বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর মান যা-ই হোক না কেন, নির্বাচনী রাজনীতিতে ‘প্রতারিত’ ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ধারাবাহিক অন্যায়ের শিকার হয়ে আসছে তারা। দেড় দশকের হামলা-মামলা, জেল-জুলুম, আর্থিক লোকসান ও হয়রানিতে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাজনৈতিকভাবে নিপীড়নের শিকার আজ বিরোধী দলগুলো। ফলে এদের নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা করাও এখন বেশ কঠিন।
দেশের বর্তমান শাসনব্যবস্থায় ভুক্তভোগীদের দায়ী করা অপরাধ। কিন্তু গঠনমূলক সমালোচনা না থাকলে একটি রাজনৈতিক দল কোনোভাবেই তার আন্দোলনকে পরিণত জায়গায় নিয়ে যেতে পারে না। প্রতিকূলতায় তারা নিজেদের যোগ্য করে তুলতে পারে না। ফলে সক্ষমতা তৈরির জন্য হলেও বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কৌশল, তাদের নীতি এবং তাদের রাজনীতির ক্রমাগত সমালোচনা করে যেতে হবে।
বিরোধী দলগুলোকে এটা বুঝতে হবে যে দলের কমিটি করা রাজনীতি নয়। দু-চারটা বড় সভা করা শুধু রাজনীতি নয়। বরং রাজনীতি যে শাসকের বিরুদ্ধে নিত্যনতুন বয়ান তৈরি করা; শাসকের প্রতিটি ভুল ও গণবিরোধী কাজকে চ্যালেঞ্জ করা; সমাজের প্রতিটি অংশে বিশেষভাবে ছাত্র-যুবক-শ্রমিক-কৃষক ও পেশাজীবীদের যুক্ত করা; বিকল্প সমাধান দেখানো; জনগণকে স্বপ্ন দেখানো; আশা তৈরি করা—এসব আজকের বিরোধী রাজনীতিতে অনুপস্থিত।
আজকের রাজনীতি হচ্ছে নেতাকেন্দ্রিক, সম্মেলন না করে অগণতান্ত্রিক উপায়ে কমিটি দেওয়া, পদ বিক্রি করা। সরকার নেতাকে কৌশলগত সময়ে জেলে পোরে আর কর্মীদের তখন পালিয়ে থাকতে হয়।
আজকের বিরোধীদের দলীয় প্রধানেরা কর্মসূচি ব্যবস্থাপক বা ম্যানেজারের ভূমিকা নেন, প্রধান নির্বাহীর ভূমিকা নেন না। তাঁদের সঙ্গে সমাজে যে নানা শাখা ও গোষ্ঠী রয়েছে তার কোনো যোগাযোগ নেই। সামষ্টিক অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক করপোরেট গোষ্ঠীর যোগাযোগ নেই। ব্যষ্টিক অর্থনীতি এবং গ্রামীণ অর্থনীতির নিয়ন্ত্রক এনজিওদের যোগাযোগ নেই। নাগরিক সমাজ, সংবাদমাধ্যম, লেখক, বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, শিক্ষক, সাংবাদিক, সম্পাদক বা আলাদা আলাদাভাবে পেশাজীবীদের যোগাযোগ নেই।
তাঁরা ভেবে বসে আছেন, জনগণ ও তৃণমূল নেতা-কর্মীরা নিজ থেকেই তাঁদের কাছে এসে ধরনা দেবেন। কিন্তু সেখানে যে কিছু নেতা পদ বিক্রির দেয়াল তৈরি করে রেখেছেন, সে খবরও দলীয় প্রধানদের নেই।
আজকের বিরোধী রাজনীতিতে নেতা নামধারী হাজার হাজার ম্যানেজার আছেন, কিন্তু কোনো নেতা নেই। নেতা না থাকায় কোনো প্রতিনিধিত্ব নেই। কেউ জানেন না তাঁর কী কাজ। কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতা নির্বাচিত হয় না বলে দলের ওপর তাঁর নেতৃত্বের শৃঙ্খলা তৈরি হয় না।
আজকের বিরোধী দলীয় প্রধানেরা সমাজের সমস্যা নিয়ে মানুষের সামনে বয়ান নিয়ে হাজির হন না। ফলে তাঁরা মানুষকে সংযুক্ত করতে পারেন না। অনেককে দেখা যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরব থাকতে। মূলত মানুষকে কাছে টানার চেয়েও তাঁরা সেখানে কনটেন্ট তৈরি করে অনলাইন থেকে আয় করেন। তাঁরা অনেক সময় ভুলভাল নীতি প্রচার করে কর্মীদের ও নেতাদের মনোজগৎ নিয়ন্ত্রণ করেন। দুঃখজনক হচ্ছে, দিন শেষে দলীয় প্রধানেরাও সেভাবে সিদ্ধান্ত নেন।
অর্থাৎ আজকের বিরোধীদলীয় প্রধানদের নিজ দলের সিদ্ধান্ত, কৌশল নিজে তৈরি করার কোনো সামর্থ্য নেই। দলের ওপর তাঁদের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। দলের যতটুকু প্রভাব তাঁরা রাখেন, তা-ও অন্যের নির্মাণ করে দেওয়া। এ রকম হীনম্মন্যতা ও অক্ষমতা সম্ভবত বাংলাদেশের বিরোধী রাজনীতিতে আগে কোনো দিন আসেনি।
