‘লোকদেখানো’ গাছ লাগানোয় ফায়দা কী

গাছের চারার নিরাপদ বৃদ্ধি পর্যন্ত বৃক্ষরোপণ ও পরিচর্যা একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। নার্সারি থেকে চারা এনে গর্ত করে রোপণ করলেই দায়িত্ব শেষ হয় না। বৃক্ষরোপণের ছবি তুলে প্রেস রিলিজ দিয়ে কিংবা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করলেই চারা বৃক্ষে পরিণত হয় না। প্রদর্শনমূলক কর্মসূচি নয়, বৃক্ষরোপণে থাকতে হয় গভীর ভালোবাসা আর দায়িত্বশীলতা।

একটি চারা লাগানোর আগে-পরে অনেক কাজ থাকে। গাছের জন্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচন জরুরি। চারা লাগানোর জন্য যে গর্ত করা হয়, তারও মাপ থাকে। গর্তে পরিমাণমতো সার দেওয়া জরুরি। গরু-ছাগলে খাওয়ার আশঙ্কা থাকলে ঘিরে দিতে হয়।

চারা লাগানোর সময় এর সঙ্গে থাকা পলিথিনসহ অনেকে গাছ লাগান। এতে অনেক গাছের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হতে দেখেছি। বর্ষা মৌসুমে গাছের গোড়ায় প্রচুর আগাছা হতে পারে। সেই আগাছা নিয়মিত পরিষ্কার করতে হয়। ঝড়ে চারা হেলে গেলে কিংবা ভেঙে গেলে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে হয়। প্রখর রোদে গাছের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকলে অবশ্যই নিয়মিত পানি দেওয়া অপরিহার্য।

গাছ পরিবেশবান্ধব হলো কি না, সেটিও ভাবনার বিষয়। এক মৌসুমে গাছ বড় হবে—এমনটি মনে করার কারণ নেই। কোনো কোনা গাছের জন্য তিন থেকে চার বছর পরিচর্যা অব্যাহত রাখতে হয়। ফলে রোপিত চারা একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ বেড়ে ওঠার আগপর্যন্ত সেই গাছের পরিচর্যা করতে পারলেই কেবল রোপণ করতে পারেন। নয়তো দোহাই, বৃক্ষরোপণের নামে ‘চারা–নিধন’ কর্মসূচি গ্রহণ করবেন না।

আমরা দেশে বড় বড় বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি দেখি। লাখ লাখ গাছের চারা রোপণ করা হয়। কখনো কোটি কোটি চারাও রোপণ করা হয়। ওই কর্মসূচির নাম বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি। বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির জন্য গাছের চারা কেবল রোপণ করলেই হয়ে যায়! গাছের বাঁচা না–বাঁচা দিয়ে তাদের কাজ নেই।

যদি বৃক্ষরোপণ কর্মসূচির পরিবর্তে ‘গাছ লাগাই, গাছ বাঁচাই’ কিংবা ‘বৃক্ষরোপণ ও সুরক্ষা’ কর্মসূচি পালন করা হতো, তাহলে পরিকল্পনায় অনেক কিছু থাকত। তখন একটি গাছ বড় না হওয়া পর্যন্ত সেগুলোর পরিচর্যায় করণীয় ঠিক করা হতো।

আরও পড়ুন

ঘোষণাসর্বস্ব, ছবিসর্বস্ব, বাহাবাসর্বস্ব কর্মসূচি গ্রহণ করা আত্মপ্রতারণার শামিল। গাছ লাগানোর আগে যাঁদের গাছগাছালি সম্পর্কে ধারণা আছে, তাঁদের পরামর্শ গ্রহণ করার প্রয়োজন আছে। বৃক্ষরোপণ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। যে স্থানে গাছ লাগানো হবে, সেই স্থানে ভবিষ্যতে কত দিন গাছ থাকবে, সে পরিকল্পনাও থাকা চাই।

সব গাছের বৃদ্ধি এক রকম নয়। আবার সব গাছ একই উচ্চতারও নয়। সব গাছ একই পরিমাণ জায়গা দখল করে না। সব গাছ অক্সিজেন দিলেও গাছ লাগানোর অনেক উদ্দেশ্য থাকে। ঔষধি, ফলদ, কাষ্ঠল, সৌন্দর্যবর্ধক গাছ আছে। উদ্দেশ্য ঠিক রেখে গাছ লাগাতে হয়। কেবল মানুষের খাওয়ার ফলের কথা বিবেচনা করে নয়, পাখিদের কথাও মনে রাখার প্রয়োজন আছে। দেশি গাছ যেগুলো বিলুপ্তির পথে, সেগুলোর চারার মূল্য অনেক হলেও তা রোপণের দিকেও মনোযোগ দেওয়া চাই।

