প্রতিবছরের মতো ২০২৪ সালেও ১০ ডিসেম্বর আমরা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস পালন করছি। কিন্তু বিগত বছরগুলোর তুলনায় এই বছরের প্রেক্ষাপট একেবারেই ভিন্ন। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে রাজনৈতিক সরকার নেই। জুলাই মাসের গণ–অভ্যুত্থানে স্বৈরাচার হয়ে ওঠা একটি সরকারের পতন হয়েছে। দেশের সংবিধান ও আইনের সঙ্গে মানবাধিকারের বিষয়টি সরাসরি জড়িত। আর আইন ও সংবিধানের প্রয়োগ যেহেতু সরকারের দায়িত্ব, তাই মানবাধিকার পরিস্থিতি পর্যালোচনায় সরকারের বিষয়টি এসেই যায়।
বিগত সরকারের শাসনকালে দেশের জনগণের সভা-সমাবেশের অধিকার, স্বাধীন ও নির্ভয়ে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, জীবনের নিরাপত্তাসহ নানা সাংবিধানিক ও আইনি অধিকার হুমকির সম্মুখীন হচ্ছিল। সরকারের শেষ সময়েও তারা এই অধিকারগুলো সংকোচনের মাধ্যমে ক্ষমতা ধরে রাখার চেষ্টা করেছিল। দেশের জনগণের অভূতপূর্ব সম্মিলিত উত্থান ও এই অধিকারগুলোরই সম্মিলিত প্রয়োগের মাধ্যমে আমরা স্বৈরাচার সরকারের বিদায় দেখেছি।
মানুষের সব অধিকারের বুনিয়াদি অধিকার হলো জীবনধারণের অধিকার। এই অধিকার সুরক্ষিত না হলে বাকি অধিকারগুলো নিরর্থক হয়ে পড়ে। বিগত বছরগুলোতে আমরা জীবনধারণের অধিকারের ওপর আঘাত আসতে দেখেছি। বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও জোরপূর্বক অন্তর্ধান বা গুমের ব্যাপক অভিযোগ ছিল।
এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর যুক্তরাষ্ট্র সরকারের নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরপরই পরিস্থিতির বিস্ময়কর উন্নতি আমরা দেখতে পাই। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুম প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে আসে। এই বিষয়গুলো নিয়ে মানবাধিকারকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরেই সোচ্চার ছিলেন। যেই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হলো সেটা বাংলাদেশের জন্য সম্মানজনক না হলেও অবস্থার পরিবর্তন আমাদের জন্য স্বস্তিদায়ক।
বর্তমান সরকার গুমের ঘটনাগুলো তদন্তের জন্য একটি কমিশন করেছে। এই কমিশন এখন পর্যন্ত জনসমক্ষে যেটুকু তথ্য জানিয়েছে, তা রোমহর্ষক। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিকদের ওপর এই ধরনের পাশবিক নির্যাতন মেনে নেওয়া কষ্টকর। কমিশনের কাজের পর আমরা আরও বিস্তারিত জানতে পারব বলে আশা করি।
এখানে উল্লেখ্য, এসব তথ্য জানা আমাদের জন্য যেমন জরুরি, তেমনি এসব ঘটনার বিচার হওয়াও বেশি জরুরি। আমরা আশা করি, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সরকার এ ঘটনাগুলোর বিচারের যথাযথ পদক্ষেপ নেবে। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের অভিযোগগুলো নিয়েও আমরা একই ধরনের কমিশন ও ঘটনাগুলোর বিচার চাই। বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও গুমের ঘটনাগুলোর সঙ্গে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত জড়িত বলেই প্রতীয়মান হয়। তাই এই ঘটনাগুলোর পুনরাবৃত্তি যেন না হয়, সেই বিষয়ে আমরা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকেও অঙ্গীকার পেতে চাই।
আসকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে বেশ কিছু অভিযোগ জানানো হয়েছিল। কিন্তু এসব অভিযোগের বিষয়ে অগ্রগতি কখনোই জানা যায়নি। উচ্চ আদালত থেকে মানবাধিকার বিষয়ে অনেক ইতিবাচক রায় অতীতে পাওয়া গিয়েছিল। এই রায়গুলোকে আইনের ভাষায় ‘জুডিশিয়াল একটিভিজম’ বলা হয়। এগুলোর মাধ্যমে আমাদের সাংবিধানিক ও মানবাধিকারবিষয়ক আইন সমৃদ্ধ হয়েছে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে অল্প সময়ে সবচেয়ে বেশি এবং ভয়াবহতম মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলো আমরা দেখেছি জুলাই অভ্যুত্থানের সময়। এই সময়ে জনগণের ওপর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাত্রাতিরিক্ত বলপ্রয়োগ, সভা-সমাবেশে বিধিনিষেধ আরোপ, ইন্টারনেট বন্ধ ও যোগাযোগে বিঘ্ন ঘটানো এবং যথেচ্ছ গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এখন পর্যন্ত এই অভ্যুত্থানে মোট ৯০৮ জনের প্রাণহানির বিষয়ে তথ্য পেয়েছে।
এর মধ্যে ৭৫৯ জনের পরিচয় জানা গেছে আর ১৪৯ জনের পরিচয় এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এই সময়ে আহত হওয়ার সংখ্যা কয়েক হাজার বলে অনুমান করা যায়। জুলাই অভ্যুত্থানে বিশেষত নিজ বাসায় গুলিতে শিশুদের মৃত্যুর ঘটনাগুলো অত্যন্ত মর্মান্তিক। এই সময়ে শিশু অর্থাৎ ১৮ বছরের কম বয়সী ১২৮ জন মারা গেছে। এসব ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত দোষী ব্যক্তিদের বিচার হওয়া প্রয়োজন।
