আলতাফ পারভেজের বিশ্লেষণ
কুকিদের অশান্তিময় এক বছর ও ইতিহাসের নতুন অধ্যায়
দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় হিন্দিভাষী, বাংলাভাষী এবং বার্মিজদের ত্রিমুখী সংখ্যাগরিষ্ঠতার মুখে থাকা কুকি–চিন–মিজো–বমদের বঞ্চনা ও অধিকারের পাশাপাশি তিনটি দেশে তাদের সশস্ত্র তৎপরতা ও এর প্রভাব নিয়ে লিখেছেন আলতাফ পারভেজ
‘কুকিদের’ সম্পর্কে বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু মানুষ সামান্যই অবহিত ছিল। এর মধ্যে পরপর চারটি ঘটনা ঘটল। প্রায় এক বছর আগে মণিপুরে মেইতেই-কুকি সংঘাত বাধল। একই সময়ে মিয়ানমারের চিন প্রদেশে বেগবান হলো বামারদের বিরুদ্ধে স্থানীয়দের প্রতিরোধযুদ্ধ। পরপরই বান্দরবানে কুকিরা নজর কাড়ল কিছু দাবিদাওয়া তুলে ধরে।
মণিপুর, চিন, বান্দরবানের ঘটনাবলির খবরাখবর গেল মিজোরামে। সব সহজাতির সঙ্গে সংহতি দেখিয়ে সেখানেও কিছু মিটিং-মিছিল হলো। এভাবেই গত এক বছরে কুকি-দুনিয়া বিশেষ মনোযোগ পেল অকুকিদের। সেই সূত্রেই অনেকের আগ্রহ এখন জাতিসত্তাটি নিয়ে। তবে এই আগ্রহের আগে-পরে কুকি অঞ্চলগুলোতে সহিংসতাও চলেছে। যুগের পর যুগ আশপাশের সংখ্যাগুরুর সাংস্কৃতিক দাপট ও নানানমুখী চাপে কুকি সমাজ ক্লান্ত ও বিপন্ন।
বুক চিতিয়ে না দাঁড়ালে কোনো সংখ্যাগুরু কোনো দিন তাঁদের কথা শোনেননি। ফিরেও তাকাননি। আবার সশস্ত্রতা এবং সন্ত্রাসও তাঁদের শান্তি ও স্বস্তির অতীত ফিরিয়ে আনতে পারেনি। পাশাপাশি কল্পনার স্বাধীন ভূমি ‘জালেন-গামে’র কথাও ভুলতে পারে না তাদের ইতিহাস।
মূলত তাঁরা ‘জো’ এবং শান্তিতে নেই
‘কুকি’ শব্দের সঙ্গে চলে আসে ‘চিন’ শব্দ। ‘চিন’ কুকি পরিবারের আরেক ট্রাইবমণ্ডলী। একই পরিবারের সদস্য হিসেবে উল্লেখ করা হয় মিজো, বম, খিয়াং, লুসাইদেরও। সবাই তাঁরা বৃহত্তর ‘জো’ জাতির মানুষ। যেহেতু এসব জাতিসত্তার মানুষ দু-তিনটি রাষ্ট্রের সীমানায় বহু রাজ্যে বিভক্ত এবং এ রকম সব রাষ্ট্রে তাঁদের অবস্থান বেশ প্রান্তিক, সে কারণে তাঁদের সঠিক সংখ্যা বলতে পারে না কেউ।
কেবল অনুমান করা হয়, সবচেয়ে বেশি জো আছে মিজোরামে। ১০ লাখ অধিবাসীর রাজ্যটিতে জোরা হবে ৮ লাখ। ৩৬ লাখ মানুষের মণিপুরে ১৫-২০ শতাংশ হলো জো। রাজধানী ইম্ফলে তাঁদের সংখ্যা ৬-৭ শতাংশ ছিল। এখন অনেকটাই নেই।
■ কুকি-চিন-বম-মিজোরা দু-তিনটি রাষ্ট্রের সীমানায় বহু রাজ্যে বিভক্ত এবং এ রকম সব রাষ্ট্রে তাঁদের অবস্থান বেশ প্রান্তিক।
■ মণিপুরে কুকি-মেইতেই সংঘাতের মধ্যেই বান্দরবানের জো অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে অশান্তি ও অস্থিরতা শুরু হয়।