আজকের দলীয় প্রধানদের এমন কোনো কার্যালয় নেই, যেখানে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কাজ করার জন্য আলাদা আলাদা ডেস্ক আছে কিংবা যোগাযোগের জন্য মুঠোফোন নম্বর ও ই-মেইল অ্যাড্রেস আছে। থাকলেও এখানে ব্যক্তিনির্ভর যোগাযোগই প্রাধান্য পায়। অফিসনির্ভর প্রাতিষ্ঠানিক কোনো যোগাযোগব্যবস্থা নেই।
তাঁরা কোনো প্রশ্নের একাডেমিক উত্তর খোঁজেন না। একজন গবেষক, শিক্ষক, চিন্তক, বুদ্ধিজীবী কীভাবে দলীয় শীর্ষ নেতার কাছে পৌঁছাবেন, গবেষণা উপস্থাপনা করবেন কিংবা সমালোচনা পৌঁছাবেন—এসব কোনো পথ নেই। আঞ্চলিক কিংবা বিশেষ কূটনৈতিক অংশীদার, উন্নয়ন ও দাতা অংশীদার, মধ্যপ্রাচ্য ও দূরপ্রাচ্যের কূটনীতিকদের জন্য কোনো বিধিবদ্ধ ডেস্ক নেই।
মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ, চীন, জাপান কিংবা যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকদের কাছে প্রধান বিরোধীদলীয় ডি ফ্যাক্টো প্রধানের সরাসরি কোনো যোগাযোগ নেই। তাঁরা তাঁর বিষয়ভিত্তিক লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য জানেন না, তাঁকে সামনাসামনি কথা বলতেও দেখেননি। তাঁর ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে তাঁরা অবগত নন। আন্তর্জাতিক কোনো বিষয়াবলি নিয়েও কখনো তাঁর বক্তব্য শোনেননি তাঁরা।
বিরোধীদের সঙ্গে বৈঠকে মার্কিনরা আশা প্রকাশ করেন যে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক শাসন ফিরবে। আমাদের বিরোধীরা সেটিকে এভাবে প্রকাশ করে যে ভূরাজনীতির কারণে তারা সরকার পরিবর্তনের কাজ করবে। ২০২৩ সালে একাধিক বিরোধী উপদেষ্টা বুদ্ধিজীবীকে বলতে শুনেছি, ভূরাজনীতির কারণে সরকারের পতন সময়ের ব্যাপারমাত্র।
কিন্তু যাঁরা বিভিন্ন সময় মার্কিনদের সঙ্গে নাগরিক সংলাপে যুক্ত থেকেছেন, তাঁদের বক্তব্য ভিন্ন। মার্কিনরা বারবার বলেছেন, বাংলাদেশে গণতন্ত্র ফেরানোর দায়িত্ব তাঁদের নয়, কাজটা এ দেশের রাজনৈতিক দলের ও মানুষের। তাঁরা এটাকে সমর্থন করেন মাত্র। এই যে কূটনৈতিক বার্তা বোঝার ব্যর্থতা, এই সমস্যা কীভাবে অতিক্রম করবে বিরোধীরা।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে কৌশলে ২০১৪,২০১৮, ২০২৪-এ পরপর তিনবার আন্দোলন ব্যর্থ হলো, সাধারণ মানুষকে রাস্তায় নামিয়ে গণজোয়ার তৈরি করাও সম্ভব হলো না, সেই একই কৌশলে কীভাবে পরেরবারও সরকারকে মোকাবিলা করা সম্ভব? এ প্রশ্ন কি বিরোধী দলের নেতৃত্ব ও নীতিনির্ধারকেরা নিজেদের করছেন?
আজকের দলীয় ফোরামগুলোতে নারীদের উপস্থিতি তেমন একটা লক্ষ করা যায় না। বুদ্ধিদীপ্ত ও অভিজ্ঞ নাগরিকদের অংশগ্রহণেরও অভাব। বিভিন্ন পেশা ও খাতে প্রশ্ন করার ব্যাপারে তাঁরা অন্তর্ভুক্তিমূলক নন। ছাত্র, যুবক, শ্রমিক, শিক্ষক, শিল্পী, লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক-সম্পাদক, দাতা ও উন্নয়ন অংশীজন, করপোরেট ও এনজিও নেতৃত্ব কিংবা কূটনৈতিক মহলে কার্যকর ও নিয়মিত যোগাযোগ ও সংযোগ স্থাপন ছাড়া শুধু বিপুল জনসমর্থন নিয়েই কি সরকারবিরোধী আন্দোলন সফল করা আদৌ সম্ভব? এভাবে ভবিষ্যৎ সরকারপ্রধান হওয়ার স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যায়। জনসমর্থন থাকাকে, কমিটি আর মিটিং করাকে কোনোভাবেই রাজনীতি বলে না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যে কৌশলে ২০১৪,২০১৮, ২০২৪-এ পরপর তিনবার আন্দোলন ব্যর্থ হলো, সাধারণ মানুষকে রাস্তায় নামিয়ে গণজোয়ার তৈরি করাও সম্ভব হলো না, সেই একই কৌশলে কীভাবে পরেরবারও সরকারকে মোকাবিলা করা সম্ভব? এ প্রশ্ন কি বিরোধী দলের নেতৃত্ব ও নীতিনির্ধারকেরা নিজেদের করছেন?