জুলাই অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আমরা গণপিটুনিতে হত্যা ও গণ–মামলার প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পেতে দেখেছি। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের ভিত্তিতে আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের তৈরি করা হিসাবমতে, আগস্ট মাসে ২১ জন, সেপ্টেম্বরে ২৮ জন, অক্টোবর মাসে ১৯ জন গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা যান। এই প্রবণতা বন্ধ হওয়া জরুরি। এ ছাড়া এই সময়ে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর বেশ কয়েকটি আক্রমণের ঘটনাও ঘটেছে।
গণহারে মামলা ও তাতে পাইকারি হারে আসামি করার উদ্বেগজনক প্রবণতা সাম্প্রতিক সময়ে কমে এসেছে। এসব মামলাতে সাংবাদিকদের আসামি করার প্রবণতা দেখা গেছে। এ ছাড়া গণহারে সাংবাদিকদের প্রেস অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড বাতিল হতে দেখা গেছে। ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর আক্রমণ করা নিয়ে মানবাধিকারকর্মীরা বিগত শাসক গোষ্ঠীর নিয়মিত সমালোচনা করতেন। এই ধরনের কাজ আমরা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে আর দেখতে চাই না।
বাংলাদেশ অনেক দিক থেকে উন্নতি করলেও নারীর প্রতি সহিংসতার ঘটনাগুলো আমাদের হতাশ করে। টালমাটাল রাজনৈতিক পরিস্থিতিতেও নারীর প্রতি সহিংসতার খবর আমরা পেয়েছি। আসকের তথ্য সংরক্ষণ ইউনিটের হিসাবমতে, অক্টোবরে মোট ৪৫ জন নারী সহিংসতার শিকার হয়েছেন, ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৭ জন, দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৯ জন আর যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন ১৪ জন।
এ ছাড়া অনলাইনে যৌন ও অন্যান্য ধরনের হয়রানির শিকার নারী অধিকারের ক্ষেত্রে নতুন হুমকি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ দৃশ্যমানভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাঁদের জন্য নিরাপদ ঘর ও কর্মস্থল নিশ্চিত করা আমাদের সবার দায়িত্ব।
বাংলাদেশে আমরা একটি জাতীয় মানবাধিকার কমিশন পেয়েছি। কিন্তু এই কমিশনের তেমন কোনো কর্মকাণ্ডই আমরা দেখিনি। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোতে মানবাধিকার কমিশনের কোনো দৃশ্যমান, কার্যকর ও প্রভাব বিস্তারকারী কোনো কাজ বা হস্তক্ষেপের উদাহরণ পাওয়া মুশকিল।
আসকের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে বেশ কিছু অভিযোগ জানানো হয়েছিল। কিন্তু এসব অভিযোগের বিষয়ে অগ্রগতি কখনোই জানা যায়নি। উচ্চ আদালত থেকে মানবাধিকার বিষয়ে অনেক ইতিবাচক রায় অতীতে পাওয়া গিয়েছিল। এই রায়গুলোকে আইনের ভাষায় ‘জুডিশিয়াল একটিভিজম’ বলা হয়। এগুলোর মাধ্যমে আমাদের সাংবিধানিক ও মানবাধিকারবিষয়ক আইন সমৃদ্ধ হয়েছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য, সাম্প্রতিক অতীতে জুডিশিয়াল কর্মকাণ্ড অনেকটাই হারিয়ে গিয়ে আমাদের আদালত অনেকটাই আমলাতান্ত্রিক হয়ে গিয়েছিল। আর মানবাধিকার কমিশন থেকে আমরা একটিভিজম কখনোই দেখিনি। বরং এটি সব সময়ই আমলাতান্ত্রিক ছিল। আগামীর বাংলাদেশে আমলাতান্ত্রিকতা ও দাতা সংস্থার কাছে অগ্রগতির মাইলফলক তুলে ধরার বেড়াজাল থেকে বেরিয়ে এসে আমরা একটি একটিভিস্ট মানবাধিকার কমিশন পেতে চাই। বর্তমান সময়ে বিভিন্ন বিষয়ে সংস্কারের জন্য আমরা অনেক কমিশনকে কাজ করতে দেখছি।
দুঃখজনকভাবে আমরা জাতীয় মানবাধিকার কমিশন নিয়ে কোনো আলাপ বা উদ্যোগ কিছুই দেখছি না। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে একটি সাংবিধানিক সংস্থায় রূপান্তর করাও প্রয়োজন।
সার্বিকভাবে বাংলাদেশে আমরা আইনের শাসন ও দেশের সাধারণ মানুষের অধিকার সমুন্নত দেখতে চাই। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় বিচারহীনতা ও ভয়ের সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসা প্রয়োজন। এই জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও অঙ্গীকার অপরিহার্য। সামনের দিনগুলোতে সব রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে তাদের অঙ্গীকার ও কর্মপরিকল্পনা আমরা শুনতে চাই। জনবান্ধব সরকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম শর্ত মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল সরকার।
মাবরুক মোহাম্মদ উপদেষ্টা, আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)