ইউক্রেনের জন্য কোরিয়া স্টাইলের যুদ্ধবিরতি চুক্তি?

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হাতে খেলার জন্য অনেক কার্ড রয়ে গেছে।ছবি : রয়টার্স

দ্য নিউইয়র্ক টাইমসের খবরে জানানো হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা ইউক্রেনে যুদ্ধবিরতির জন্য একটা পরিকল্পনা তৈরি করেছেন। ১৯৫৩ সালে কোরিয়া যুদ্ধ যেভাবে শেষ হয়েছিল, তার আলোকে একটি প্রস্তাব তৈরি করা হয়েছে। যাহোক, কোরিয়ার মতো কোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তি রাশিয়ার লক্ষ্যের সঙ্গে মিলবে না। সম্ভবত এ কারণেই অস্ত্রবিরতির মধ্যে চুক্তিটাকে সীমাবদ্ধ রাখলে সেটা অর্জন করা সম্ভব হবে না।
যুক্তরাষ্ট্র, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে দীর্ঘ আলাপ–আলোচনা শেষে ১৯৫৩ সালে কোরিয়ার যুদ্ধ সমাপ্তির একটি চুক্তিতে পৌঁছানো সম্ভব হয়েছিল। সেই পথ ছিল খুব কঠিন। যাহোক, সেই চুক্তির মূল বিধিগুলো ছিল নিম্নরূপ:

এক. চার হাজার মিটার প্রশস্ত অঞ্চল থেকে সব সেনা ও সামরিক সরঞ্জাম সরিয়ে নেওয়া এবং দুই দেশের বাহিনীর মধ্যে একটা নিরপেক্ষ অঞ্চল তৈরি করা;

দুই. দুই পক্ষের কেউই অন্যের আকাশ, স্থল ও সমুদ্র অঞ্চলে প্রবেশ করবে না;

তিন. যুদ্ধবন্দী ও বাস্তুচ্যুতদের জন্য মুক্তি ও প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়া শুরু করা;

চার. যুদ্ধবিরতি চুক্তিগুলো পালন করে হচ্ছে কি না কিংবা লঙ্ঘন হচ্ছে কি না, তার জন্য একটি সামরিক যুদ্ধবিরতি কমিশন গঠন।

কোরিয়ার যুদ্ধবিরতির বয়স এখন ৭২ বছর। এই চুক্তির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলো, সাত দশকের বেশি সময় ধরে উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে সংঘাত বন্ধ করা গেছে।

ইউক্রেনের ইস্যুটি ভূখণ্ডগত, সামরিক ও রাজনৈতিক। ২০১৪ সালে ইউক্রেনের কাছ থেকে ক্রিমিয়া নিজেদের দখলে নিয়ে নেয়। ২০২২ সালের সেপ্টম্বর মাসে দোনেৎস্ক, লুহানৎস্ক, জাপোরিঝঝিয়া ও খেরসন প্রদেশ রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত করে নেয়। ক্রিমিয়ার সীমান্ত যেখানে খুব ভালোভাবে স্বীকৃত, কিন্তু অন্য চারটি প্রদেশের সীমান্ত এখনো এতটা স্পষ্ট নয়।

ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা বলছেন, এই অঞ্চলগুলোর কোনোটিতেই রাশিয়ার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেই। সেখানে রাশিয়া যুদ্ধ করছে, তার কারণ হলো, আলাপ–আলোচনা শুরু হওয়ার আগেই রাশিয়া চাইছে যতটা সম্ভব ভূখণ্ড নিজেদের দখলে নিতে।

ধরে নিই যে রাশিয়া–ইউক্রেনের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে একটি চুক্তি করা গেল; কিন্তু এ ক্ষেত্রে অনেকগুলো প্রশ্ন রয়েছে, যেগুলো জটিল।

যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকার জানে, ইউক্রেন এখন কতটা ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী একের পর এক যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে, জনবলের ঘাটতি রয়েছে, সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে অন্তুর্ভুক্তির বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রতিরোধ তৈরি হয়েছে।