■ জোরা এখন মিজোরাম ও বান্দরবানের সঙ্গে স্বতন্ত্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যও করতে চাইছেন। বিষয়টি কোনো কোনো দেশের জন্য অস্বস্তিকর।
চিন প্রদেশে জো আছেন চার-পাঁচ লাখ। সেখানে তাঁরাই সংখ্যায় বেশি। তবে প্রায় ৫০টি ট্রাইবে বিভক্ত। নাগাল্যান্ড ও বান্দরবানেও জোরা আছেন যথাক্রমে ৩০ ও ১৫ হাজারের মতো। ফলে অনুমাননির্ভর হিসাব বলে, দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া মিলে জো জাতির মানুষ আছেন আনুমানিক ২০ লাখ।
এর মধ্যে আবার কুকি-চিন-মিজো সমাজের ছোট একটি অংশ নিজেদের ‘বেনে মেনাশে’ নামে ইহুদি ঐতিহ্যের হারিয়ে যাওয়া একটি গোত্র হিসেবেও মনে করে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রায় পাঁচ হাজার কিলোমিটার দূরে কীভাবে তারা এল, এ নিয়ে নানা মত আছে। এ রকম দাবিদার প্রায় পাঁচ হাজার মানুষ আছেন মণিপুরে। যাঁদের অনেকে অবশ্য মেইতেইয়ের তাড়া খেয়ে এখন মিজোরামে শরণার্থী। ছোট এই ট্রাইবসহ গত এক বছরে মণিপুর থেকে চিন-বান্দরবান—সর্বত্র জোরা অশান্তিময় এক জীবনে আছে।
যে আগুন থামেনি এক বছরেও
সমকালীন ইতিহাসে জো গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় আঘাতে এসেছে মণিপুরে। এক বছর ধরে সেখানে সহিংসতা চলছে। রাজ্যের বড় জাতি মেইতেইদের ‘শিডিউল ট্রাইব’ সুবিধা দেওয়ার প্রতিবাদ জানাতে আয়োজিত কুকি সমাবেশ থেকে ওই সংঘাতের শুরু।
প্রথম দিকে ক্ষয়ক্ষতি সমানে সমান হলেও ক্রমে ‘দাঙ্গা’ একপক্ষীয় চেহারা নিয়েছে বলে অভিযোগ আছে। কুকিদের ইম্ফল থেকে এখন অনেকটাই সরে যেতে হয়েছে। জোদের ক্ষোভের আগুন সেখানে এত বিস্তৃত যে ভারতের চলতি জাতীয় নির্বাচনও বর্জন করেছে তারা।
মণিপুরে লোকসভার দুটি আসন। ‘আউটার মণিপুরের’ আসনটিতে সচরাচর কুকিরা দাঁড়ান এবং জেতেন। এটা ‘শিডিউল ট্রাইবদের’ জন্য সংরক্ষিত। কুকিরা নির্বাচনে না থাকায় হয়তো কোনো নাগা এই আসনে জিতে আসবেন, যাঁরা এ মুহূর্তে কুকিদের আরেক জাতিগত প্রতিপক্ষ।
রাজনৈতিক বিবেচনায় মণিপুরজুড়ে কুকিদের এখন চূড়ান্ত প্রান্তিক অবস্থা। কেউ যেন তাদের কথা শোনার জায়গায় নেই। বিশেষ করে রাজ্যের রাজধানী ইম্ফলে। বিধানসভার কুকি এমএলএরাও সেখানে যান না বা যেতে পারেন না। ৬০ সদস্যবিশিষ্ট বিধানসভায় কুকি প্রতিনিধিদের মধ্যে যাঁরা বিজেপির মনোনয়ন নিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাঁরাও ইম্ফলে নিরাপত্তাসংকটে ভোগেন।
রাজধানীতে অভিগম্যতা না থাকায় কুকিরা বিচারব্যবস্থার সুবিধা থেকেও বঞ্চিতও হচ্ছেন। এ অবস্থায় রাজ্যের এখনকার ২২ হাজার বর্গকিলোমিটার থেকে ১৩ হাজার বর্গকিলোমিটার কেটে তাঁদের জন্য আলাদা রাজ্য চাইছেন কুকিরা। এই দাবিতে যুক্ত হয়েছেন রাজ্য মন্ত্রিসভার দুই কুকি সদস্যও। বলা বাহুল্য, মেইতেইরা তার বিরুদ্ধে। কুকিদের বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসে’র অভিযোগ আছে তাঁদেরও।
অস্থিরতার ঢেউ বান্দরবানেও
মণিপুরে কুকি-মেইতেই সংঘাতের মধ্যেই বান্দরবানের জো অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে অশান্তি ও অস্থিরতা শুরু হয়। যার একরকম পরিণতি হিসেবে সর্বশেষ এপ্রিলে একদিকে ‘ব্যাংক ডাকাতি’, অন্যদিকে অনেক মানুষ গ্রেপ্তার হলেন। দ্য নিউএজ ৯ এপ্রিল বিভিন্ন প্রশাসনিক সূত্রের বরাতে ৫৪ ব্যক্তির আটকের খবর দিয়েছিল। যাঁদের মধ্যে ১৮ জন জো নারীও আছেন। নিরাপত্তা প্রশ্নে নারীদের আটকের ঘটনা এদিকে অতীতে কমই ঘটেছে। ব্যাংক ডাকাতির মতো ত্রাসও বিরল।
বান্দরবানের চলতি অবস্থার শেষ কোথায়, সেটা কেউ জানে না। বমদের অনেক গ্রাম এখন মানুষশূন্য। কোথায় চলে গেলেন এসব মানুষ, তার কোনো হদিসও পাওয়া গেল না সংবাদমাধ্যমে। কেবল বলা হচ্ছে, সেখানে জনজীবন আগের মতো স্বাভাবিক নেই। ব্যবসা-বাণিজ্যের অবস্থাও খারাপ।
এর মধ্যে স্থানীয় ত্রিপুরারা জানাচ্ছেন, কুকি-চিন বলে অনেক ত্রিপুরাকেও আটক করা হয়েছে। সত্য হলে, এসব নিশ্চয়ই পাহাড়ি সমাজে জটিলতা বাড়াচ্ছে। বরাবরই দক্ষিণ এশিয়ায় জাতিগত সংঘাতের ইতিহাস একধরনের অন্ধকারাচ্ছন্ন একমুখী সড়কের মতো। সংখ্যাগুরু সমাজের আন্তরিক ও সুচিন্তিত চেষ্টা ছাড়া যার নিদান নেই।
স্বায়ত্তশাসনচর্চায় ‘চিনল্যান্ড’
মণিপুর ও বান্দরবানের তুলনায় চিন প্রদেশের জোরা ভিন্ন ধাঁচের এক সময় পার করছে। পাহাড়ি প্রদেশটির কুকি-চিনরা বহুকাল প্রকৃত স্বায়ত্তশাসনের জন্য সংগ্রাম করছে। দেশটির প্রধান জাতিসত্তা বামারদের সঙ্গে পেরে উঠছিল না তারা। ২০২১ থেকে যখন গণতন্ত্রের প্রশ্নে মিয়ানমারে শুরু হওয়া গৃহযুদ্ধের সুযোগ নেয় কুকি-চিনদের বড় একাংশ। চিন প্রদেশের অনেকখানি মুক্তাঞ্চলও বানিয়েছে তারা।
ভারত সীমান্তবর্তী স্থলবন্দরগুলো অনেকটাই এখন সশস্ত্র চিনদের দখলে। সংবিধান, প্রশাসন, বিচার ও শিক্ষাব্যবস্থাও গড়ে তুলেছে নিজেদের ভাবনাচিন্তায়। চিন প্রদেশ এভাবে দ্রুত ‘চিনল্যান্ড’ হয়ে যাচ্ছে। গত ডিসেম্বরে ‘চিনল্যান্ডে’র প্রথম রাজনৈতিক সম্মেলন হলো ঐতিহাসিক শহর ক্যাম্প ভিক্টোরিয়ায়।
মিয়ানমারে জান্তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া ‘জাতীয় ঐক্য সরকার’ (এনইউজি)–এর নেতারাও বেশির ভাগ চিনল্যান্ডে থাকেন এখন। চিনল্যান্ড ন্যাশনাল ফ্রন্ট (চিএনএফ) এবং এনইউজি রীতিমতো চুক্তি করে রাজনৈতিক সম্পর্ক পাতিয়েছে।
সংখ্যাগুরু জাতির সঙ্গে সংখ্যালঘু জাতির প্রতিনিধিদের এ রকম চুক্তি এ অঞ্চলে এই প্রথম। এতে তাঁরা উভয়েই লাভবান হচ্ছেন। মিয়ানমারে গণতন্ত্রের সংগ্রাম বিজয়ী হলে চিন-বামার ওই চুক্তির চূড়ান্ত সুফল দেখা যাবে। চিনের রাজনীতিবিদ এল এইচ সেখং এনইউজির হয়ে পুরো মিয়ানমারের জন্য নতুন সংবিধান লিখছেন।
চিনে জো জাতির ভেতর বেশ কটি উপশাখা রয়েছে। ৪০টির মতো ভাষায় কথা বলেন এখানকার পাহাড়ের মানুষ। স্থানীয় নানান বিষয়ে এদের দ্বন্দ্ব-বিবাদও আছে এবং সব জো চিনল্যান্ড কাউন্সিলে যুক্তও হননি। কিন্তু এই মুহূর্তে সাধারণভাবে তাঁরা সবাই বেশ স্বায়ত্তশাসন ভোগ করছেন।
এই জোরা এখন মিজোরাম ও বান্দরবানের সঙ্গে স্বতন্ত্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্যও করতে চাইছেন। বিষয়টি আশপাশের কোনো কোনো দেশের জন্য অস্বস্তিকর। কারণ, চিন-মিজোরাম-বান্দরবানজুড়ে ব্যবসা-বাণিজ্যের ভিন্ন রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় তাৎপর্যও আছে। অর্থনীতি যে অনেক সময় রাজনীতি ও ধর্মকেও তার বিকাশে সঙ্গে নেয়, সেটি অসত্য নয়।
জোদের নেতৃত্বে মিজোরাম
চিএনএফ এবং মিজোরামের এমএনএফ (মিজো ন্যাশনাল ফ্রন্ট) হলো পুরো কুকি জগতের দুটি প্রধান জাতীয়তাবাদী সংগঠন। মণিপুরের কুকিদেরও একটি সশস্ত্র সংগঠন আছে কেএনও বা কুকি ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন নামে। চিএনএফ ও কেএনও গঠিত হয়েছিল একই বছর, ১৯৮৮ সালে।
চিএনএফ এখনো প্রবলভাবে সশস্ত্র ধরনের হলেও মিজোদের এমএনএফ নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে চলে এসেছে। মণিপুর দাঙ্গার পর কেএনও কর্মীরা আবারও অস্ত্র ব্যবহার করছেন বলে খবর আছে। দাঙ্গার আগপর্যন্ত তাঁরা ভারত সরকারের সঙ্গে অস্ত্রবিরতিতে ছিল।
সীমান্তের ওদিকের এ রকম অস্থিরতার মধ্যেই পার্শ্ববর্তী বান্দরবানে একই রকম আরেক সংগঠন কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট নিয়ে আলোচনা উঠেছে। জো জগতের আলোচ্য চারটি সংগঠনের মধ্যে কোনো যোগসূত্র আছে কি না, সেই বিতর্ক এ মুহূর্তে যতটা গুরুত্ব পাচ্ছে, ততটাই আড়ালে পড়ে আছে, কী ধরনের আর্থসামাজিক পরিবেশে বিভিন্ন দেশে বিভক্ত হয়ে থাকা জো সমাজে সশস্ত্রতার ব্যাপারগুলো দানা বাঁধল।
দেশি-বিদেশি গবেষকদের সূত্রে দেখা যায়, একদা জো সমাজে অর্থনৈতিক ও সামাজিক বঞ্চনা এবং প্রান্তিকতার আরেক পার্শ্বফল হিসেবে খ্রিষ্টধর্মের বিকাশ শুরু হয়েছিল।
মিয়ানমারের চলমান গৃহযুদ্ধে গণতন্ত্রপন্থীদের সঙ্গে পশ্চিমের নাগরিক সমাজের যোগাযোগ মূলত চিনল্যান্ড ও মিজোরামের যাজকদের মাধ্যমে। তবে জো বা কুকিদের সমস্যা ‘খ্রিষ্টত্ব বনাম হিন্দুত্ব’র কিংবা ‘খ্রিষ্টত্ব বনাম বৌদ্ধধর্মীয়’ সমস্যা নয়। এ হলো যার যার জনপদে প্রত্যাশিত প্রশাসনিক অংশীদারত্বের ঘাটতি ও দারিদ্র্যজনিত সমস্যা।
