চারদিকে শোরগোল। নির্বাচন হবে। খুব ঝামেলায় না পড়লে পাঁচ বছর পরপর এই একটা টুর্নামেন্ট ঘিরে আমাদের প্রবল আগ্রহ আর কৌতূহল। মাঠে খেলেন রাজনীতিবিদেরা। তাঁরা নানা ক্লাবের হয়ে খেলেন বা ভাড়া খাটেন। ভিআইপি গ্যালারিতে নাটাই ধরে আর টাকার থলে হাতে বসে থাকেন এক দল ব্যবসায়ী।
তাঁরা নিয়ন্ত্রণ করেন ক্লাবগুলো। সেখানে খেলোয়াড় বেচাকেনা হয়। কখনো কখনো পুরো একটা ক্লাবই বিক্রি হয়ে যায়। আমরা দেখেছি, ২০১৪ সালে একটা ক্লাব এভাবে বিক্রি হয়ে গিয়েছিল। ওই ক্লাবের মালিককে একটা হাসপাতালে আটকে রেখে এই বন্দোবস্ত হয়েছিল।
টুর্নামেন্ট শুরুর আর বেশি দিন বাকি নেই। ইতিমধ্যে গা-গরম শুরু হয়ে গেছে। চলছে গিবত, খিস্তি, কলতলার ঝগড়া। যার জিবে যতটুকু বিষ আছে, সব উগরে দিচ্ছে। চ্যাম্পিয়নশিপের দৌড়ে শেষতক দুটি দল আছে বা থাকে। তারা ফাইনাল খেলবে। সবাই সেটা জানেন। তারা তাদের লাঠি-সড়কি-কোচ-বল্লমে শাণ দিচ্ছে।
আমরা দেখেছি, আজকাল খেলায় বেশ কারচুপি হয়। রেফারি কোনো একটা ক্লাবের পক্ষে বা অন্য ক্লাবের বিপক্ষে ইচ্ছেমতো বাঁশি বাজিয়ে দেন। এ নিয়ে হইচই, মারপিট হয়। অনেক দর্শক চেঁচিয়ে বলেন, রেফারি চোট্টা। বিক্ষুব্ধ খেলোয়াড় বা দর্শকের হাতে রেফারির পিটুনি খাওয়ার দৃশ্য আমরা অনেক দেখেছি। এ জন্য দাবি ওঠে নিরপেক্ষ রেফারির। এখন আমরা সব বড় টুর্নামেন্টে ভিন দেশের রেফারিকে খেলা পরিচালনা করতে দেখি। এটা সব পক্ষই মেনে নিয়েছে। এ নিয়ে কেউ বলে না যে ‘হস্তক্ষেপ’ হচ্ছে। ‘হস্তক্ষেপ’ হয় তখন, যখন এক পক্ষ সেটা মানে এবং আরেক পক্ষ সেটা মানে না। মুখে না বললেও তাদের মন্ত্র হলো সালিস মানি, তবে তালগাছটা আমার।
আগামী ডিসেম্বর বা জানুয়ারিতে যে নির্বাচনী খেলা হতে যাচ্ছে, তার রেফারি হলো নির্বাচন কমিশন। তাদের নিয়ে কথা উঠেছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা একচোখা, বিশেষ ক্লাবের প্রতি তাদের পক্ষপাত আছে। সবাই জানেন, রেফারির হাত-পা বাঁধা। তাঁর নিয়োগ হয়েছে একটি ক্লাবের পছন্দে। ওই ক্লাব বাঁশিতে যেভাবে ফুঁ দেবে, রেফারির বাঁশি সেভাবেই বাজবে। সে জন্য ক্লাব-নিরপেক্ষ রেফারির কথা উঠেছে।
এদিকে টুর্নামেন্টের ডঙ্কা বেজে উঠেছে। যে করেই হোক, ট্রফিটা আমার চাই। অর্থ–বিত্ত, মান-ইজ্জত, জীবন-মরণ সবই এই ট্রফিকে ঘিরে। এটা ঘরে তুলতেই হবে। তো এই খেলাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে প্রচার-প্রোপাগান্ডা। প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবগুলো তাদের কৌশল আঁচল-আস্তিনের ভেতরে রেখে দিয়েছে। কীভাবে আক্রমণ শাণাবে, মধ্যমাঠ দখলে রাখবে আর গোলপোস্ট বাঁচাবে, তা নিয়ে চলছে সলাপরামর্শ আর হিসাব–নিকাশ। এক ক্লাবের কৌশল অন্য ক্লাব জানে না। আন্দাজের ওপর নির্ভর করে তারা শূন্যে ঢিল ছুড়ছে।
ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রায়ই দেখতাম, খেলা চলাকালে মাথা গরম খেলোয়াড়েরা একে অপরের সঙ্গে ঠেলাঠেলি-মারামারি করে। সাইডলাইনের বাইরে পুলিশ মজুত থাকে। তারা রেফারি না ডাকলে মাঠের ভেতরে ঢোকে না। রেফারি তাদের ডাকার ফুরসত পায় না। তার আগেই হয়তো কোনো খেলোয়াড়ের ঘুষি খেয়ে মাঠে পড়ে যায়, কিংবা জান বাঁচাতে প্যাভিলিয়নের দিকে ভোঁ–দৌড় দেয়। দেখা যায়, ক্লাবগুলোর সামনে রেফারিও অসহায়। প্রশ্ন হলো, রেফারির মনে সাহস বাড়ানো যায় কীভাবে?
অনেক বছর আগের কথা। তখন আগা খান গোল্ডকাপ টুর্নামেন্ট হতো ঢাকায়। এটা ছিল পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় আন্তক্লাব ফুটবল টুর্নামেন্ট। পাকিস্তানের সব প্রদেশের নামী ক্লাবগুলোর বাঘা বাঘা খেলোয়াড় ঢাকা স্টেডিয়ামের মাঠ দাপিয়ে বেড়াতেন। ওই সময় ইন্দোনেশিয়ার একটি ক্লাব নিয়মিত অংশ নিত এই টুর্নামেন্টে।
আমরা জানতাম, কোনো ক্লাব পরপর তিনবার কাপ জিতলে, অর্থাৎ চ্যাম্পিয়ন হলে সোনার কাপটা তার হয়ে যাবে। দেখা গেল, ইন্দোনেশিয়ার ক্লাবটা পরপর দুবার চ্যাম্পিয়ন হয়ে গেল। তৃতীয়বার তারা ফাইনালে মুখোমুখি হলো ঢাকার একটি ক্লাবের। এটা ১৯৭০ সালের কথা। ঢাকার কোন ক্লাবটি তা আমার ঠিক স্মরণে নেই। হয় মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব অথবা ইপিআইডিসি।
খেলার হাফ টাইম পার হওয়ার পর বেধে যায় গোলমাল। আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগে একটা ফ্রি–কিক বা লাল-হলুদ কার্ড দেখানো হলো পরাক্রমশালী দুই ক্লাবের কোনো একটির খেলোয়াড়কে। আর যায় কোথায়। আগুনে ঘি পড়ল। গ্যালারি আগেই তেতে উঠেছিল। এবার জ্বলে উঠল আগুন। ঢিলাঢিলি, হাতাহাতি, মারামারি। ইপিআরের মাউন্ট পুলিশ দিয়েও বিক্ষুব্ধ জনতাকে ঠেকিয়ে রাখা গেল না। ফলে চারজন নিহত, শতাধিক আহত। খেলা পণ্ড। ক্লাবের সমর্থক দর্শকেরা মারামারি করে নিজেদের হাত-পা ভাঙল, মরল। কোনো খেলোয়াড়ের গায়ে আঁচড়ও লাগল না।