এর মধ্যে যে সীমান্তরেখা টানা হবে, তার দুই পাশের নাগরিকদের কোনো ধরনের বৈষম্য ছাড়া অধিকার কেমন হবে, ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যকার বাণিজ্যের বিষয়টা কেমন হবে, জাপোরিঝঝিয়া পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ভবিষ্যৎ কী হবে, ইউক্রেন থেকে ক্রিমিয়ায় পানি সরবরাহব্যবস্থার কী হবে, কৃষ্ণসাগরের বন্দর ও গুদামের ব্যবহার কীভাবে হবে এবং কৃষ্ণসাগর ও আজভ সাগরের সামরিক ঘাঁটিগুলোর অবস্থা কী হবে—এসব প্রশ্নে সুরাহা করতে হবে। এ ছাড়া ইউক্রেনের হাতে থাকা দূরপাল্লার অস্ত্র ও ইউক্রেনের মাটিতে ন্যাটো সেনাদের উপস্থিতি—এ দুই বিষয়েরও মীমাংসা করা দরকার হবে।

এর সঙ্গে আরও কিছু বিষয়ের মীমাংসা করতে হবে। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীগুলোর মর্যাদা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটোয় ইউক্রেনের সদস্যপদ, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা এবং তেল–গ্যাস সরবরাহের ট্রানজিট ও রাশিয়ার ওপর আরোপ করা নিষেধাজ্ঞার প্রশ্নগুলোও এখানে রয়েছে।

১৯৫৩ সালে যখন দুই কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধবিরতি হয়েছিল, তখন জাতিসংঘের বাহিনীগুলো দক্ষিণ কোরিয়ায় অবস্থান করছিল। আর চীনের ‘স্বেচ্ছাসেবকেরা’ ছিলেন উত্তর কোরিয়ায়। কিন্তু ইউক্রেনের বাস্তবতা ভিন্ন। আনুষ্ঠানিকভাবে ইউক্রেনে ন্যাটোর কোনো বাহিনী নেই, যদিও ইউক্রেনে রাশিয়ান সেনাবাহিনী আছে।

এ–সংক্রান্ত অসংখ্য প্রতিবেদন বের হচ্ছে যে যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, এমনকি জার্মানিসহ ন্যাটোর আরও কয়েকটি দেশ যুদ্ধবিরত হলে ইউক্রেনের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেওয়ার জন্য সেনাদের প্রস্তুত করছে। এখানে সমস্যাটি হলো, যুদ্ধবিরতি তদারকির কাজে নিয়োজিত বাহিনী আর ইউক্রেনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার কাজে নিয়োজিত বাহিনী এক বিষয় নয়।

মূল মিনস্ক চুক্তির (২০১৪–১৫) আওতায় ওএসসিইর (অর্গানাইজেশন ফর সিকিউরিটি অ্যান্ড কো–অপারেশন ইন ইউরোপ) হাতে মিনস্ক চুক্তি তদারকির দায়িত্ব রয়েছে। ওএসসিই পর্যবেক্ষক পাঠাতে পারে, সেনা পাঠাতে পারে না। রাশিয়া, ইউক্রেনসহ ৫৭টি দেশ তখন ওএসসিইর সদস্য হয়েছিল। সেই চুক্তির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল বৈরিতার অবসান এবং লুহানৎস্ক ও দোনেৎস্ক অঞ্চলের (যদিও দুটি অঞ্চলই ইউক্রেনের ভেতরে থাকবে) স্বায়ত্তশাসন দেওয়। কিন্তু সেই চুক্তি কখনোই বাস্তবায়িত হয়নি।

আমরা যতটা বুঝি, তাতে দেখা যায় যে রাশিয়ার যুদ্ধ ও উদ্দেশ্য শুধু তাদের সেনাবাহিনী ইউক্রেনের যতটুকু ভূখণ্ড নিজেদের দখলে নিয়েছে, তার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; ইউক্রেনকে সামরিকভাবে নিষ্ক্রিয় করা এবং এমন একটা চুক্তির নিশ্চয়তা চায়, যেখানে ইউক্রেনকে ন্যাটোর সদস্যপদ না দেওয়া হয়।