ধর্ম ও স্বায়ত্তশাসন বিতর্ক
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি জো সমাজকে বেশ কটি দেশে বিভক্ত করে যে ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটিয়ে গেছে, তার মৃদু কিছু ক্ষতিপূরণ হতে পারত এলাকার প্রশাসনে এসব মানুষের কার্যকর সামাজিক-অর্থনৈতিক অংশগ্রহণের সুযোগ ঘটলে। আইজল, ইম্ফল কিংবা ক্যাম্প ভিক্টোরিয়া—সর্বত্র জো নেতাদের ও রকম মত। সেটি হয়তো ধীরে ধীরে হবে।
তবে প্রতিটি দেশে সংখ্যালঘুর শাসনতান্ত্রিক অধিকারের দাবি সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে অতি স্পর্শকাতর প্রসঙ্গ। বরং আঞ্চলিক অনেক শক্তি এ রকমও ভাবে, কুকি অঞ্চলে ‘ভারসাম্য’ আনতে অন্যান্য ধর্মের প্রভাব বাড়াতে হবে। এই সূত্রেই একদা মণিপুরে মেইতেইদের সঙ্গে আরএসএসের মৈত্রী বেড়েছিল। আবার কুকিদের কেএনও’ও সেখানে একদা বিজেপিকেই রাজনৈতিক সমর্থন দেয়। এই সবই ‘স্বার্থের সম্পর্ক’ এবং প্রতিনিয়ত তার ধরন বদলাচ্ছে সীমান্তের এদিকে-ওদিকে।
মণিপুরে আরএসএসের মনোযোগ বাড়ার একটা ফল হলো ২০১২ সালেও যে মণিপুরে বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি কোনো আসন পায়নি, তারাই পরের নির্বাচনে ২১টি আসন পায় এবং ক্রমে এখন সেখানে সরকার চালাচ্ছে।
অপর দিকে একই সময়ে ৬০ আসনের বিধানসভায় কংগ্রেসের শক্তি কমতে কমতে ৪২ থেকে ৫–এ এসে দাঁড়িয়েছে। তবে আরএসএস মণিপুরে হিন্দু মেইতেইদের প্রতি বেশি পক্ষপাত দেখাতে গিয়ে পরিস্থিতির ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে ইতিমধ্যে এবং এভাবে পুরো কুকি জগতেও প্রবল ঝাঁকুনি তৈরি হয়েছে।
সব মিলে দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় হিন্দিভাষী, বাংলাভাষী এবং বার্মিজদের ত্রিমুখী সংখ্যাগরিষ্ঠতার মুখে থাকা কুকি-চিন-মিজো-বমদের শান্তি ও স্বস্তির নিরিবিলি পুরোনো দিনে ফিরে যাওয়া আগামী দিনে কতটা সম্ভব হবে, সে বিষয়ে অনেক অনিশ্চয়তা।
তবে এর মধ্যে মণিপুরে শান্তি ফেরাতে কুকিদের এলাকায় তাদের দাবিমতো যদি নতুন একটা ‘রাজ্য’ হয়, তাহলে চিন ও মিজোরামের পাশাপাশি জোদের তৃতীয় আরেক ঠিকানা হবে। এ ঘটনার আঞ্চলিক তাৎপর্যও থাকবে অবশ্যই। অনেকেই একে জো সাহিত্য-সংস্কৃতির অধরা ‘জালেন-গাম’ ধারণা দিয়েও ব্যাখ্যা করতে চাইবেন।
গত ১২ মাসে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কুকি-বিশ্ব প্রকৃতই ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায়ে প্রবেশ করল। দেখার ব্যাপার, অশান্তির সময় পেরিয়ে সামনে তারা ঐক্য ও অর্জনের পরিসর বাড়াতে পারে কি না?
●আলতাফ পারভেজ দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাসবিষয়ক গবেষক