বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় পরিবর্তনশীল, কিন্তু সহজ একটি ধারণা উপস্থাপন করেছেন। এর মধ্যে ‘তিনটি শূন্যতা’ কাঠামোর প্রেক্ষাপটে জরুরি নীতিমালা প্রণয়নের জন্য গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। তিনটি শূন্য হলো: ক) দারিদ্র্য শূন্যতা, খ) বেকারত্ব শূন্যতা ও গ) কার্বন নির্গমন শূন্যতা। এগুলো নিশ্চিত করা না গেলে বিশ্ব টেকসই উন্নয়নের দিকে এগিয়ে যেতে পারবে না।
এই দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান নিজেদের অগ্রাধিকার অনুযায়ী ‘তিনটি শূন্যতা’ নির্ধারণ করতে পারে। বাংলাদেশের পরিবেশগত উন্নয়নের জন্য মনোযোগ দিতে হবে প্লাস্টিক শূন্যতা, শব্দদূষণ শূন্যতা ও সিসা শূন্যতার দিকে। এসব নীতি পরিবেশ কর্মসূচিতে কার্যকরভাবে অন্তর্ভুক্ত করা হলে বাংলাদেশ ২০২৫ সালের মধ্যে একটি সুস্বাস্থ্যসম্পন্ন, পরিবেশবান্ধব ও টেকসই জাতি গঠনের দিকে অগ্রসর হতে পারবে।
পৃথিবীজুড়ে ৯ দশমিক ২ বিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য তৈরি হয়। এর মধ্যে ৭ বিলিয়ন টন মাটিচাপা (ল্যান্ডফিল) দেওয়া হয় বা অবহেলিতভাবে ফেলে দেওয়া হয়। এই প্লাস্টিক বর্জ্য এক বৃহত্তর পরিবেশগত সংকট। বিশেষ করে বাংলাদেশের জন্য।
প্লাস্টিক দূষণ পরিবেশগত অবনতি, জনস্বাস্থ্যগত ঝুঁকি এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। সেই সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তন ও বাস্তুতন্ত্রের অকার্যকারিতার ক্ষেত্রে এর ক্ষতিকর প্রভাব আছে। বিশ্বব্যাংকের ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী, প্রধানত অপ্রতুল বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কারণে বাংলাদেশ প্লাস্টিক দূষণের শীর্ষ দেশগুলোর মধ্যে স্থান পেয়েছে। ঢাকায় বার্ষিক মাথাপিছু প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ ২২ দশমিক ২৫ কেজি।
এই পরিমাণ গ্রামীণ এলাকার চেয়ে তিন গুণ বেশি। বোঝাই যাচ্ছে, শহর অঞ্চলে পরিবেশগত চাপ অনেক বেশি। সাম্প্রতিক সময়ে প্লাস্টিক ব্যাগ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু এসব উদ্যোগের কার্যকারিতা বাস্তবায়নগত দুর্বলতার কারণে কম। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা করছে। এই মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি এ সংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
ত্বরান্বিত করছে পরিবেশগত ক্ষতি। সম্পূর্ণ প্লাস্টিকমুক্ত ভবিষ্যৎ এ মুহূর্তে বাস্তবসম্মত নয়। তবে বাংলাদেশকে প্লাস্টিক ব্যবহারের পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমানোর এবং দূষণ দূর করার লক্ষ্যে কাজ করতে হবে। একটি ব্যাপক ও সমন্বিত পদ্ধতির মাধ্যমে ২০২৫ সালের মধ্যে প্লাস্টিক দূষণ হ্রাসের লক্ষ্য নিয়ে একটি টেকসই প্লাস্টিক ব্যবস্থাপনা জাতির পরিবেশগত কৌশলের ভিত্তি হওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
প্লাস্টিকের সঙ্গে বাংলাদেশে পরিবেশগত আরেকটি বড় সমস্যা শব্দদূষণ। এই দূষণে জনগণের স্বাস্থ্যর ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলছে। সম্প্রতি ঢাকা মহানগরকে বিশ্বব্যাপী ৬১টি সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ নগরীর মধ্যে সবচেয়ে শব্দদূষণের শহর হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। জাতিসংঘ পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) একটি প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকার গড় শব্দের মাত্রা ১১৯ ডেসিবেল পর্যন্ত পৌঁছেছে।
এই মাত্রা সহনীয় মানের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি। রাজধানীর ৬৫ শতাংশ ট্রাফিক পুলিশ দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ শব্দমাত্রার কারণে শ্রবণ ও ঘুমের ব্যাঘাতজনিত সমস্যায় ভোগার কথা জানিয়েছেন। দীর্ঘস্থায়ী শব্দের প্রভাবজনিত স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ভুগছেন নাগরিকেরা। এর মধ্যে আছে বিরক্তি, ঘুমের ব্যাঘাত এবং আরও গুরুতর পরিণতি। যথা হৃদ্রোগ ও বিপাকীয় ব্যাধি। সেই সঙ্গে শিশুদের শব্দদূষণে দীর্ঘকালীন উপস্থিতি তাদের মধ্যে জ্ঞানসংক্রান্ত ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধকতা তৈরি করে।
এসব সমস্যার সমাধান জাতীয়ভাবে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। ২০২৫ সালের মধ্যে শব্দদূষণবিহীন বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে শক্তিশালী নীতিমালা প্রণয়ন, জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং শব্দদূষণ–সংক্রান্ত আইনকানুনের ফলপ্রসূ প্রয়োগ আশু প্রয়োজন।
