গত ফেব্রুয়ারি মাসে রাশিয়া ও সৌদি আরব তাদের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের ৯৮তম বার্ষিকী উদ্যাপন করেছে। ১৯২৬ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রথম হিজাজ ও নজদ সাম্রাজ্যের সঙ্গে প্রথম পরিপূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করেছিল।
অতিসম্প্রতি প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ছয় বছরের জন্য তাঁর ক্ষমতা সুসংহত করেছেন। আবার যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমানকে বাদশা সালমান ২০২২ সালে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছেন। তাঁদের দুজনের নেতৃত্ব আগামী দিনে স্থিতিশীল থাকবে বলে মনে হয়।
আধুনিক রাশিয়ার সঙ্গে সৌদি আরবের সম্পর্ক ১৯৯২ সালে স্থাপিত হলেও দুই দেশের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক বাদশা সালমান ও পুতিনের অধীন ২০১৭ সালে নতুন পর্যায়ে পৌঁছায়। মস্কোয় সৌদি বাদশার প্রথম সফরটিকে অনেকে ঐতিহাসিক সফর বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। দ্য গার্ডিয়ান সেটিকে ‘বৈশ্বিক ক্ষমতাকাঠামো পরিবর্তনের ঘোষণা’ বলে বর্ণনা করেছিল। সেই সফরে কয়েক বিলিয়ন ডলারের ১৫টির বেশি সহযোগিতা চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। এর মধ্যে সামরিক, তেল ও মহাশূন্য খাতে সহযোগিতার চুক্তি ছিল উল্লেখযোগ্য।
সেই সময়ে সৌদি আরব রাশিয়ার কাছ থেকে এস-৪০০ মিসাইল প্রতিরক্ষাব্যবস্থা কিনতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চুক্তিটি চূড়ান্ত হয়নি। পরে সৌদি আরব আমেরিকান টার্মিনাল হাই অ্যালটিচুড এরিয়া ডিফেন্স সিস্টেম ১৫ বিলিয়ন ডলার দিয়ে কিনেছিল। সৌদি আরব এখন বিশ্বের সব পরাশক্তির সঙ্গে ‘ঝুঁকি’ না নিয়ে সম্পর্ক উন্নয়নের সামগ্রিক একটা নীতি নিয়েছে।
সৌদি আরবের এই রক্ষণাত্মক কৌশল রাশিয়া ও সৌদি আরবের মধ্যে ইতিবাচক সম্পর্ক উন্নয়নে কোনো ক্ষতি করবে না। পুতিন ২০১৯ সালে সৌদি আরব সফর করেন। ২০০৭ সালের পর সেটা ছিল পুতিনের প্রথম সফর। তেল চুক্তির মধ্য দিয়ে সফরটি শেষ হয়েছিল। ২০২৩ সালে পুতিন সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরব সফর করেন। তাঁর এ সফরের আগে রাশিয়ার গণমাধ্যম ব্লুমবার্গে প্রকাশিত নিবন্ধ ‘পুতিন উপসাগরীয় অঞ্চলে সফরে যাচ্ছেন ওপেকপ্লাস চুক্তির ফসল কাটতে’ ফলাও করে প্রকাশ করে। এর অর্থ হচ্ছে, পুতিনের সৌদি সফর মস্কোকে একঘরে করার যুক্তরাষ্ট্রের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।
২০১৪ সালে আর্জেন্টিনায় অনুষ্ঠিত জি-২০ সম্মেলনে পুতিন ও যুবরাজের মধ্যকার সেই বিখ্যাত হাই ফাইভ নিয়েও সংবাদমাধ্যম একই রকম জায়গা দিয়েছিল। সৌদি আরব তখনো চাপে ছিল।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা রাশিয়ার অর্থনীতি বহুমুখীকরণে সৌদি আরব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আবার সৌদি আরব রাশিয়ার সঙ্গে এমন সব চুক্তি করছে, যা তাদের নিজস্ব উদ্যোগগুলো বহুমুখী করতে সহায়তা করছে। সৌদি আরব ব্রিকসে যোগ দিয়েছে। চীন, ব্রাজিল, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে রাশিয়া ব্রিকসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ব্রিকসে যোগ দেওয়াকে রাজনৈতিক বিবেচনায় না দেখে সৌদি আরব অর্থনৈতিক লাভের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছে।
এ ধরনের মিথষ্ক্রিয়ায় দুই দেশ কতটা লাভবান হবে? সৌদি আরব ও রাশিয়া সম্পর্কের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক লাভের বিবেচনা নিঃসন্দেহে মুখ্য চালিকা শক্তি হয়েছে। চলমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মস্কোকে পশ্চিমা সম্মিলিত শক্তির সঙ্গে যে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে, সেখানে রিয়াদকে মস্কো বৈশ্বিক জ্বালানি খাতের দৃশ্যপট বদলে দেওয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশীদার বলে মনে করে।
পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার সঙ্গে যখন জ্বালানি চুক্তি বাতিল করেছে এবং রাশিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে, তখন নিজেদের জিডিপি বাড়াতে সৌদি আরবের সঙ্গে এই সম্পর্ক মস্কোর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
