একবার অবসরে থাকা গুণী বিচারপতি হাবিবুর রহমান সাহেবের কাছে জানতে চেয়েছিলাম র্যাগিংকে বাংলায় কী বলা যায়? সেদিন তিনি কোনো একটা কারণে বেশ খোশমেজাজে ছিলেন। ‘এই যে তোমার মেয়েকে জিজ্ঞাসা করলাম, “কোন ক্লাসে পড়ো?” ও বলল, “ক্লাস ফোর।” সঙ্গে সঙ্গে আমি কী বললাম? বললাম, “হেডমাস্টারের জুতাচোর।” আমি রসিকতা করলাম, কিন্তু এটাও একধরনের র্যাগিং। খ্যাপানো বলতে পারো, আবার জ্বালাতন করা বলতে পারো।’ ইংরেজি র্যাগিংয়ের বাংলা জ্বালাতন করা। রসিকতার নামে কাউকে অত্যাচার করা। বড়রা শিশুদের জ্বালাতন করে এক ধরনের মজা পায়। কিন্তু শিশুরা সেটাতে মজা না পেয়ে বিরক্ত হলে তুমি সীমা লঙ্ঘনকারী পারপিট্রেটর অপরাধী।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নতুন শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পুরোনো ছাত্রদের নির্দোষ রসিকতার মাধ্যমে একটা সখ্য গড়ে তোলার চেষ্টার মধ্যে দোষ নেই। তবে সব সময় মাত্রা ঠিক রাখতে হবে। ‘আইস ব্রেকিং’–এর নামে রসিকতা বিনোদনের প্রথাকে অনেকে পরিচিত র্যাগিং নামে ডাকে। নতুন শিক্ষার্থীদের জন্য নবীনবরণের অনুষ্ঠানের চল বহুদিনের।
আগেরবারের চেয়ে পরেরবার অনুষ্ঠানটাকে আরও আকর্ষণীয় আর বর্তমানের চালু ভাষায় ‘স্মার্ট’ করার মহড়া চলত দিনের পর দিন।
এখন সেসবের বালাই নেই। নতুনেরা এখন যেন পুরোনোদের সম্পত্তি; অধীন বা সাবজেক্টে পরিণত হয়েছে। তাঁদের সঙ্গে তাঁরা যা খুশি তাই করতে পারেন।
র্যাগিংয়ের নামে তথাকথিত ‘আদব-কায়দা, নিয়মকানুন’ শেখানোর আড়ালে চলে নানা প্রকারের ‘স্মার্ট’ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন। কান ধরে ওঠবস, লাঠি–হাতুড়ি বা রড দিয়ে পেটানো, পানিতে চুবানো, উঁচু ভবন থেকে লাফ দেওয়ানো, সিগারেটের আগুনে ছেঁক দেওয়া, গাছে ওঠানো, ভবনের কার্নিশ দিয়ে হাঁটানোসহ, কাপড় খুলে দিগম্বর করা ইত্যাদি চরম অরুচিকর কর্মকাণ্ড চলছে। নবীন শিক্ষার্থীরা সব সময় র্যাগিংয়ের ভয়ে ভীত থাকেন।
এখন র্যাগিংয়ের কোনো দিনক্ষণ, সময় নেই। বছর ধরেই গালিগালাজ, কুৎসিত শব্দে ডাকা ব্যক্তিগত কাজ করিয়ে নেওয়া ইত্যাদি চলতে থাকে নির্মমভাবে। অনেক সময় কথিত শিক্ষকেরা এসব কাজে আশকারা দেন, অংশীদার হয়ে যান।
দেশের এক সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন চট্টগ্রামের এক ছাত্র। তাঁর কথা বলতে একটু আটকাত, যেটাকে আমরা ‘তোতলামো’ বলি। প্রাইমারি স্কুলশিক্ষকের একমাত্র সন্তান ‘স্মার্ট’ ছিল না। প্রথমে ভেবেছিল আস্তে আস্তে সয়ে যাবে। টিটকারিতে ছেদ পড়বে। বন্ধ হয়নি টিটকারি; ক্লাসে, ছাত্রাবাসে টিকতে না পেরে শেষ পর্যন্ত আত্মহত্যা করেন মেধাবী ছাত্রটি। চিতায় তাঁর মরদেহ তোলার আগেই সবাই তাঁদের পাপ ভুলে যায়। কর্তৃপক্ষ একটা লোকদেখানো নিরামিষ মার্কা তদন্ত পর্যন্ত করেনি, তাঁর মৃত্যুর হেতু খুঁজতে।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বশেষ ঘটনা
সর্বশেষ কুষ্টিয়ার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে যেটা ঘটেছে, সেটা অতীতের সব মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। গত ১২ ফেব্রুয়ারি (রোববার) রাতে সাড়ে চার ঘণ্টা আটকে রেখে প্রথম বর্ষের এক ছাত্রীকে বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ, গালাগাল এবং এ ঘটনা কাউকে জানালে মেরে ফেলার হুমকি দেওয়া হয়। এর আগে নতুন ছাত্রীটিকে দিয়ে একটা ময়লা গ্লাস তাঁর জিব দিয়ে চেটে পরিষ্কার করতে বাধ্য করা হয়। তাঁর অপরাধ হলে ওঠার আগে হলের স্বঘোষিত নেত্রীবৃন্দকে কেন জানানো হয়নি। ছাত্রীটি থাকার জায়গা না থাকায় তিনি সাময়িক সময়ের জন্য একজন পরিচিত সিনিয়র শিক্ষার্থীর অতিথি হয়ে হলে উঠেছিলেন।
ভুক্তভোগী ছাত্রীটির ভাষ্য অনুযায়ী, ‘আমি বলি আপু আমাকে ডেকেছেন কেন? তখন তারা আমার মুখ চেপে ধরে থাকে এবং সজোরে চোয়ালে থাপ্পড় মারে। আপুরা মারার সময় বলছিল, মুখে মারিস না, গায়ে মার, যেন কাউকে দেখাতে না পারে। আপুরা বলতে থাকে, আমরা কী করতে পারি জানিস তুই? আমাদের সম্পর্কে তোর কোনো আইডিয়া আছে? আমি কাঁদতে কাঁদতে তাদের পা ধরে মাফ চাইতে গেলে তারা আমাকে পা দিয়ে লাথি মারে। অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে, গামছা দিয়ে গলায় ফাঁস দিয়ে ধরে রাখে। বলে আমাদের কথা যদি কাউকে বলিস তাহলে ফেসবুকে তোর বিবস্ত্র ভিডিও ছড়িয়ে দেব। প্রশাসনের কাছে যদি কোনো প্রকার অভিযোগ দিস, তাহলে মেরে কুকুর দিয়ে খাওয়াব। এরপর আমাকে রাত সাড়ে ৩টায় ছেড়ে দেয়।’
ছাত্রীটি ভয়ে ক্যাম্পাস ছেড়ে বাড়ি চলে যান। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র উপদেষ্টা অধ্যাপক সেলীনা নাসরিন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘ভুক্তভোগী ওই ছাত্রী আমাদের জানিয়ে ক্যাম্পাসে এলে তাকে সর্বোচ্চ নিরাপত্তা দেওয়া হবে।’ তিনি আরও জানিয়েছেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক রেবা মণ্ডলকে আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। চূড়ান্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আগের তদন্ত কমিটিগুলো কী করেছিল
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে লাগামহীন র্যাগিং কোনো নতুন ঘটনা নয়। শিক্ষককে ক্লাস থেকে বের করে দিয়ে নবীন শিক্ষার্থীদের র্যাগ দেওয়ার রেকর্ড আছে এই বিশ্ববিদ্যালয়টির। সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়েছিলেন এক ছাত্রী, ‘সিনিয়ররা ক্লাসে এসে আমাদের নাম-পরিচয় জানতে চান। আমরা নাম–পরিচয় বলার পরেও একাধিকবার একই প্রশ্ন করা হয়, সবার সামনে দাঁড়িয়ে গান করা, বেঞ্চের ওপর দাঁড় করানো হয়। এ ছাড়া ছাত্রীদের ডেকে প্রপোজ করতে বলা হয়। এমনকি কেউ যদি প্রপোজ করে তাহলে কী করবে? এবং কারও সঙ্গে কখনো কোথাও ঘুরতে গিয়েছি কি না, এমন প্রশ্নও করা হয়েছে।’ শিক্ষকেরা বিষয়টি গায়ে না মাখলেও ছাত্রছাত্রীদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৯ সালের সেই ঘটনায় শেষ পর্যন্ত তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল।