প্লাস্টিক শূন্যতা, শব্দ শূন্যতা ও সিসা শূন্যতা’র কাঠামোটি গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার পূর্ণ সম্ভাবনা উন্মোচন করতে পারে। এর মধ্য দিয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাস করতে পারে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে সামঞ্জস্য স্থাপন করতে পারে।
সিসাদূষণ বাংলাদেশে জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য একটি ক্রমবর্ধমান হুমকি তৈরি করছে। তিন চাকার বৈদ্যুতিক যানবাহনের (যেমন ইজিবাইক ও ই-রিকশা) দ্রুত প্রসার শহুরে গতিশীলতায় বিপ্লব ঘটিয়েছে। বাংলাদেশে প্রতিদিন ৩ থেকে ৪ মিলিয়ন যানবাহন ১১২ মিলিয়নের বেশি যাত্রী পরিবহন করে। এই সংখ্যা বিশ্বব্যাপী টেসলাবহরের চেয়ে বেশি।
যাহোক, এসব যানকে চালনার শক্তি দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারির (এলএবি) ওপর নির্ভরতা গুরুতর পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। এর মূল কারণ, টেকসই ব্যবস্থাপনার অভাব ও ব্যবহৃত সিসা-অ্যাসিড ব্যাটারির (ইউএলএবি) অনানুষ্ঠানিক পুনর্ব্যবহার। প্রতিটি যান চালনায় ব্যবহৃত হয় ৪ থেকে ৫টি এলএবি, যা বাহনপ্রতি ১২৫ কেজি সিসা বহন করে।
উদ্বেগজনকভাবে, এসব ব্যাটারির মাত্র ১০-২০ শতাংশ আনুষ্ঠানিক চ্যানেলের মাধ্যমে পুনর্ব্যবহৃত হয়। বাকি ৮০ শতাংশ পুনর্ব্যবহার করা হয় অনানুষ্ঠানিকভাবে, যা বছরে আনুমানিক ১ লাখ ৬৭ হাজার মেট্রিক টন সিসা বর্জ্য উৎপাদনের জন্য দায়ী। এই অনানুষ্ঠানিক পুনর্ব্যবহার খাত একটি নীরব, কিন্তু বিধ্বংসী স্বাস্থ্যসংকট তৈরি করেছে।
দ্য ল্যানসেট জার্নালের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রতি তিনটি শিশুর মধ্যে দুজনের রক্তে উচ্চমাত্রায় সিসা রয়েছে। এর ফলে তাদের জ্ঞানীয় উন্নয়ন, মনোযোগ ও শিক্ষার ফলাফলের ক্ষেত্রে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। সিসার বিষক্রিয়া আইকিউ স্তর হ্রাস করে, আয়ের সম্ভাবনা ও জীবনযাত্রার মান কমিয়ে দেয়। সিসা সংস্পর্শের সঙ্গে সম্পর্কিত কার্ডিওভাসকুলার রোগ জনস্বাস্থ্যের জন্য একটি জরুরি উদ্বেগে পরিণত হয়েছে। বছরে আনুমানিক ৬০ হাজার মানুষের হৃদ্রোগে মৃত্যু হয়, যা সম্ভবত ১ লাখ ৩৮ হাজার ৫৪ জনে বৃদ্ধি পেতে পারে। বাংলাদেশ সিসাদূষণ মোকাবিলায় উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিয়েছে, যেমন পুনরুদ্ধার প্রকল্প, উৎস শনাক্তকরণ ও সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ।
বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, যেমন বেঞ্চমার্কিং অ্যাসেসমেন্ট টুল (বিএটি), পরিবেশগতভাবে সাউন্ড ম্যানেজমেন্ট (ইএসএম) ও অ্যাপভিত্তিক প্রয়োগ কৌশলের মতো বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ কর্মসূচি নিয়ন্ত্রক অনুশীলন শক্তিশালী করতে এবং সরকারি কর্মকর্তাদের জ্ঞান বৃদ্ধির সুযোগ দেবে। এই প্রচেষ্টা সিসাদূষণ হ্রাস, টেকসই পুনরুদ্ধার উদ্দীপিতকরণ এবং সমাজের মধ্যে স্থিতিস্থাপকতা গড়ে তোলার জন্য একটি আশাব্যঞ্জক পথ উপস্থাপন করবে।
বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও প্লাস্টিক, শব্দ ও সিসাদূষণ মোকাবিলার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, উদ্ভাবন ও স্বাস্থ্যকর জীবনধারার দিকে নিয়ে যেতে পারে। টেকসই বিকল্পের মাধ্যমে প্লাস্টিক প্রতিস্থাপন, উন্নত স্বাস্থ্যের জন্য শব্দ হ্রাস এবং বৈদ্যুতিক যানবাহন খাতের রূপান্তর সম্মিলিতভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় প্রত্যাবর্তনে ও অগ্রগতিসাধনে সহায়ক হতে পারে। ‘
প্লাস্টিক শূন্যতা, শব্দ শূন্যতা ও সিসা শূন্যতা’র কাঠামোটি গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ তার পূর্ণ সম্ভাবনা উন্মোচন করতে পারে। এর মধ্য দিয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাস করতে পারে এবং টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) অর্জনে সামঞ্জস্য স্থাপন করতে পারে। একটি শক্তিশালী নীতিমালা কাঠামো ও সামাজিক সম্পৃক্ততা তৈরি করতে পারে টেকসই বাস্তুতন্ত্র। আর এর মধ্য দিয়ে পরিবেশ, অর্থনীতি ও জলবায়ুর অভিযোজনপ্রবণতা হবে সহজ। আর এগুলো বাংলাদেশের মানুষের অধিকতর স্বাস্থ্যকর ও অধিকতর টেকসই ভবিষ্যতের দিকে যাওয়ার জন্য অনিবার্য।
মাহফুজার রহমান পরিবেশকর্মী ও কান্ট্রি ডিরেক্টর, পিউর আর্থ
[email protected]