একই সঙ্গে সৌদি আরব নতুন যে জাতীয়তাবাদী পররাষ্ট্রনীতি নিয়েছে, সেখানে তাদের নিজস্ব অগ্রাধিকারের মধ্যে অর্থনীতি একেবারে প্রথম বিবেচ্য বিষয়। এই নীতি সৌদি আরবকে রাশিয়ার সঙ্গে দুই পক্ষের জয় হবে, এমন ধরনের জোট গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করেছে।
২০২২ সালের অক্টোবরে এবং ২০২৩ সালের এপ্রিল ও জুন মাসে রাশিয়া, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতৃত্বে সম্পাদিত ওপেকপ্লাস চুক্তিগুলো সদস্যদেশগুলোকে জ্বালানি খাতে রাজস্ব বাড়াতে সহায়তা করেছে। এই চুক্তিগুলো যেসব ফল বয়ে নিয়ে এসেছে, সেগুলো বিশেষ করে রাশিয়ার জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।
২০২৩ সালের জানুয়ারি মাসে রাশিয়ার উপপ্রধানমন্ত্রী আলেক্সান্দার নোভাক বলেন যে ২০২২ সালে তেল ও গ্যাস থেকে রাজস্ব আয় ২৮ শতাংশ বেড়েছে। রাশিয়ার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত ২০২৩ সালে রাশিয়ার জিডিপি (২৭ শতাংশের বেশি) প্রবৃদ্ধিতে মূল অবদান রেখেছিল। অন্যদিকে সৌদি আরবের জিডিপি ২০২১ সালে দশমিক ৮৭৪ বিলিয়ন, ২০২২ সালে ১ দশমিক ১ বিলিয়ন ও ২০২৩ সালে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার বেড়েছে।
পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কবলে থাকা রাশিয়ার অর্থনীতি বহুমুখীকরণে সৌদি আরব অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আবার সৌদি আরব রাশিয়ার সঙ্গে এমন সব চুক্তি করছে, যা তাদের নিজস্ব উদ্যোগগুলো বহুমুখী করতে সহায়তা করছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে, ২০২২ সালে রাশিয়া থেকে সৌদি আরবে কৃষিপণ্য রপ্তানি বাড়ে ৪৯ শতাংশ, যার মূল্য প্রায় ১ বিলিয়ন ডলার।
সৌদি আরব ব্রিকসে যোগ দিয়েছে। চীন, ব্রাজিল, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে রাশিয়া ব্রিকসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ব্রিকসে যোগ দেওয়াকে রাজনৈতিক বিবেচনায় না দেখে সৌদি আরব অর্থনৈতিক লাভের বিষয়টিতে গুরুত্ব দিয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যুবরাজ ফয়সাল বিন ফারহান বলেছেন, অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্র বাড়ানোর ক্ষেত্র হিসেবে ব্রিকস ‘লাভজনক ও গুরুত্বপূর্ণ একটি মাধ্যম’।
রাশিয়ার কর্তাব্যক্তিরা এ অবস্থানের তারিফ করেছেন। ফেব্রুয়ারি মাসে পার্লামেন্টে দেওয়া বাৎসরিক ভাষণে পুতিন বলেছেন, ‘আর্জেন্টিনা, মিসর, ইরান, ইথিওপিয়া ও সংযুক্ত আরব আমিরাত নতুন করে যুক্ত হওয়ায় ব্রিকসের দেশগুলো ২০২৮ সাল নাগাদ বৈশ্বিক জিডিপির ৩৭ শতাংশ সৃষ্টিতে অবদান রাখবে। সে সময়ের জি-৭ দেশগুলো জিডিপিতে অবদান ২৮ শতাংশের নিচে নেমে যাবে।’
দুই দেশের নেতারা যে ভিত্তি গড়ে দিয়েছেন, তাতে করে সামনের দিনগুলোতে সৌদি আরব-রাশিয়া সম্পর্ক আরও নানা মাত্রায় বিকশিত করার সম্ভাবনা রয়েছে। হার্ড পাওয়ারের পাশাপাশি দুই দেশই সফট পাওয়ার বিনিময় করেও লাভবান হতে পারে। সৌদি আরব তার অর্থনীতি বহুমুখী করার জন্য যে ভিশন ২০৩০ কর্মসূচি নিয়েছে, সেখানে রাশিয়া আরও বেশি সম্পৃক্ত হতে পারে।
এ ছাড়া ধর্মের মতো সফট পাওয়ার দুই দেশের সম্পর্কে এখনই কাজ করতে শুরু করেছে। ভিশন ২০৩০–এর একটা অন্যতম লক্ষ্য হলো মুসলিম বিশ্বকে বিশ্বের কেন্দ্রীয় মঞ্চে নিয়ে যাওয়া। এই লক্ষ্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে রাশিয়ার মুসলিম–অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করা জরুরি। গত বছর রাশিয়া ইসলামি ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান চালুর ক্ষেত্রে একটা পাইলট প্রকল্প নিয়েছে, যাতে করে সৌদি আরবের ব্যাংকগুলো দেশটিতে পরিচালনার সনদ দেওয়া যায়।
এ ছাড়া খেলাধুলাও সফট পাওয়ারের আরেকটি হাতিয়ার হতে পারে। সাংস্কৃতিক বিনিময়ও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে। অর্থনৈতিক চুক্তির পাশাপাশি এসব উদ্যোগ দুই দেশের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংহতিতে সহায়তা করবে।
দায়ানা গালিভা অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক ভিজিটর
আরব নিউজ থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষিপ্তাকারে অনুবাদ করেছেন মনোজ দে