‘নিশ্চয়ই ভিআইপি সাধারণের ধারণার বাইরের অ-সাধারণ জীব’—এই বাণী রাজধানীবাসী জানে। মানে, ‘ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া’ রাস্তায় বের হলেই তাকে এই জিনিস ‘বোন টু বোন’ অর্থাৎ হাড়ে হাড়ে জানতে হয়।
পিজি হাসপাতালে ভর্তি থাকা এক স্বজনের শেষ মুহূর্তের ‘শ্বাস’ উঠছে শুনে ইস্কাটন থেকে হাঁসফাঁস করতে করতে রুদ্ধ এবং ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড় দিলাম। বাংলামোটর সিগন্যালে এসে দেখি, ট্রাফিক পুলিশ ক্রমাগত হুইসিলের মতো ‘শ্যামের হাতের বাঁশরী’ বাজাচ্ছে আর ধমকানির মতো করে ‘ভাগো ইহাছে’ কায়দায় হাত নাড়ছে; রাস্তার ‘সব সংগীত গেছে ইঙ্গিতে থামিয়া’। ‘অপার হয়ে বসে’ থাকা কাউকে রাস্তার এক পার থেকে পার হয়ে অন্য পারে যেতে দেওয়া হচ্ছে না। আমি চেষ্টা করেও রাস্তা পার হতে পারলাম না। কারণ, রাস্তার দুই ধার পুলিশেতে ভরা। তাই দৌড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকতে হলো।
ভিআইপি মুভমেন্টের এটাই দস্তুর। ভিআইপি আসবেন বলে রাস্তা ফাঁকা করা হয়। ‘মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, করুণ কেরানি, নারী, বৃদ্ধ, বেশ্যা, ভবঘুরে’ সবাই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। থমকে থাকা মানুষ অস্থির হয়। পথচারী রাগের চোটে শাপশাপান্ত করে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘আজ যদি আমি ভিআইপি থাকতাম!’
পরক্ষণে তার মনে পড়ে, আমি তো ভিআইপি নই। আমি আওয়াম। আমাকে চেনা যায় আমার অপমান গায়ে না মাখার আর টুঁ–শব্দ না করে সবকিছু মেনে নেওয়ার অভ্যাসে। গায়ে জ্বর, পায়ে ব্যথা নিয়ে বাজারে যাচ্ছি—দল এসে বলল, ‘চল মিছিলে’। চললাম। মহল্লার দাদা এসে বললেন, ‘চাঁদা দে’। হাঁদার মতো দিলাম, দেনা করেই দিলাম।
ভিআইপিরা নিশ্চিত জানেন, রাস্তা আমজনতার বাপের সম্পত্তি নয়। আমজনতাও নিশ্চিত জানে, ‘রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ছাড়া কেউ ভিভিআইপি বা ভিআইপি নন’ বলে হাইকোর্ট একবার মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু যেহেতু ‘সব কথা কহতব্য নয়’, সেহেতু সে কথা আমি বলতে পারি না। কারণ রাষ্ট্র, সরকার, সমাজ সবাই আমাকে বলে দিয়েছে, ভিআইপির সঙ্গে পাঙ্গা নিয়ে দাঙ্গা বাধানো যাবে না।
৭ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার রাজধানীতে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আয়োজিত একটি সভায় একজন আলোচক বলেছিলেন, গণপরিবহনে সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা চলাচল শুরু করলে পরিবহনব্যবস্থায় বদল আসতে পারে। সেখানে ছিলেন সংসদ সদস্য খোদেজা নাসরিন আক্তার হোসেন। তিনি এই বক্তব্য মানতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘অনেকেই বলেছেন রাজধানীতে গাড়ির আধিক্য বেশি। সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা গাড়িতে চলবেন। আমাদের নীতিনির্ধারকদের নিরাপত্তা দেবেন কে? কারণ, এখানে রোষানলে পড়াটাই স্বাভাবিক। কারণ, শতভাগ লোকের দাবিদাওয়া আমরা পূরণ করতে পারব না।’