এসব প্রশ্নের মীমাংসা করা ছাড়া যুদ্ধবিরতি চুক্তি করা কঠিন হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান হলো, রাশিয়া অর্থনৈতিকভাবে যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ইউক্রেন যুদ্ধে তাদের ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেশি হওয়ায় প্রণোদনার অংশ হিসেবে রাশিয়া যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব মেনে নেবে। যুক্তরাষ্ট্র মনে করছে, কিছু নিরপেক্ষ অঞ্চল প্রতিষ্ঠা করে এবং ইউক্রেনের কিছু ভূখণ্ড পাকাপাকিভাবে নয়, কার্যত রাশিয়ার হাতে ছেড়ে দেওয়ার মাধ্যমে এই চুক্তি করে ফেলবে। এসব প্রেক্ষাপটে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের যুদ্ধবিরতি চুক্তিটি ১৯৫৩ সালের কোরিয়া যুদ্ধবিরতির চুক্তির মতোই হবে।

নিশ্চিত করেই রাশিয়ার দৃষ্টিভঙ্গি ওয়াশিংটনের চিন্তার সঙ্গে মিলবে না। রাশিয়া শুধু একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি করতে চায় না; মস্কো যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সঙ্গে সমন্বিত চুক্তি করতে চায়।

একটি অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি চুক্তি (মূলত একটি অস্ত্রবিরতি) সম্ভব হতে পারে, যদি সেটি সব পক্ষের সম্মতিতে রাজনৈতিক পদক্ষেপের মধ্য দিয়ে হয়। কিন্তু এটি দীর্ঘমেয়াদি সমাধান হিসেবে গ্রহণ করা অসম্ভব বলে মনে হয়। সদ্য বিদায়ী বাইডেন প্রশাসন ১০ কিংবা ২০ বছর মেয়াদি যুদ্ধবিরতির কথা ভেবেছিল। কিন্তু সেটা রাশিয়ার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। তার কারণ হলো, ইউক্রেন এ সময় নিজেদের সামরিক শক্তি বাড়ানোর সুযোগ পেয়ে যাবে।

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের হাতে খেলার জন্য অনেক কার্ড রয়ে গেছে। তিনি ইউক্রেনকে আরও বেশি সহায়তা পাঠাতে পারেন, সংঘাত আরও দীর্ঘায়িত করতে পারেন। যদিও ট্রাম্পের লক্ষ্য এটা কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়ে গেছে। ট্রাম্প রাশিয়ানদের নিষেধাজ্ঞা কিছুটা শিথিল করতে পারেন। এমনকি ন্যাটোর জন্যও কিছুটা জায়গা দিতে পারেন।

একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন সরকার জানে, ইউক্রেন এখন কতটা ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে। ইউক্রেনের সামরিক বাহিনী একের পর এক যুদ্ধে হেরে যাচ্ছে, জনবলের ঘাটতি রয়েছে, সেনাবাহিনীতে বাধ্যতামূলকভাবে অন্তুর্ভুক্তির বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে ব্যাপক প্রতিরোধ তৈরি হয়েছে।

কী হতে যাচ্ছে, সেটা এখনই অনুমান করা কঠিন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছার কথা ইঙ্গিত দিয়েছেন। কয়েক দিনের মধ্যে আমরা একটা ফোনালাপ দেখতে পারি। ট্রাম্প একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তির ধারণা আলোচনার জন্য নিয়ে আসতে পারেন। কিন্তু রাশিয়ার দিক থেকে আরও বেশি কিছু দাবি করা হবে।

  • স্টিফেন ব্রায়েন এশিয়া টাইমসের বিশেষ প্রতিনিধি এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নীতিবিষয়ক সাবেক ডেপুটি আন্ডার সেক্রেটারি
    এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত