জাতিসংঘের ১৯৩টি সদস্যরাষ্ট্র ২০২৪ সালের মধ্যে প্লাস্টিক দূষণ বন্ধে একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি সম্পাদনে সক্ষম হয়। ২০২২ সালে সম্পাদিত এ চুক্তি ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইফলক। তবে প্লাস্টিক দূষণের বিষয়টি তত্ত্বগতভাবে একটি চিহ্নিত সমস্যা হলেও তা বন্ধে বাংলাদেশ কী করতে পারে, সে প্রশ্ন থেকেই যায়। দেশজুড়ে আশঙ্কাজনক হারে প্লাস্টিক বর্জ্য জমতে থাকলেও এ দূষণ রোধে বাংলাদেশের উল্লেখযোগ্য কোনো পদক্ষেপ বা কর্মসূচি নেই।
এ ক্ষেত্রে ২০০২ সালে পলিথিন ব্যাগের ব্যবহার বন্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে এ ধরনের কর্মসূচি প্রথম শুরু হয়। প্রথম দিকে একে একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ মনে হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি তেমন কার্যকর হয়নি। কারণ, যথাযথ বিকল্প উপায় না থাকাসহ এ ধরনের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ না থাকলে শুধু নির্দেশ দেওয়া এবং নিয়ন্ত্রণ করার মতো কৌশল প্রায়ই কোনো কাজে লাগে না।
এ ক্ষেত্রে পলিথিন ব্যাগের উৎপাদন ও ব্যবহার বন্ধ করতে বাংলাদেশে মূলত বাজারভিত্তিক কৌশলের প্রয়োজন। কারণ, পলিথিন ব্যাগ ব্যবহারের ক্ষেত্রে বর্তমানে বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও ২০২২ অর্থবছরে সব ধরনের প্লাস্টিক বা পলিথিন ব্যাগের ওপর থেকে ৫ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক প্রত্যাহার করা হয়। এটি একই সঙ্গে চক্রাকার অর্থনীতি (সার্কুলার ইকোনমি) কার্যকরের ক্ষেত্রে যেমন একটি বড় বাধা, তেমনি এর মধ্য দিয়ে প্লাস্টিক দূষণ রোধ করাও অনেক কঠিন হয়ে পড়ছে।
বাংলাদেশ যদিও অনেক উন্নত দেশের তুলনায় কম প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন করে, কিন্তু এ ধরনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে দেশটির যে অনিয়ম, তা সত্যিই আশঙ্কাজনক। কারণ, সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নিয়ম অনুসরণ করে এসব প্লাস্টিক বর্জ্য অপসারণ করা হয় না। রাজধানী ঢাকার ক্ষেত্রে এমনকি অর্ধেক প্লাস্টিক বর্জ্যও সঠিক ব্যবস্থাপনার আওতায় আনা হয় না। আর বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকাগুলোর ক্ষেত্রে এ হার প্রায় ৮৯ শতাংশ।
২০০৫ সালে বছরে মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ৩ কেজি, যা ২০২০ সালে বেড়ে হয়েছে ৯ কেজি। শুধু ঢাকায়ই প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ ২০০৫ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে প্রায় দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। পাতলা প্লাস্টিকের মোড়ক, কফির কাপ, ঢাকনা ও চামচ, রান্নাঘরের তৈজসপত্র, স্ট্র, কাপ, বোতল ও পলিথিন ব্যাগ—এ সবকিছুই মূলত বর্তমানে বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে প্লাস্টিক দূষণের বড় উৎস।
দেশের শহরগুলোয় যত্রতত্র প্লাস্টিকের পণ্য ফেলার কারণে একদিকে যেমন পরিবেশদূষণ হচ্ছে, তেমনি ঢাকার খালগুলো পরিণত হচ্ছে ভাগাড়ে। এ কারণে পানি নিষ্কাশনের পথ আটকে গিয়ে একটু বৃষ্টিতেই শহরগুলোয় তৈরি হচ্ছে ভয়াবহ জলাবদ্ধতা। তবে এর মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক হচ্ছে, এসব প্লাস্টিক বর্জ্য সমুদ্রের তলদেশের জীববৈচিত্র্যও ধ্বংস করছে। এটি আবার আমাদের খাদ্যচক্রের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব ফেলছে। কারণ, নদী ও সমুদ্রের মাছ এসব দূষণের ফলে নানা ধরনের ক্ষতির শিকার হচ্ছে। এসব মাছ যখন আমরা খাবার হিসেবে গ্রহণ করি, তখন বিষাক্ত প্লাস্টিক কণা আমাদের শরীরেও প্রবেশ করে, যা শেষ পর্যন্ত আমাদের নানা রকম রোগের ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেয়।
ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণার সংস্পর্শে আসা এসব মাছ বাংলাদেশের মানুষের খাওয়ার অনুপযোগী হয়ে পড়ছে। এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব না হলে দীর্ঘ মেয়াদে তা দেশটির অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ, অন্যান্য অংশীদার দেশ, যারা বিদেশে মাছ রপ্তানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান (স্যানিটারি অ্যান্ড ফাইটোস্যানিটারি) শর্তগুলো মেনে চলে, তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকা সম্ভব হবে না।
এ ছাড়া প্লাস্টিক বর্জ্য শোধনের খরচের বিষয়টি স্থানীয় সরকার ও পৌরসভাগুলোর জন্য একটি বাড়তি চাপ। ফলে প্রায় সময়ই সিটি করপোরেশনের বাজেটের একটি বড় অংশই দেখা যায় এ কাজে খরচ করতে হয়। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের (এমওইএফসিসি) ২০২০ সালের সংশোধিত মোট বাজেটের প্রায় ৩০ শতাংশই বরাদ্দ ছিল প্লাস্টিক বর্জ্য পরিশোধন খাতের জন্য।
এসব বর্জ্য পরিশোধনের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ ক্রমেই বাড়ছে। প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করাবিষয়ক চুক্তি নিয়ে ২০২৩ সালের ২ জুন প্যারিসে জাতিসংঘের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। চলতি বছরের নভেম্বরে কেনিয়ায় আরেকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে এবং এর আগেই জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্রগুলো ‘জিরো-ড্রাফট’ তৈরির বিষয়ে সম্মত হয়।
দেশের জনগণকে রোগ থেকে সুরক্ষিত রাখা এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে বাংলাদেশকে অবশ্যই এ সমস্যার দিকে নজর দিতে হবে এবং প্লাস্টিক দূষণ রোধে বিশ্বে নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা পালন করতে হবে। এ ক্ষেত্রে শহরের রাস্তাঘাট থেকে প্লাস্টিক বর্জ্য অপসারণে সরকারকে সুচিন্তিত ও বাস্তবসম্মত কৌশল গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত, প্লাস্টিক বর্জ্য নিয়ে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করাটা জরুরি।
এ ক্ষেত্রে বাসাবাড়ি থেকে ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহ করার প্রক্রিয়ার মধ্যেই কম ময়লা প্লাস্টিক রিসাইক্লিং প্ল্যান্টে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থার সমন্বয় ঘটানো যেতে পারে। এ ছাড়া সিটি করপোরেশনকে প্লাস্টিক উৎপাদনকারী এবং বর্জ্য হিসেবে প্লাস্টিক সংগ্রহকারীদের মধ্যে এমন একটি নেটওয়ার্ক তৈরি করে দিতে হবে, যেন তাঁরা রিসাইকেল করার জন্য বেশি পরিমাণ ও সমধরনের প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করতে পারেন।
এভাবে প্লাস্টিক রিসাইক্লিংয়ের গতি বাড়বে। এ ছাড়া একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক পণ্যের বর্জ্য সংগ্রহ ও রিসাইক্লিং সহজ করতে সরকারের সঙ্গে বেসরকারি উদ্যোগের সমন্বয় ঘটাতে হবে। এর মধ্য দিয়ে একই সঙ্গে প্লাস্টিক বর্জ্যের সঠিক অপসারণসহ বর্জ্য সংগ্রহকারীদেরও বাড়তি একটি আয়ের উৎস তৈরি হবে। তবে এ ক্ষেত্রে উৎপাদকদের এমনভাবে প্লাস্টিক পণ্য তৈরি করতে হবে যেন তা একই সঙ্গে টেকসই হয় এবং তা রিসাইকেল করা সহজ হয়। এটি একই সঙ্গে যেমন রিসাইকেল করার প্রক্রিয়াকে সহজ করবে, তেমনি সিটি করপোরেশনের পক্ষেও প্লাস্টিক বর্জ্য কার্যকরভাবে অপসারণ করা সম্ভব হবে।
‘হ্রাসকরণ, পুনর্ব্যবহার ও পুনরুৎপাদন’ একটি জনপ্রিয় ধারণা; তবে প্লাস্টিক দূষণের ক্ষেত্রে এ ধারণার কিছুটা পরিমার্জনা দরকার। এ ক্ষেত্রে নতুন করে আরও প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনের পরিবর্তে সঠিকভাবে প্লাস্টিক বর্জ্য অপসারণ ও রিসাইক্লিংয়ের মাধ্যমে বাজারে এর বিদ্যমান চাহিদা মেটানোর ধারা তৈরি করা দরকার। এ ছাড়া প্লাস্টিক পণ্যের কার্যকর ও সাশ্রয়ী বিকল্প পণ্য উদ্ভাবন করতে হবে। এর জন্য বাংলাদেশকে আবারও অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে এবং প্লাস্টিকমুক্ত দেশ হিসেবে নিজেদের গড়ে তোলার দায়িত্ব নিতে হবে।
ফাহমিদা খাতুন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক
আফরিন মাহবুব সিপিডির প্রকল্প সহযোগী (গবেষণা)