প্রশ্ন করতে হবে, ঠিক এ মুহূর্তে বিরোধীদের রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডা কী? প্রশ্ন তোলা উচিত, বিরোধীদের আন্দোলন কেন শহুরে মধ্যবিত্তকে স্পর্শ করতে পারছে না। কেন ঢাকার বাইরের সফল আন্দোলন ঢাকায় এসে মার খায়? কর্মীদের বাইরে ঢাকার সাধারণ ছাত্র-জনতা কেন আন্দোলনে যুক্ত হচ্ছে না?
আজকের দলীয় প্রধানদের দলের ভেতরে কোনো ‘ছায়া সরকার’ নেই। ফলে সরকারের নানা নীতির নিরীক্ষাও হয় না বিরোধী দলগুলোর ভেতরে। সে অনুযায়ী সরকারকে চ্যালেঞ্জও করা হয় না। সমাজ ও মধ্যবিত্ত মনমানসিকতার রূপান্তর ও গতিপ্রকৃতি বোঝার চেষ্টাও নেই। ফলে তারা জনস্বার্থ ইস্যু থেকে দূরে গিয়ে গৎবাঁধা কথা বলে, যা কোনো আবেদন তৈরি করে না। গণযোগাযোগ ও বক্তব্য উপস্থাপনের আধুনিক কৌশল নিয়ে তাদের কোনো বোঝাপড়া নেই।
রাজনীতি দিয়ে আপনি যদি মানুষকে এই বিশ্বাস ও স্বপ্ন দেখাতে না পারেন যে আপনি মানুষের সমস্যার সমাধান করতে পর্যাপ্ত সক্ষমতা রাখেন, তাহলে সে রাজনীতি ব্যর্থ হতে বাধ্য। প্রতিটি বিরোধী দলের শীর্ষ নেতাদের বক্তৃতা কি আপামর শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী মানুষসহ সমাজের নানা স্তরে পৌঁছায়? সেটি হলে বোঝা যেত, কে কতটা মানুষকে অনুপ্রাণিত করতে পারে। প্রস্তুতিহীনতা দিয়ে তো রাজনীতি চলে না।
যে কোনো কর্তৃত্ববাদী সরকার ভিন্নমত ও বিরোধী দল দমনে নানা কৌশল অবলম্বন করে। আন্দোলন নিষ্ক্রিয় করতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, ডিজিটাল প্রযুক্তির মাধ্যমে নজরদারি তৈরি করে তথ্যের ওপর সর্বেসর্বা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। ফলে সেসব মোকাবিলা করেই সমাজের নানা স্তরের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে হবে বিরোধীদের। এর জন্য নিত্যনতুন কৌশলও নির্ধারণ করতে হবে।
মানুষকে বিরোধী রাজনীতিতে আকৃষ্ট করতে রাজনীতিবিজ্ঞানের ‘রুল অব দ্য গেম’ বা প্রতিষ্ঠিত ‘কুক বুক ম্যানুয়াল’ অনুসরণ করার কোনো বিকল্প নেই। এখানে কোনো শর্টকাট পথ নেই। দেশের বিরোধী দলগুলো এসব কখন বুঝবে?
এমনি এমনি মানুষ একদিন রাস্তায় নেমে যাবে না। তাদের যৌক্তিক কারণে উৎসাহিত করতে হবে, সংগঠিত করতে হবে। অসংগঠিত জনতা ইতিহাস রচনা করতে পারে না। মানুষকে সংগঠিত করার কৌশলগত সক্ষমতা বিরোধী নেতাদের অর্জন করতে হবে। প্রস্তুতিহীন রাজনীতি করে ক্ষমতায় যাওয়াটাও অসম্ভব।
বিরোধীরা মানুষের সহানুভূতি পাচ্ছে কিন্তু মানুষ ও সমাজের সঙ্গে লেনদেন সম্পূর্ণ না হলে তারা বিরোধীদের জন্য রাস্তায় নামবে না। তাই ‘রাজনৈতিক অ্যাজেন্ডাহীন ও সরকারের বিরুদ্ধে কৌশলগত রাজনীতিহীন’ বিরোধী রাজনীতিকে প্রশ্ন করে যেতে হবে।
ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব লেখক ও গবেষক