প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ে আগামী বছর থেকে নতুন কারিকুলাম প্রবর্তন করা হবে। তার মানে নতুন শিক্ষাব্যবস্থা। নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়নে শুরুতে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন বই দেওয়া হবে। মাধ্যমিক স্তরে সব শ্রেণিতে নতুন কারিকুলাম বাস্তবায়ন করতে ২০২৫ সাল পর্যন্ত সময় লাগবে। গণমাধ্যমে জানতে পারলাম, নতুন কারিকুলামে সৃজনশীল প্রশ্ন থাকছে না, সেখানে অন্য রকমের প্রশ্নপত্র হবে। এটা কতটুকু যৌক্তিক। কোনো সমস্যা হলে তা সমাধানের পন্থা খুঁজে বের করতে হবে। গাছে পোকা ধরেছে মানে গাছ কেটে ফেলতে হবে, এ রকম নয়। তাই প্রশ্নপদ্ধতিতে সমস্যা দেখা দিচ্ছে মানে এই পদ্ধতি বাদ দেওয়া ভালো কোনো সমাধান নয়।
সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি শিক্ষার্থীদের নতুন কিছু শেখাতে সহায়তা করে। শিক্ষার্থীদের মনে নতুন নতুন চিন্তা জাগ্রত করতে কাজে আসে। কারণ, আমরা যখন প্রাথমিকে পড়তাম, সবই ছিল প্রায় মুখস্থবিদ্যানির্ভর। মুখস্থবিদ্যানির্ভরতা দিয়ে শিক্ষার্থীদের চিন্তার জগৎ বিকশিত হয় না। শিক্ষার্থীদের মনের বিকাশের জন্য সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি সরকারের যুগান্তকারী পদক্ষেপ, যা ছিল প্রশংসনীয়। কিন্তু সম্প্রতি কিছু শিক্ষক বিতর্কিত প্রশ্ন করেছেন। যেমন লেখক আনিসুল হক ও ক্রিকেট খেলা নিয়ে যে প্রশ্ন ২০২২ সালের পরীক্ষায় এসেছে, তা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা চলমান।
এ ছাড়া ২০২২ সালের এইচএসসির বাংলা বিষয়ের সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়ন নিয়ে সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্পের যে কুণ্ডলী দেখেছি, তা নিয়ে সবাই চমকে উঠলেও আমি বিস্মিত নয়। কারণ, কিছু লোক সমাজের অনেক উঁচু স্থানে বা বড় পজিশনে বসে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করে চলেছেন। শুধু ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতা হয়, তা-ই নয় বরং বিভিন্ন নামে সাম্প্রদায়িকতা হয়। যাঁরা সমাজে সাম্প্রদায়িকতার বীজ বপন করেন এবং কাজের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িকতার উসকানি দেন, তাঁদের কঠোর বিচারের আওতায় আনতে হবে।
সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি নিয়ে যে সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে, তা উত্তরণে কিছু উদ্যোগ নিতে হবে। যেমন সৃজনশীল প্রশ্ন প্রণয়নের জন্য কিছু প্রশ্নকর্তা নিয়োগ দিতে হবে, যাঁদের অভিজ্ঞতা আছে। প্রশ্নকর্তাদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিটি প্রশ্নের প্রশ্নকর্তা হিসাবে কমপক্ষে দুজন করে নিয়োগ দিতে হবে। প্রশ্ন মডারেশনের জন্য একটি বোর্ড থাকতে হবে, তারা প্রয়োজনে প্রশ্ন সংশোধন করতে পারবে। প্রশ্নকর্তাদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা বৃদ্ধি করতে হবে। প্রশ্নকর্তাদের জন্য যে পরিমাণ সম্মানী দেওয়া হয়, তা অপ্রতুল। সৃজনশীল প্রশ্নে কোনো বিতর্কিত বিষয় থাকতে পারবে না, এই বিষয়ে প্রশ্নকর্তাদের কঠোর নির্দেশনা দিতে হবে। সৃজনশীল প্রশ্ন করতে প্রয়োজন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সার্বিক দায়িত্ব দিতে পারে কর্তৃপক্ষ। সৃজনশীল প্রশ্ন আসলেই সৃজনশীল হতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন উচ্চশিক্ষা, দেশি-বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার অভিজ্ঞতা। সৃজনশীল প্রশ্ন করতে প্রশ্নকর্তাকে যথেষ্ট সময় দিতে হবে।
