কেমন ছিল প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের সম্পর্ক

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল নিজের কর্মজীবন নিয়ে বিচার ও প্রশাসন: ভেতর থেকে দেখা নামে একটি বই লিখেছেন। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে এটি প্রকাশিত হয়েছে।

তিনি ১৯৮১ সালে শিক্ষানবিশ মুনসেফ (সহকারী জজ) পদে বিচার বিভাগে যোগ দিয়ে ২০১৭ সালে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হিসেবে অবসরে যান।

২০০৭ সালে যখন সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়, তখন তিনি ছিলেন আইন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব। কিছুদিন পরে একই মন্ত্রণালয়ের সচিব হন। তিনি এ বইয়ে সেই সময়ের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার কথা লিখেছেন। তাঁর বই থেকে চুম্বক অংশগুলো নিয়ে তিন পর্বের লেখার আজ প্রকাশিত হচ্ছে শেষ পর্ব

ফখরুদ্দীন আহমদ ও মইন ইউ আহমেদ

কেন ওয়ান–ইলেভেন অনিবার্য ছিল

কাজী হাবিবুল আউয়ালের মতামত হচ্ছে, ‘আমার ব্যক্তিগত বিশ্লেষণে ওয়ান–ইলেভেন অনিবার্য ছিল। সরকারে সামরিক বাহিনীর সম্পৃক্ততাও অনিবার্য ছিল। কিন্তু সেনানায়ক ও সেনা কর্মকর্তারা কাঙ্ক্ষিত প্রজ্ঞা প্রদর্শনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তাঁদের কর্মে ও আচরণে প্রজ্ঞা অপেক্ষা দাম্ভিকতা অধিক প্রাধান্য পাচ্ছিল। দরিদ্রদের ওপর তাঁরা হামলে পড়লেন। শহরের ফুটপাতে থাকা দোকানপাট, বস্তি, রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালা, ফুসকাওয়ালাসহ দিন আনে দিন খায় এমন অসংখ্য মানুষের রুটিরুজি বন্ধ করে দেওয়া হলো। গ্রামের হাটবাজারেও সামরিক হামলা হলো।

দরিদ্র জনগণও যে দেশের জনগণের একাংশ, সেনানিবাসের সুন্দর পরিচ্ছন্ন পরিবেশে থাকা তরুণ সামরিক কর্মকর্তারা, বিশেষত ক্যাপ্টেন মেজররা, যেন সেটা মানতে চাইছিলেন না। পুরো বাংলাদেশকে তাঁরা হয়তোবা সেনানিবাসের মতো সুসজ্জিত ও পরিচ্ছন্ন দেখতে চাচ্ছিলেন। কিন্তু তা কি সম্ভব! অপরিপক্ব নবীন বা তরুণ সেনা কর্মকর্তাদের এমন সব বাড়াবাড়ি সাধারণ, বিশেষত দরিদ্র জনগণকে সেনাবাহিনীর প্রতি ক্ষুব্ধ করে তুলেছিল।

‘যে পটভূমিতে ওয়ান–ইলেভেন সেনা–সমর্থিত অসামরিক সরকার আবির্ভূত হয়েছিল, তা ছিল মূলত অসামরিক রাজনৈতিক নেতৃত্বের রাজনৈতিক ব্যর্থতা। সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। সংকটটা ছিল মূলত রাজনৈতিক। স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের অন্বেষণ ও উদ্ভাবন জরুরি ছিল। দু’বছরে অনেক কাজ হয়েছিল। কিন্তু সেটি আর হয়নি। আজও হয়নি। আজও সংকট তেমনি রয়েছে।

১৯৭১-এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হয়েছিল অবাধ নির্বাচন, গণতন্ত্র, মৌলিক মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়কে তুলে ধরে। ’৭৩-এ স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সংসদ নির্বাচন হয়েছিল। সেটা নিয়েও অনেক বিতর্ক হয়েছে। এরপর যতসব নির্বাচন বা গণভোট হয়েছে সবই বিতর্কিত ছিল। সাংবিধানিক অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দুটি এবং অসাংবিধানিক অরাজনৈতিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে দুটি সংসদ নির্বাচন হয়েছে। সেগুলোও পুরোপুরি বিতর্কের ঊর্ধ্বে ছিল না। সূক্ষ্ম কারচুপি বা স্থূল কারচুপির অভিযোগ হয়েছে।

সেনা–সমর্থিত অসামরিক সরকার এ বিষয়টির ওপর খুব একটা গুরুত্ব আরোপ করেনি। সরকারের অসামরিক অংশ গতানুগতিক প্রশাসন চালিয়েছে। সামরিক অংশ ব্যস্ত ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ নিয়ে। দুর্নীতি তখনো ছিল আজও আছে। স্থায়ী স্থিতিশীল সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য গণতান্ত্রিক উৎকর্ষ সাধনের লক্ষ্যে রাজনৈতিক দল নিয়ন্ত্রণ এবং প্রচলিত নির্বাচন পদ্ধতিতে মৌলিক সংস্কারের কোনো উদ্যোগ বা প্রয়াস গৃহীত হয়েছিল বলে মনে হয় না।’

আরও পড়ুন

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিহাদ

সেনা–সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে দুর্নীতিবিরোধী বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিল। কাজী হাবিবুল আউয়াল লিখেছেন, ‘উদ্যোগটি জনসমর্থন লাভ করেছিল। জনগণকে দেখানোর চেষ্টা হয়েছিল যে, রাজনীতিবিদরা স্বভাবগতভাবেই দুর্নীতিপরায়ণ। গণমাধ্যমকে সেগুলো শিরোনাম সংবাদ হিসেবে প্রকাশ করতে বাধ্য করা হচ্ছিল। সামরিক বাহিনী অচিরেই সস্তা জনপ্রিয়তা পেলেও ক্রমশ সেনাবাহিনীর সুবিধাভোগী কর্মকর্তাদের দুর্নীতির খবরাখবর বিভিন্ন মাধ্যমে প্রকাশ পেতে থাকে। জনগণের মোহভঙ্গ হতে থাকে।

আসলে সমাজ থেকে দুর্নীতি বিতাড়িত করা কখনই সম্ভব হয়নি। কম-বেশি সবসময়ই ছিল। এটি একটি দুরারোগ্য ব্যাধি। সাময়িক খানিকটা প্রতিরোধ হয়েছিল। দুর্নীতিবাজদের অনেকেই ভয় পেয়েছিলেন। অচিরেই ভয় কেটে গেল। আজ দুর্নীতি সে পর্যায়ে নেই। বহুগুণে বর্ধিত হয়ে মাথা তুলে সদম্ভে বিরাজ করছে। অথচ দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতার তর্জন-গর্জন সভা-সেমিনারে প্রধানমন্ত্রী-মন্ত্রীরা ছাড়াও দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিতরাও হররোজ করে যাচ্ছেন। এ যেন এক নাটকীয় কৌতুক।

আমার অভিমত, দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ-জিহাদ খামোখা না করে বহুদলীয় গণতন্ত্রকে প্রকৃত অর্থে সমৃদ্ধ করে অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার ও সংসদ গঠনের নির্ভেজাল স্বচ্ছ ও দায়বদ্ধ পদ্ধতি উদ্ভাবন ও প্রয়োগ করা সম্ভব হলে দুর্নীতি অনেকটাই কমে আসবে।’

ট্রাইব্যুনাল গঠন

দুর্নীতির বিচারে সে সময় বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল। এ নিয়ে হাবিবুল আউয়াল লিখেছেন, ‘তদন্ত করে চার্জশিট হচ্ছে। দ্রুত বিচার করে শাস্তি দিতে হবে। ফলে বেশ কয়টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল প্রয়োজন। দৌড়ঝাঁপ করে সংসদ এলাকায় খালি অনেকগুলো ভবন পাওয়া গেল। ঢাকা সেনানিবাসের ৪৬ ব্রিগেডের ব্রিগেড কমান্ডার ব্রি. জে. হাকিম সংসদ এলাকায় এমপি হোস্টেলগুলোতে বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মূল দায়িত্ব নিয়েছিলেন। আইন মন্ত্রণালয়ের সহায়তা প্রয়োজন হয়েছিল।

ট্রাইব্যুনাল গঠনের নোটিফিকেশন আইন মন্ত্রণালয় থেকে হতে হবে। বিচারকদের নিয়োগও আইন মন্ত্রণালয় থেকে হতে হবে। আমরা আবশ্যক সহায়তা দিয়েছিলাম। কিন্তু বিচারক নির্বাচন সেনা কর্তৃপক্ষই করতেন। গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ করে বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করতেন, কোন বিচারক আসামিদের আগ্রহসহকারে দোষী সাব্যস্ত করে দণ্ডারোপ করবেন। অর্থাৎ সামরিক কর্তৃপক্ষের ইচ্ছায় কর্ম সাধন করে সামরিক কর্তৃপক্ষকে সন্তুষ্ট করবেন।

‘সেনা সদর থেকে হাতে হাতে নির্বাচিত বিচারকদের নাম নিয়ে আসা হতো। আমি মন্ত্রণালয় থেকে সেগুলো ওভাবেই সেনা সদর থেকে পাওয়া বলে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার বরাবরে পাঠিয়ে দিতাম। শোনা যায়, বিচারকদের মধ্যে প্রতিযোগিতাও ছিল বিশেষ ট্রাইব্যুনালে নিয়োগ পেতে। অনেক বিচার কর্মকর্তাই বিশ্বাস করতেন বা অনেককেই আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যে, তাঁরা যদি ভালো ফল দেখাতে পারেন তাহলে তাঁদের হাইকোর্টের বিচারপতি করা হবে। সে সময়ে সেই পরিস্থিতিতে সামরিক কর্মকর্তারা অমন আশ্বাস দিলে তা বিশ্বাস করার মতোই ছিল। আর হাইকোর্টের বিচারপতি হওয়ার অমন সুযোগ কেই বা ছাড়তে চাইবে!

অনেকের ট্রাইব্যুনালে নিয়োগ পাওয়ার আগ্রহ বুঝতে পেরেছিলাম জেনে যে, তাঁরা মন্ত্রণালয়ে এসে খোঁজখবর নিতেন কবে নিয়োগের আদেশ হবে এবং সুপ্রিম কোর্ট থেকে সম্মতিপত্র এসেছে কিনা। বিচার শেষ হতে হতে সেনা–সমর্থিত কেয়ারটেকার সরকারের মেয়াদও ফুরিয়ে এলো। আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন অসামরিক সরকার গঠিত হলো। ট্রাইব্যুনালগুলো গুটিয়ে নেওয়া হলো। সেগুলোতে নিয়োগ পাওয়া বিচারকদের অনেকে হতাশ হলেন। হাইকোর্টের বিচারপতি হওয়ার স্বপ্ন ও আশা পূরণ হলো না।’

আরও পড়ুন

সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী!

কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ‘বহুল আলোচিত মাইনাস টু থিওরি কার বুদ্ধি বা পরামর্শ মোতাবেক বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল জানতাম না। তবে বিষয়টা স্পষ্ট ও দৃশ্যমান ছিল। প্রথম প্রথম চেষ্টা হয়েছিল ড. ইউনূসকে প্রধান করে সরকার গঠন করা। পরে ড. ইউনূস অপারগতা ব্যক্ত করলে ড. ফেরদৌস আহমেদ কোরেশীকে দিয়ে সরকার গঠন করার চেষ্টা হলো। ড. কোরেশী সম্ভবত ওতে সম্মত ছিলেন। উনার নাম আমি শুনেছিলাম। তবে কখনো তাঁকে দেখিনি।

সেনা নেতৃবৃন্দ মাঝে মধ্যে নৈশভোজের আয়োজন করে অনেককে নিমন্ত্রণ করতেন। সে সময় সেনা কর্তৃপক্ষ থেকে এ ধরনের আমন্ত্রণ লাভ করা বিরল সৌভাগ্যের বিষয় ছিল। আমি এরকম দুটো নিমন্ত্রণে যোগদান করেছিলাম। আরও অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তি যোগদান করেছিলেন। স্থান ছিল সম্ভবত গুলশান বা বনানীতে সেনা মালিকানাধীন অসামরিক কোনো একটি ভবন। বাসভবন হিসেবে সেটি ব্যবহার হতো না। এক রাতে আমি নৈশভোজে এক টেবিলে এক ভদ্রলোকের পাশে বসেছিলাম। চিনতাম না। আমিই উপযাচক হয়ে পরিচয় জিজ্ঞেস করলে বললেন তাঁর নাম ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী। চিনলাম। সম্মানিত বোধ করলাম। দেশের সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী!’

শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার মুক্তি

এ নিয়ে একটি অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন কাজী হাবিবুল আউয়াল। তিনি লিখেছেন, ‘শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের ১১ জুন তারিখে প্যারোলে মুক্তি পান। চিকিৎসার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য গমনের অনুমতি পেলেন। বিদেশে গমন করলেন। সেনাবাহিনীর দুজন পদস্থ কর্মকর্তা আমার কার্যালয়ে এলেন। জানতে চাইলেন দেশের সংবিধান বা আইনে শেখ হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তন প্রতিরোধের কোনো সুযোগ রয়েছে কিনা। জানালাম এমন সুযোগ নেই।

সংবিধানের ৩৬ অনুচ্ছেদের বিধান মতে তিনি স্বইচ্ছায় দেশত্যাগ করতে পারেন এবং দেশে প্রত্যাবর্তন করতে পারেন। তিনি অন্যায়-অপরাধ করলে প্রয়োজনে দেশে তাঁর বিচার হতে পারে। খানিকটা কৌতুক করে বললাম, দেশে ফিরে এলে উনাকে বিমান থেকে নামতে দিলেন না। বিমান যুক্তরাষ্ট্রে ডাইভার্ট করে দিলেন। যুক্তরাষ্ট্রের ইমিগ্রেশন তাঁকে বিমান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে নামতে দিল না। এভাবে চলতে থাকল। তাঁকে বাকি জীবন তাহলে বিমানে বা আকাশে বসবাস করতে হবে। সেনা কর্মকর্তারা খুশি হতে পারলেন না। তবে বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন বলে মনে হয়েছিল।

‘বেগম খালেদা জিয়া ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তারিখে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের আদেশে জামিনে মুক্তি পান। বিএনপির সমর্থক-কর্মীরা উৎসাহিত হয়ে রাজপথে নেমে এলো। সেনাশাসকদের সফলতা যেন আরও ধূসর হয়ে এলো। জনগণ বুঝে উঠতে পারছিল, সেনা–সমর্থিত সরকারের মেয়াদ অচিরেই ফুরিয়ে যাবে। নির্বাচন হবে। নির্বাচন কমিশন তৎপর হয়ে উঠেছিল। নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকার ক্ষমতায় আসবে।’

কেমন ছিল তাঁদের মধ্যকার সম্পর্ক

কাজী হাবিবুল আউয়াল প্রধান উপদেষ্টা ও সেনাপ্রধানের সম্পর্ক নিয়েও বেশ কিছু কথা লিখেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘মাঝে মাঝে স্পষ্ট হয়ে প্রতিভাত হতো, সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ. আহমেদ এবং প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদের মধ্যে স্বাভাবিক নিয়মতান্ত্রিক সম্পর্ক বিরাজ করছে না। সম্ভবত সেনাপ্রধান নিজেকে অসামরিক প্রধান উপদেষ্টার অধীন ভাবতে পারছিলেন না। হয়তোবা সেনাপ্রধানের অবচেতন মনস্তত্ত্বে ক্ষমতা ও শক্তির দম্ভ শিকড় গজাচ্ছিল।

‘জেনারেল মইন ইউ. আহমদের বা প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদের কোনো রাজনৈতিক ভিত্তি বা সংগঠন ছিল না। মইন ইউ. আহমদের কতিপয় কর্মকাণ্ডে ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক অভিলাষ প্রকাশ পাচ্ছিল। সামরিক কর্মকর্তা হয়েও তিনি প্রায়শই বিভিন্ন সভা-সেমিনারে প্রধান অতিথি হয়ে রাজনৈতিক ধরনের বক্তব্য রাখছিলেন।

‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক আতাউর রহমানকে খুবই সক্রিয় মনে হচ্ছিল। তিনি সেনাপ্রধানের সঙ্গে ছায়ার মতো লেগে থাকতেন। হয়তো ভেবেছিলেন, সেনাপ্রধান অদূর ভবিষ্যতে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করবেন। দিন যতই গড়াচ্ছিল সেনাপ্রধান এবং প্রধান উপদেষ্টার মধ্যে নীরব দূরত্ব প্রকাশ পাচ্ছিল। সেনা–সমর্থিত অসামরিক সরকারে বিভাজন ও দ্বৈতশাসন ছায়াপাত করছিল। ফলে সেনা–সমর্থিত অসামরিক সরকারের সার্বিক দক্ষতা ও সক্ষমতা ক্ষয়িষ্ণু হয়ে আসছিল।’

বইয়ের এক অধ্যায়ে কাজী হাবিবুল আউয়াল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ দিনগুলোর কথা উল্লেখ করে লিখেছেন, ‘মনে পড়ে, ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর কি অক্টোবর মাসের কোনো একদিন আমি একটি নথি স্বাক্ষর করাতে প্রধান উপদেষ্টার অফিস কক্ষে প্রবেশ করলাম। তিনি রেড টেলিফোনে কেউ একজনের সঙ্গে কথা বলছিলেন। অনেকটা উত্তেজিত হয়ে কথা বলছিলেন।

একপর্যায়ে বলছিলেন, “ডিসেম্বরের পর অতিরিক্ত একদিনও আমি দায়িত্বে থাকব না।” লক্ষ্য করেছিলাম, উত্তেজনায় তাঁর চোখ-মুখ অনেকটা লাল হয়ে উঠেছিল। আমি নথি স্বাক্ষর করিয়ে দ্রুত বেরিয়ে এলাম। মনে হয়েছিল তিনি দ্রুত দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে মুক্ত হতে চাইছিলেন। আবার অপর প্রান্তে কেউ হয়তোবা সরকারের মেয়াদ বাড়াতে চাইছিলেন। যাই হোক, সেটা আমার অনুমান ছিল। অনুমান সঠিক নাও হতে পারে। তবে, একটি বিষয় সম্ভবত আমি সঠিক অনুমান করতে পেরেছিলাম। সরকারের শেষ দিনগুলোতে সেনাপ্রধান প্রধান উপদেষ্টাকে পছন্দ করছিলেন না এবং প্রধান উপদেষ্টাও সেনাপ্রধানকে পছন্দ করছিলেন না।’

সব শেষে কাজী হাবিবুল আউয়াল লিখেছেন, ‘দাপুটে ওয়ান–ইলেভেন সরকারের অবসান হওয়ার পর জেনারেল মইন ইউ. আহমেদ এবং প্রধান উপদেষ্টা ফখরুদ্দীন আহমদ প্রিয় মাতৃভূমি থেকে সুদূর আমেরিকায় দেশান্তরিত হয়ে আজ প্রায় ১৬ বছরের অধিক কাল নিউইয়র্ক শহরে অসুখকর জীবন যাপন করছেন। এমনটা কাম্য ছিল না।’