এখন ছাত্ররাজনীতি মানে প্রতিপক্ষের ওপর হামলা, নিজেদের মধ্যে মারামারিতে জড়ানো। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে চাঁদাবাজি আর ছিনতাই। বিভিন্ন ভর্তি পরীক্ষা ও নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুরুদায়িত্বও এখন ছাত্রনেতৃত্বের! সাধারণ শিক্ষার্থীদের আতঙ্কের মধ্যে রেখে তাঁদের ব্যবহার করে ছাত্রনেতারা রাজনীতি করছেন। এমন পরিস্থিতে প্রশ্ন তৈরি হয়েছে, ছাত্ররাজনীতির কি আদৌ কোনো প্রয়োজন আছে?
সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে আমি ছাত্ররাজনীতি প্রসঙ্গে কথা তুলে দেখেছি। কিন্তু তাঁরা এ ব্যাপারে বিস্ময়করভাবে নীরব, নির্লিপ্ত থাকেন। দুই-তিন দশক আগেও যে ছাত্ররাজনীতির অবস্থা প্রীতিকর ছিল, তা নয়।
তবে তখন এ নিয়ে প্রশ্ন তুললে কিছু ছাত্র এর পক্ষে বলতেন, অন্যরা বলতেন বিপক্ষে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি থাকা উচিত কি উচিত নয়, এ নিয়ে তর্ক চলত। ছাত্ররাজনীতির পক্ষে যাঁরা বলতেন, তাঁরা মূলত এর অতীত গৌরবের কথা তুলে ধরতেন আর জাতীয় রাজনীতির ব্যাপারে হতাশ যাঁরা, তাঁরা বিপক্ষে বলতেন।
ছাত্ররাজনীতি নিয়ে কথা বলার আগে এর সংজ্ঞায়ন করে নিলে আসলে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়। ছাত্ররাজনীতি বলতে কী বোঝায় কিংবা এর আওতা বা পরিধি কতটুকু, তার ব্যাখ্যা থাকা দরকার। ছাত্ররাজনীতি মানে কি ক্ষমতাসীন দলের লেজুড়বৃত্তি করা? বড় নেতার আশ্রয়-প্রশ্রয়ে থেকে চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি করা? বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন নিয়োগে বল প্রয়োগ করা কিংবা এই সূত্রে গোপনে অর্থের লেনদেন করা? সাধারণ ছাত্রদের ওপর নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ড চালানো এবং আবাসিক হলগুলোয় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা? বয়স পার হয়ে গেলেও যেকোনো উপায়ে হলে থেকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে খবরদারি করা? এগুলো নিশ্চয়ই ছাত্ররাজনীতির চেহারা হতে পারে না।
ছাত্ররাজনীতি তাহলে কী? ছাত্ররাজনীতি মানে নিজেদের কর্তব্য নির্ধারণ করতে পারা এবং কর্তব্য পালনে দায়িত্বশীল থাকা, সাধারণ ছাত্রদের অধিকার আদায়ের ব্যাপারে সরব ও সচেষ্ট থাকা, প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক উন্নয়নে কাজ করা, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ইস্যুতে সচেতন থাকা ও মত প্রকাশ করা, বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি মুক্তচিন্তা ও বাক্স্বাধীনতার জন্য কাজ করা।
দলীয় লেজুড়বৃত্তির নোংরা ছাত্ররাজনীতিকে সমর্থন জানানোর কোনো কারণ নেই। দলের হাইকমান্ডের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদে ছাত্ররাজনীতি সীমা লঙ্ঘনের সুযোগ পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও এখন ক্ষমতাসীন ছাত্রনেতৃত্বের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডকে নীরবে সয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়, রীতিমতো সমর্থন দিয়ে যায়। এখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ থেকে শুরু করে শিক্ষক নিয়োগেও ছাত্রনেতারা চাপ প্রয়োগ করেন। এমনকি, উপাচার্য নিয়োগেও তাঁদের সুপারিশ গুরুত্বপূর্ণ!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করার সূত্রে দেখেছি, এখানে সাধারণ ছাত্রদের লড়াই করতে হয় প্রবল দারিদ্র্যের সঙ্গে। হোস্টেল বা মেসে থেকে পড়াশোনা চালানো অসম্ভবপ্রায় বলে ছাত্রনেতাদের নির্যাতন ও খবরদারি মেনে নিয়েও তাঁরা গণরুমে থাকতে বাধ্য হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দুই বছর ধরে আনুপাতিক হারে আসনসংখ্যা কমিয়ে যাচ্ছে।