যদি কারও গাছ পরিচর্যার উপায় না থাকে, কিন্তু গাছ লাগানোর আগ্রহ আছে, তাহলে তিনি যতগুলো গাছ লাগাতে চান, সেই গাছ এমন ব্যক্তিকে কিনে দিতে পারেন, যিনি ওই গাছ বড় করে তুলবেন।

কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার উদ্যোগে ২০১৭ সালে এক দিনে সাত লাখ চারা রোপণ করা হয়েছিল। সেই সাত লাখ চারার সাতটি চারাও বেঁচে নেই। এই চারা রোপণে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। ঢাকঢোল পিটিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপকহারে প্রচার করা হয়েছিল। এখন যে সেই সাত লাখ চারার সাতটিও বেঁচে নেই, সে খবর কোথাও দেখা যায় না। তাঁর উদ্দেশ্য ভালো হলেও অদূরদর্শী পরিকল্পনায় সেই কর্মসূচি সফল হলো না।

আমি শৈশবে মায়ের সঙ্গে সবজি লাগানোর কাজ করতাম। আরেকটু বড় হয়ে বড় বোনের সঙ্গে ফুলগাছ লাগাতাম। শৈশবকাল থেকে গাছের চারা রোপণ করি। বিয়েসহ অনেক অনুষ্ঠানে গাছ উপহার দিয়ে থাকি। প্রায় ৩৫ বছর ধরে আমি গাছের চারা রোপণ করে আসছি।

শিক্ষার্থী ও কর্মচারীদের সহায়তায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে চার শতাধিক প্রজাতির প্রায় ৩৭ হাজার গাছ লাগিয়েছি। এখন ক্যাম্পাস অনেকটাই শীতল। বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থার কাছ থেকে এগুলোর অধিকাংশ চারা সংগ্রহ করেছি।

বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তাপপ্রবাহ তীব্র রূপ ধারণ করছে। এই তাপপ্রবাহ থেকে রক্ষা পেতে অনেকেই মনে করছেন গাছ লাগাতে হবে। সে কারণে অনেকে উৎসাহ দেখাচ্ছেন গাছ লাগানোর ক্ষেত্রে। এই উৎসাহ আশাজাগানিয়া। তবে অবশ্যই চারাকে বৃক্ষে পরিণত করার সামর্থ্য থাকলেই কেবল সেই উদ্যোগ নিতে হবে।

কেবল আগ্রহ থাকলেই যে গাছ হয় না, তার একটি বড় উদাহরণ দিচ্ছি। কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার উদ্যোগে ২০১৭ সালে এক দিনে সাত লাখ চারা রোপণ করা হয়েছিল। সেই সাত লাখ চারার সাতটি চারাও বেঁচে নেই।

এই চারা রোপণে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়েছে। বিশাল অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। ঢাকঢোল পিটিয়ে গণমাধ্যমে ব্যাপকহারে প্রচার করা হয়েছিল। এখন যে সেই সাত লাখ চারার সাতটিও বেঁচে নেই, সে খবর কোথাও দেখা যায় না। তাঁর উদ্দেশ্য ভালো হলেও অদূরদর্শী পরিকল্পনায় সেই কর্মসূচি সফল হলো না।

আমরা একটি গ্রামে প্রতিটি বাড়িতে একটি করে উন্নত জাতের আমগাছ ও পেয়ারাগাছ দিয়েছি। সেগুলো এখন ফল দিচ্ছে। আমাদের শিক্ষার্থী শাহা ফরিদ ক্যাম্পাসসহ অনেক স্থানে নিজে অনেক গাছ লাগিয়েছেন। লালমনিরহাটে একবার তাঁর গ্রামে স্কুলে আমরা কয়েক হাজার চারা প্রদান করেছি। শিশুদের দ্বারা বাড়ি বাড়ি বৃক্ষরোপণে ভালো ফল পাওয়া যায়।

আমাদের দেশের মাটি খুব ভালো। গাছ লাগিয়ে পরিচর্যা করলে গাছ মারা যায় না। প্রক্রিয়াও খুব সহজ। সহজেই বাংলাদেশে প্রচুর গাছ লাগানো সম্ভব। এ জন্য উপযুক্ত পরিকল্পনা জরুরি।

দেশে প্রয়োজনীয় ২৫ শতাংশ বনভূমি নিশ্চিত করা সম্ভব। কিন্তু এর জন্য বৃক্ষরোপণের নামে চারা–নিধন কর্মসূচি ত্যাগ করতে হবে। দেশে যত স্থানে গাছ লাগানো সম্ভব, তা দ্রুত করাও উচিত। দেশে অনিয়ন্ত্রিত তাপমাত্রা সহনীয় পর্যায়ে রাখতে গাছ লাগানোন কাজটি ব্যক্তি-সংগঠন-সংস্থা-সরকারি পর্যায়ে ব্যাপকহারে করা হোক।

  • তুহিন ওয়াদুদ বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এবং নদী রক্ষাবিষয়ক সংগঠন রিভারাইন পিপলের পরিচালক