বর্তমান যুব সমাজ কি ব্যর্থ?

মানুষ প্রাকৃতিকভাবেই সৃজনশীল। যদি বলা হয়, আধুনিক বিশ্বের যত সব বিস্ময়কর সফলতা, তা একমাত্র সৃজনশীলতা ও স্বাধীন চিন্তাচেতনার কারণেই সম্ভব হয়েছে, তাহলে ভুল হবে না। মানুষ যখন সমাজের প্রচলিত ধারণা ও অবকাঠামোর বিরুদ্ধে গিয়ে চিন্তা করতে ও বিশ্লেষণ করতে শুরু করে, তখনই হয় নানা রহস্যের উন্মোচন। বিকশিত হতে শুরু করে সভ্যতা ও সংস্কৃতি এবং সৃষ্টি হয় নানা তথ্য ও তত্ত্বের।

এর ধারাবাহিক উৎকর্ষ সাধনের ফলে সম্ভব হয় যত সব জ্ঞান ও শিল্পের বিপ্লব। আজকের সভ্যতা যে অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে, তা–ও একমাত্র চিন্তার স্বাধীনতার কারণেই সম্ভব হয়েছে। মানুষ তার চিন্তার প্রসারণ এবং স্বাধীনতা অর্জন করতে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে সংগ্রাম করে আসছে। তাই সৃজনশীলতা ও স্বাধীন চিন্তাশক্তিকে আধুনিক সভ্যতার সবচেয়ে বড় ও মূল্যবান অর্জন বলে বিবেচনা করা হয়।

প্রচলিত সব বিশ্বাস আর প্রথা ভেঙে যারা বাস্তবতা ও নতুনত্বের খোঁজে সমাজ ও রাষ্ট্রের স্বার্থে নিজেদের উজাড় করে দেয়, তারা হলো তরুণ প্রজন্ম। এই তরুণ প্রজন্ম যদি তার সমাজ ও রাষ্ট্রের উৎকর্ষ সাধন করতে চায়, তাহলে তার জ্ঞান, চিন্তাচেতনাকে স্বাধীন ভাবধারার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। অর্থাৎ, স্বাধীনভাবে ভাবনার সুযোগ প্রদান করতে হবে।

বাংলাদেশ প্রযুক্তিতে, শিক্ষায়, উদ্ভাবনী উদ্যোগে এবং সৃজনশীলতায় তার যুবসমাজের কাছ থেকে আশানুরূপ ফল পাচ্ছে না। এটা নিয়ে দেশের নীতিনির্ধারণী পর্যায় নানা সমীকরণ দাঁড় করালেও প্রকৃত সমস্যা অনেকে উদ্ভাবন করতে পারেনি। যুব সমাজের দুইটা দিক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটি কর্মশক্তি অপরটি তীক্ষ্ণ চিন্তাশক্তি—এই দুইয়ের সমন্বয়ে তারা স্বস্থানে হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। কিন্তু আমরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে তাদের শক্তিকে দুর্বল করে দিচ্ছি। স্বাধীনভাবে চিন্তা করা ও চিন্তার বহিঃপ্রকাশে বাধা সৃষ্টি করছি, যা তাদের কর্মশক্তিকে প্রভাবিত এবং চিন্তাশক্তিকে দুর্বল করছে।

আজকে তরুণ সমাজ, বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্বাধীনভাবে ভাবতে পারে না। আর ভাবতে পারলেও তা স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারে না। কারণ, তারা দেখতে পায়, কোনো মতপ্রকাশ প্রশাসনের বিরুদ্ধে গেলে ভবিষ্যতে তার পরিণাম ভোগ করতে হয়। কর্মক্ষেত্রে খারাপ প্রভাব পড়ে। অবশ্য এভাবে দেখার দুটি কারণ রয়েছে। একটি হলো তারা সৃজনশীল পেশাকে পছন্দ করে না। সৃজনশীল পেশা হলে কারও তোয়াজ করার প্রয়োজন নেই। অপরটি হলো বাংলাদেশের অপরাজনীতি ও প্রশাসনিক দৌরাত্ম্যের ভয়।

বর্তমান তরুণ সমাজ দেশে বিরাজমান অপরাজনীতি, অপসংস্কৃতি ও অপতৎপরতার বাঁধ ভেঙে দেশের মানুষকে নতুন করে স্বপ্ন দেখানোর প্রচেষ্টা দেখাতে পারে না। অথচ আমরা প্রায়ই বলি, তরুণ সমাজ এ দেশের ভবিষ্যৎ। যদি গতিশীল সময়ের সঙ্গে তরুণদের প্রগতিশীল চিন্তাচেতনাকে জাতীয় হাতিয়ার না বানানো হয়, তাহলে অন্যদের থেকে আমরা হাজার বছর পিছিয়ে থাকব, এটাই স্বাভাবিক।

যদি সত্যিই আমরা জাতি হিসেবে নিজেদেরকে অগ্রসর ও সৃজনশীল হিসেবে দেখতে চাই, তাহলে তরুণদের চিন্তাচেতনা ও দর্শনের ক্ষেত্রের বিশেষ বাস্তবায়নে কোনোরূপ বাধা সৃষ্টি করা যাবে না। সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তরুণদের উদ্যোগ বাস্তবায়নে সহায়তা করা প্রয়োজন; যেকোনো চিন্তা, দর্শন, উদ্ভাবন ও কর্মপরিকল্পনাকে স্বাগত জানানো উচিত। সরকারের বিভিন্ন নীতিনির্ধারণী পদে তরুণদের অন্তর্ভুক্তকরণ তাদের চিন্তাশক্তিকে আরও সমৃদ্ধ করবে।

বাংলাদেশ মেধা নামক বীজের বিকাশের জন্য একটি অনুর্বর ভূমি হিসেবে বিবেচিত। মেধার সঠিক বিকাশে এখানে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম—উভয় সংকটই রয়েছে। তবে কৃত্রিম সংকটই অধিক। বর্তমান প্রজন্মের বিকাশের জন্য এই ভূমি উর্বর করা এখন সময়ের দাবি। সব সংকট, বাধাবিপত্তি, রাজনৈতিক ক্লেশ দূর করে যুবসমাজ ও শিক্ষার্থীদের মানবিক ও প্রজ্ঞাপূর্ণ চিন্তাচেতনার এবং মেধা বিকাশের ভূমিতে পরিণত করা হোক প্রিয় বাংলাদেশকে।

জাবেদ হোসেন
শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
ই–মেইল: [email protected]