বাংলাদেশের মানুষ এক নতুন ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা শুরু করেছেন। জুলাই ও আগস্ট মাসজুড়ে এই গণ–অভ্যুত্থানে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের অবদান ভবিষ্যতের মানুষ চিরকাল স্মরণ করবে।
রূপান্তরের এই প্রধান কৃতিত্ব সন্দেহাতীতভাবেই শিক্ষার্থী সমাজের। তারপর তাঁদের আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন শ্রমজীবী জনতা, মধ্যবিত্ত সমাজ ও সমাজের সব অংশের পেশাজীবী কর্মজীবী মানুষ। অকাতরে তাঁরা প্রাণ দিয়েছেন, লড়াই করেছেন, ঢাল হয়ে তাঁরা আন্দোলনকে রক্ষা করেছেন। এই বিজয় তাই সত্যিকার অর্থেই জনগণের বিজয়।
আমরা সবাই জানি, বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বিপুল এই গণ–অভ্যুত্থান ঘটেছে অনির্বাচিত ও জবাবদিহিহীন যে স্বৈরশাসন শেখ হাসিনা কায়েম করেছিলেন, তার বিরুদ্ধে। রাষ্ট্রীয় বাহিনীগুলো গুম, খুন ও নিপীড়নের এক ত্রাসের রাজত্ব এখানে চিরস্থায়ী করার চেষ্টা করেছিল। উন্নয়নের নামে দুর্নীতিতে আক্রান্ত মহা প্রকল্পগুলো দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছিল।
একদিকে ক্ষমতা ঘনিষ্ঠ মানুষদের বিপুল অর্থ পাচার, আরেক দিকে ‘মাছ, মাংস আর চালের স্বাধীনতা’ চাওয়া মানুষেরা—এই দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল গোটা জাতি। আমরা দেখেছি সৎ সাংবাদিকতার ওপর ভয়াবহ নিপীড়ন, আরেক দিকে তোষামোদী সাংবাদিকতা।
বাংলাদেশের মানুষের তাই চাওয়া ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা, গণমাধ্যমের কথা বলার স্বাধীনতা, সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে নাগরিকদের কথা বলার স্বাধীনতা। প্রতিবাদ করলে পুলিশের নিপীড়নের মুখোমুখি না হওয়ার নিশ্চয়তা। শিক্ষার্থীরা যেন গণরুম, গেস্টরুমের নির্যাতনমুক্ত হয়ে দেশ-জাতি নিয়ে ভাবতে পারেন, কথা বলতে পারেন, তার অধিকার।
দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন পরিকল্পনা যেন স্বচ্ছতার সঙ্গে জনগণের চাহিদার সঙ্গে সংগতিপূর্ণভাবে হয়, সেই বন্দোবস্ত। এই সবকিছুর জন্যই চাই গণতন্ত্র। বাংলাদেশের মানুষ এই আন্দোলনে বুকের রক্ত ঢেলে সেই গণতন্ত্রেরই সংগ্রাম করেছেন।
এই যুগসন্ধিক্ষণে যেন আমরা ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যেতে পারি, সেটা নিশ্চিত করা আজকের বাংলাদেশের প্রত্যেক দেশপ্রেমিক মানুষের কর্তব্য। ইতিহাসের এই ডাকে সাড়া দিয়ে নতুন এক বাংলাদেশ গড়ে তোলার যুদ্ধে শামিল হোন।
আন্দোলনের একজন মানুষ হিসেবে আমাদের কাছে যখনই জানতে চাওয়া হয়েছে, শেখ হাসিনার পতনের পর করণীয় কী? আমরা একটাই উত্তর দিয়েছি, শিক্ষার্থী এবং জনগণের চাওয়ার বাইরে আর কোনো কিছু করা যাবে না। তাঁদের সঙ্গে আলাপের ভিত্তিতেই একটা অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করতে হবে।
যাঁদের প্রধান কর্তব্য হবে দেশকে একটা গণতান্ত্রিক নির্বাচন উপহার দেওয়া। আর নতুন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দায়িত্ব হবে রাষ্ট্রকাঠামোর সেই সব সংস্কার করা, যাতে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে পুনঃ সংস্কার করা যায় এবং এমন নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত নির্মাণ করা, যাতে কারও আর নতুন করে স্বৈরশাসক কিংবা জবাবদিহিবিহীন ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার সুযোগ না থাকে।
এই বাংলাদেশ বিনির্মাণও নিশ্চয়ই জনগণের সবগুলো অংশের প্রতিনিধিদের সম্মতি ও জনপ্রতিনিধিত্বের ভিত্তিতেই সম্ভব হবে। তার জন্য প্রয়োজনীয় সংবিধানিক সংস্কার, প্রশাসনিক সংস্কারও আজ জনগণের দাবির মধ্যে আমরা দেখতে পেয়েছি।
তবে এই মুহূর্তে বাংলাদেশকে নাশকতা, হামলা আর ফিরে আসার ষড়যন্ত্রের মোকাবিলা করতে হতে পারে। বাংলাদেশের কোনো কোনো এলাকায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দিরে হামলার ঘটনা ঘটেছে, কোথাও কোথাও সম্পত্তি দখল, অগ্নিসংযোগ কিংবা হুমকি প্রদানের সংবাদও আমরা পেয়েছি। এ ছাড়া আছে ব্যক্তিগত প্রতিশোধের ঘটনাও। রাষ্ট্রীয় স্থাপনাগুলোও এই সময়ে হুমকির মুখে পড়েছে।
আমরা জোরগলায় বলতে চাই, ধর্ম–বর্ণ–সম্প্রদায়নির্বিশেষে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ যেন নিজেকে নিরাপদ মনে করেন, সেটা নিশ্চিত করাটা আজ প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটি হত্যাকাণ্ড, গুম-খুনের বিচার করতে হবে, প্রত্যেক দুর্নীতিবাজকে আইনের আওতায় আনতে হবে। কিন্তু কোনো প্রতিশোধ গ্রহণ করা যাবে না। আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়া যাবে না।
পুলিশ বাহিনীকে পুনঃ সংস্কার করতে হবে, কিন্তু তাকে কাজও করতে দিতে হবে। সর্বোপরি একটা অরাজক পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে পরাজিত শক্তি যেন দ্বিগুণ সংগঠিত হয়ে ফিরে না আসতে পারে, সেটাও নিশ্চিত করতে হবে।
তাই আমরা আহ্বান জানাই, এলাকায় এলাকায় স্বেচ্ছাসেবী বাহিনী গঠন করে আর যেন কোনো অগ্নিসংযোগ, হামলা বা নিপীড়নের ঘটনা না ঘটে, সেটা নিশ্চিত করুন। বিশেষ করে তরুণদেরই এই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। একই সঙ্গে ঘটনা প্রবাহের দিকে সতর্ক নজর রেখে নিজেদের আরও বেশি সচেতন ও রাজনীতিমনস্ক হয়ে উঠতে হবে।
এই যুগসন্ধিক্ষণে যেন আমরা ভবিষ্যতের স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যেতে পারি, সেটা নিশ্চিত করা আজকের বাংলাদেশের প্রত্যেক দেশপ্রেমিক মানুষের কর্তব্য। ইতিহাসের এই ডাকে সাড়া দিয়ে নতুন এক বাংলাদেশ গড়ে তোলার যুদ্ধে শামিল হোন।
জোনায়েদ সাকি গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী