।
এ রকম আরও দৃষ্টান্ত রয়েছে। মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছলতা অর্জনের আকাঙ্ক্ষা থাকবেই। চিরকাল কেউ নিম্ন মজুরির কঠোর শ্রমের কাজে আটকে থাকতে চায় না। দেশের ভেতরে প্রত্যাশা অনুযায়ী কাজের সুযোগ না থাকলে দেশের বাইরে গিয়ে হলেও সে তা অর্জন করতে চাইবে। সচ্ছল জীবনের প্রতি মানুষের চিরন্তন এই আকাঙ্ক্ষাকে ‘অতি লোভ’ হিসেবে নেতিবাচকভাবে দেখা উচিত নয়।
বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার ১১ হাজারেও বেশি অভিবাসনপ্রত্যাশীর ওপর জাতিসংঘের অভিবাসী-বিষয়ক সংস্থা আইওএমের এক জরিপ থেকে দেখা যায়, ৭৩ শতাংশের বিদেশ যেতে চাওয়ার কারণ হলো ভালো কর্মসংস্থান ও উন্নত জীবন-জীবিকার প্রত্যাশা। অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে ঋণগ্রস্ততা, সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধির আকাঙ্ক্ষা, দেশে কোনো ভবিষ্যৎ না থাকা ইত্যাদি। শুধু তা-ই নয়, ৯১ শতাংশ অভিবাসনপ্রত্যাশীই জানিয়েছেন, দেশে কর্মসংস্থানের সুযোগ ও মান বৃদ্ধি পেলে তাঁরা বিদেশে যাবেন না। অভিবাসনপ্রত্যাশীদের মধ্যে যাঁরা ইউরোপ-আমেরিকা যেতে চান, তাঁদের বেশির ভাগই (৬৭%) উচ্চমাধ্যমিক পর্যায় বা তার চেয়ে বেশি শিক্ষিত।
সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত অভিবাসনপ্রত্যাশীদের এ রকম বিভিন্ন অভিজ্ঞতা ও নানা জরিপের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে বোঝা যায়, মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোনো মোটামুটি শিক্ষিত তরুণদের অনেকেই দেশের ভেতর এমন কোনো কর্মসংস্থান পান না, যার মাধ্যমে স্বাচ্ছন্দ্যময় ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করা যাবে। ফলে অনেক সময় ঝুঁকি জেনেও সাগর বা জঙ্গল পেরিয়ে ইউরোপের পথে যাত্রা করেন।
আবার অভিবাসী হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয় যাওয়া শ্রমিকেরাও অনেক সময় কঠোর পরিশ্রম করেও প্রত্যাশা অনুযায়ী আয় করতে না পেরে আরেকটু ভালো আয়ের আশায় ইউরোপে যাওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠেন।
বাংলাদেশের তরুণ শ্রমজীবীদের জন্য দেশের ভেতর যত দিন পর্যন্ত মানসম্পন্ন কর্মসংস্থান, ভালোভাবে বাঁচার মতো মজুরি ও নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা না যাবে, তত দিন পর্যন্ত এই ভূমধ্যসাগরের পথে ঝুঁকিপূর্ণ ইউরোপ-যাত্রা বন্ধ হবে না।
কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক। প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘বাংলাদেশে উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি’, ‘ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ, নজরদারি পুঁজিবাদ ও মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ভবিষ্যৎ।’ ই-মেইল: [email protected]