সৃজনশীল প্রশ্ন এমনভাবে করতে হবে, যেখানে শিক্ষার্থীদের মনে সত্যিকার অর্থে সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী শক্তি বৃদ্ধি পায়। তাহলে দেশ বা রাষ্ট্র পাবে এক অনুসন্ধানী বা গবেষণামূলক শিক্ষিত জাতি। তাই সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি কোনোভাবেই বাদ দেওয়া বা বন্ধ করা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না। প্রয়োজন হলে সৃজনশীল প্রশ্ন করার জন্য নতুন নীতি গ্রহণ করতে পারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
সৃজনশীল প্রশ্ন নতুন প্রজন্মকে উন্নত গবেষণাভিত্তিক সমাজ ও শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলতে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে বলে বিশ্বাস করি। সৃজনশীল প্রশ্ন করতে শিক্ষকেরা যে উদ্দীপক বা বিষয়কে বিবেচনা করে থাকেন, সেখানে অধিকতর সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। সৃজনশীল তত্ত্বীয়/বর্ণনামূলকের প্রতিটি প্রশ্নে উদ্দীপকের সঙ্গে সাধারণত চারটি অংশ থাকে—(ক) জ্ঞানমূলক (খ) অনুধাবনমূলক (গ) প্রয়োগমূলক এবং (ঘ) উচ্চতর দক্ষতামূলক। অর্থাৎ প্রথম অংশটি বই থেকে মুখস্থ করে বা জ্ঞান অর্জন করে লিখতে পারবে শিক্ষার্থীরা। কিন্তু বাকি অংশ অবশ্যই শিক্ষার্থীকে বিশ্লেষণ করে প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। তাই আমাদের প্রশ্নকর্তাকে এসব বিবেচনায় নিয়ে প্রশ্ন করতে হবে। অর্থাৎ এখানে কোনো ব্যত্যয় হবে না।
সৃজনশীল প্রশ্ন এমনভাবে করতে হবে, যেখানে শিক্ষার্থীদের মনে সত্যিকার অর্থে সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী শক্তি বৃদ্ধি পায়। তাহলে দেশ বা রাষ্ট্র পাবে এক অনুসন্ধানী বা গবেষণামূলক শিক্ষিত জাতি। তাই সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি কোনোভাবেই বাদ দেওয়া বা বন্ধ করা সঠিক সিদ্ধান্ত হবে না। প্রয়োজন হলে সৃজনশীল প্রশ্ন করার জন্য নতুন নীতি গ্রহণ করতে পারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
সমস্যা সমাধানের পরিবর্তে সমস্যা অনুসন্ধানের মাধ্যমে শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের বিশ্বকে দেখতে সাহায্য করতে পারেন। সমস্যা অনুসন্ধান সমস্যা আবিষ্কারের সমতুল্য। শিক্ষকেরা সামগ্রিকভাবে একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যাপ্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে সমস্যা-অনুসন্ধান ব্যবহার করতে পারেন, যার মধ্যে সমস্যার ধরন, আকৃতি ও সমস্যা সমাধান অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। সমস্যা সন্ধানের জন্য একটি বুদ্ধিবৃত্তিক ও কল্পনাপ্রসূত দৃষ্টি প্রয়োজন। এই কৌশল ব্যবহার করে শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের গভীরভাবে চিন্তা করার, সমালোচনামূলক প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার এবং সমস্যা সমাধানের জন্য সৃজনশীল উপায় প্রয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি করে দিতে পারেন।
শুধু সৃজনশীল প্রশ্ন করলেই চলবে না, বরং শিক্ষার্থীদের সৃজনশীল দক্ষতা অর্জন করার জন্য গড়ে তুলতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন হলে ‘ডিজাইন থিঙ্কিং প্রসেস’ চালু করা যেতে পারে, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা চ্যালেঞ্জগুলো চিহ্নিতকরণ, তথ্য সংগ্রহ, সম্ভাব্য সমাধান, ধারণাগুলো পরিমার্জন এবং সমাধানগুলো পরীক্ষা করতে পারে।
দেশ ও জনকল্যাণে সৃজনশীল প্রশ্নপদ্ধতি চালু রাখা একান্ত জরুরি। তবে সৃজনশীল প্রশ্ন নিয়ে সমালোচনা, বিতর্ক ও আপত্তিকর বিষয়টি সরকারের উচ্চ মহল থেকে গুরুত্বের সহিত দেখা উচিত।
মো. শফিকুল ইসলাম সহযোগী অধ্যাপক, হিসাববিজ্ঞান ও তথ্যপদ্ধতি বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ। [email protected]