সেই সময় বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক সালমা সুলতানা বলেছিলেন, ‘বিভাগের স্বাভাবিক কার্যক্রম গুটিকয়েক শিক্ষার্থীর কারণে নষ্ট হতে পারে না। আমরা তাদেরকে ডেকে প্রাথমিকভাবে সতর্ক করেছি এবং শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে তদন্ত কমিটি করা হয়েছে। কমিটির সিদ্ধান্তের আলোকে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এরপর র্যাগিং বন্ধের দাবিতে ক্যাম্পাসে সাধারণ শিক্ষার্থীরা শোভাযাত্রা করেন। শিক্ষকেরাও তাতে অংশ নেন এবং বক্তব্য দেন। বলা বাহুল্য, পরে তদন্ত রিপোর্ট নিয়ে কেউ আর নড়াচড়া করার উৎসাহ পায়নি।
র্যাগিংয়ের নামে যৌন হয়রানির অভিযোগ উঠেছিল ২০২০ সালেও। তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর প্রফেসর পরেশ চন্দ্র বর্মণ সংবাদমাধ্যমকে বলেছিলেন, ‘অভিযোগকারী এবং অভিযুক্ত উভয়ের সঙ্গে কথা বলেছি। যৌন হয়রানির বিষয়ে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
তারও আগে ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে নবীন শিক্ষার্থীদের র্যাগিংয়ের নামে যৌন হয়রানির পৃথক দুটি অভিযোগ সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। কোনোটিরই কোনো বিহিত হয়নি।
কাগজে–কলমে কর্তৃপক্ষের র্যাগিংবিরোধী অবস্থান
এবারের ঘটনার সপ্তাহখানেক (৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩) আগে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে (ইবি) জাতীয় শুদ্ধাচার কৌশল কর্মপরিকল্পনা ২০২২-২৩–এর অংশ হিসেবে র্যাগিংবিরোধী সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে অশুভ র্যাগিং বন্ধের জন্য কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, ‘শিক্ষা হচ্ছে দোতলা ঘরের মতো।
নিচতলা জীবাত্মা, ওপরতলা পরম আত্মা। নিচতলা থেকে ওপরতলায় উঠতে সিঁড়ি লাগে, আর সে সিঁড়িটা হচ্ছে শিক্ষা। এই ধর্মীয় শিক্ষা, কারিকুলাম, একাডেমিক শিক্ষা ইত্যাদি বিষয় যদি আমরা সঠিকভাবে শিখতে পারি, তাহলে অবশ্যই র্যাগিং দূরীভূত হবে।’ প্রার্থনা আর সদিচ্ছার সঙ্গে সঙ্গে কিছু অ্যাকশন আর সাহসের প্রয়োজন। দোষীদের শাস্তি দেওয়ার সাহস থাকতে হবে। অন্যায়ের মূল উৎপাটন না করে তার উৎপাদনের পরিবেশ টিকিয়ে রাখার নাম ন্যায়নীতি নয়।
নির্যাতিতদের নিরাপত্তার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন সামাজিক সহযোগিতা। তাঁরা যে মানসিক সংকটের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, তার থেকে বের করে আনাটা জরুরি। ফোনের ওপর ভরসা করে বসে না থেকে শিক্ষকদের উচিত হবে আহত শিক্ষার্থীর বাড়িতে ছুটে যাওয়া এবং তাঁর পরিবারকে আশ্বস্ত করা। লাশের গাড়ির সঙ্গে যাওয়ার চেয়ে জীবিতের বাড়িতে যাওয়া অনেক বেশি পুণ্যের।
গওহার নঈম ওয়ারা লেখক ও গবেষক
[email protected]