আগামী ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে যে খেলা হবে, তাতে আমরা যারা আমজনতা, আমরা হলাম গ্যালারির দর্শক। আমরা একটা ভালো খেলা দেখতে চাই, যেখানে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। কিন্তু আমরা সবাই ক্লাবনিরপেক্ষ নই। আমরা চাই আমাদের পছন্দের ক্লাব জিতুক। কীভাবে জিতল, সেটা বড় কথা নয়। যেভাবেই হোক জিততে হবে। খেলা পণ্ড হলে কুরুক্ষেত্র হয়ে যাবে। অনেকের হাত-পা ভাঙবে, জান যাবে, দোকানপাট আর ঘরবাড়ি পুড়বে। কে মরল, তাতে ক্লাবের কিচ্ছু যায়–আসে না। গদির লড়াই বড় লড়াই। এ লড়াইয়ে পিছু হটা বা হেরে যাওয়ার মানে হলো আত্মহত্যা, ‘স্বর্গ হইতে বিদায়’।
আমাদের দেশে এখন বড় বড় খেলায় আমরা বিদেশ থেকে রেফারি নিয়ে আসি। এ নিয়ে কেউ আপত্তি তোলেন না। কিন্তু নির্বাচনের বেলায় এটা মেনে নেওয়া কষ্টের। আমাদের সার্বভৌমত্ব বলে একটা কথা আছে না! সেখানে কালির ছিটা লাগে। তাহলে উপায় কী?
বছরের পর বছর কাপ জিতে কোনো ক্লাব যদি টুর্নামেন্টের মালিকানা দাবি করে বসে, অন্যরা তা মানবে কেন? সে জন্য দাবি উঠেছে, রেফারি বদলাও। এখন যে রেফারি আছে, সে বর্ণচোরা। তাকে আর বিশ্বাস নেই। হয় দেশের ভেতর থেকে ভালো রেফারি খুঁজে বের করো, নয়তো বিদেশ থেকে নিয়ে আসো।
আমরা ইতিমধ্যে জানান দিয়ে দিয়েছি, আমরা সার্বভৌমত্ব-অন্তঃ জাতি। না খেয়ে থাকি, জান যায় যাক, তবু সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিতে পারি না। দেশে কি রেফারির আকাল পড়েছে যে ভিনদেশ থেকে রেফারি আনতে হবে? সুতরাং দেশেই খুঁজতে হবে বিকল্প রেফারি, যে দুই চোখ খোলা রেখে খেলা দেখবে ও বাঁশি বাজাবে এবং সব খেলোয়াড় তার কথা শুনবে। না শুনলে শাস্তি পাবে। শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে ক্লাবের তাঁবুর দিকে তাকাবে না।
ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রায়ই দেখতাম, খেলা চলাকালে মাথা গরম খেলোয়াড়েরা একে অপরের সঙ্গে ঠেলাঠেলি-মারামারি করে। সাইডলাইনের বাইরে পুলিশ মজুত থাকে। তারা রেফারি না ডাকলে মাঠের ভেতরে ঢোকে না। রেফারি তাদের ডাকার ফুরসত পায় না। তার আগেই হয়তো কোনো খেলোয়াড়ের ঘুষি খেয়ে মাঠে পড়ে যায়, কিংবা জান বাঁচাতে প্যাভিলিয়নের দিকে ভোঁ–দৌড় দেয়। দেখা যায়, ক্লাবগুলোর সামনে রেফারিও অসহায়। প্রশ্ন হলো, রেফারির মনে সাহস বাড়ানো যায় কীভাবে?
টুর্নামেন্টের আর বেশি দিন বাকি নেই। বেশ কিছুদিন ধরে খেলোয়াড়দের মুখে একটা কথা শোনা যাচ্ছে—খেলা হবে। আমরা অপেক্ষায় আছি। এই সঙ্গে ইশপের গল্পের সেই মরালটাও মনে পড়ছে, তোমাদের কাছে যাহা খেলা, আমাদের কাছে তাহা মৃত্যু।
মহিউদ্দিন আহমদ লেখক ও গবেষক