দুনিয়ার বিভিন্ন দেশে যে নেতারা এমপি-মন্ত্রী হন, তাঁরা নিশ্চয় শতভাগ লোকের দাবিদাওয়া পূরণ করতে পারেন না। কিন্তু তাঁদের নিরাপত্তা নিয়ে এত শঙ্কিত হতে দেখা যায় না। কোনো সরকারি পরিষেবা নেওয়ার জন্য তাঁদের বা তাঁদের পরিবারের জন্য ভিআইপি লাইন বানানোর কথাও আমরা শুনি না। তাদের সেই ‘জনরোষের ভয়’ নেই বলেই ডেভিড ক্যামেরনকে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সাইকেল চালিয়ে অফিসে যেতে দেখা গিয়েছিল।
সংসদ সদস্যের কথা হলো, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীরা গণপরিবহনে চলাচল করলে তাঁদের নিরাপত্তা দেবেন কে? খুবই যৌক্তিক প্রশ্ন। এর যৌক্তিক জবাব হলো, জনপ্রতিনিধির নিরাপত্তার নিশ্চয়তা জনগণই দেবে। জনগণের মাঝেই যিনি নিরাপত্তাহীনতা বোধ করেন, তাঁর জনপ্রতিনিধিত্বের সামনে প্রশ্নবোধক চিহ্ন এসে দাঁড়ায়। আর তখনই ভিআইপিদের নিরাপত্তা দিতে গিয়ে সাধারণের নিরাপত্তা চিতায় ওঠে।
ভিআইপিরা নিজেদের অতি উঁচু চেয়ারে বসিয়ে রাখার কারণে তাঁরা যা করেন, আইনত বাধা না থাকার পরও তা যদি সাধারণ লোক করতে যান, তখনই গন্ডগোল বাধে। হিরো আলমকে নিয়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির নেতাদের সাম্প্রতিক বক্তব্য তার বড় প্রমাণ। খোদ টিআইবি বিবৃতি দিয়ে বলেছে, আওয়ামী লীগ ও বিএনপি উভয় শিবিরের কাছ থেকে হিরো আলম উপহাসের শিকার হয়েছেন। তারা বলেছে, একজন সংসদ সদস্য পদপ্রার্থী, সর্বোপরি দেশের একজন সাধারণ নাগরিককে নিয়ে দুটি রাজনৈতিক দলের বা কারোরই এমন উপহাস করার কোনো অধিকার নেই। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই দুই শিবিরের নেতারাই এমন এক বর্ণবাদের দ্যোতনাজড়িত ‘ভিআইপি সিনড্রোমে’ আক্রান্ত যে হিরো আলমকে তাঁরা সহজাতভাবেই সাধারণ নাগরিকের মর্যাদা দিতে প্রস্তুত নন।
ভিআইপি হওয়ার বড় জ্বালা হলো, একবার ‘অ-সাধারণ’ হওয়ার সুবিধার স্বাদ পেয়ে গেলে ‘সব বাংলাদেশিই ভিআইপি’ কথাটি আর তাঁদের ভালো লাগে না। কিন্তু এই জরুরি কথাটি তাঁরা ভুলেছেন বলেই যানজটের চাপে নাভিশ্বাস ওঠা ও অ্যাম্বুলেন্সে প্রাণসংশয়ে ধুঁকতে থাকা লোকের কথা না ভাবায় তঁারা অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। অথচ এই সাধারণ মানুষের চলাচল সুগম করাই নাকি তাঁদের প্রধান দায়িত্ব।
কিন্তু সেই দায়িত্ব পালনে তাঁদের ততটা আগ্রহ দেখা যায় না, যতটা দেখা যায় ক্ষমতার আস্ফালন প্রদর্শনে। ভিআইপি মুভমেন্ট সেই আস্ফালনেরই নামান্তর। বিভাজনেরও। এই বিভাজন পদাধিকার আর ক্ষমতার বিভাজন। গুরুত্বের বিচারে এটি বর্ণবাদের চেয়ে বড় অপরাধ। এই প্রবণতা থেকেই সাধারণ মানুষকে অপদস্থ করার, তাঁদের কাছ থেকে পবিত্র দূরত্ব বজায় রাখার ইচ্ছাটি জন্ম নেয়। সেই কু-ইচ্ছা থেকেই যত্রতত্র রাস্তা বন্ধ করে দিয়ে নগরবাসীকে ভিআইপি যাত্রা দেখানো হয়।
সারফুদ্দিন আহমেদ প্রথম আলোর সহকারী সম্পাদক