বায়ান্ন ও এর পূর্বাপর ভাষা আন্দোলন, বাষট্টির ছাত্র আন্দোলন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান কিংবা নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের ধুয়া তুলে বর্তমান ছাত্ররাজনীতির বৈধতা দেওয়া একরকম অপরাধ। ঢাকার সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন করার পর কিছু কথা জেনে বিস্মিত হয়েছি। সেসব কলেজে ছাত্রনেতারা পরীক্ষার নম্বর পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণ করতেন। মৌখিক পরীক্ষায় উপস্থিত না থেকেও ছাত্রনেতারা নম্বর প্রত্যাশা করতেন, দলের নিবিড় কর্মীদের জন্য নির্ধারিত নম্বরেরও দাবি করতেন।
পরীক্ষা কমিটি অসহায়ভাবে নম্বর দিতে বাধ্য হতো। দুঃখজনক ব্যাপার, ছাত্ররাজনীতির ব্যাপারে সাধারণ শিক্ষার্থীদের কোনো আগ্রহ না থাকলেও কোনো কোনো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্রসংগঠনের শাখা খুলতে দেখা গেছে। অদূর ভবিষ্যতে প্রতিটি উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এ রকম নেতিবাচক ধারার ছাত্ররাজনীতি গড়ে উঠলে শিক্ষার ন্যূনতম পরিবেশ বলে আর কিছু থাকবে না।
ছাত্ররাজনীতি থাকবে কি থাকবে না, সে প্রশ্ন নিয়ে বিতর্ক হতে পারে। তবে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে কিছু পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদকে কার্যকর করতে হবে। দিনের পর দিন নির্বাচন না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বিভিন্ন উন্নয়ন ও অংশগ্রহণমূলক কাজে ছাত্রনেতৃত্বের সংযোগ ঘটছে না। ছাত্র সংসদ কার্যকর করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে নির্বাচন দিতে হবে।
লোকদেখানো আপসমূলক নির্বাচন হলে তা সমস্যার সমাধান দেবে না, বরং সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন না হলে ছাত্রনেতৃত্বকে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে উৎসাহিত করা হবে। ছাত্র সংসদ কার্যকর হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক আবহাওয়ারও বদল ঘটবে। সবচেয়ে বড় কথা, সাধারণ ছাত্রদের অধিকার ও সুযোগ প্রতিষ্ঠিত না হলে শিক্ষার মহৎ লক্ষ্যও অপূর্ণ রয়ে যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করার সূত্রে দেখেছি, এখানে সাধারণ ছাত্রদের লড়াই করতে হয় প্রবল দারিদ্র্যের সঙ্গে। হোস্টেল বা মেসে থেকে পড়াশোনা চালানো অসম্ভবপ্রায় বলে ছাত্রনেতাদের নির্যাতন ও খবরদারি মেনে নিয়েও তাঁরা গণরুমে থাকতে বাধ্য হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দুই বছর ধরে আনুপাতিক হারে আসনসংখ্যা কমিয়ে যাচ্ছে।
এতে আশা করা গিয়েছিল, একই অনুপাতে শিক্ষার গুণগত মান বা শিক্ষার্থীদের সুযোগ-সুবিধার বৃদ্ধি ঘটবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের প্রয়োজনীয় ন্যূনতম সুবিধা দিতেও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ব্যর্থ হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কেও কথাগুলো প্রায় একই রকম। দেশজুড়ে ছাত্ররাজনীতির এ পচে যাওয়া অবস্থা দেখে মনে হয়, দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি আরও দুর্গন্ধ ছড়াবে।
তারিক মনজুর অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়