নেদারল্যান্ডসে গত সপ্তাহে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে অতি ডানপন্থী নেতা খেয়ার্ট ভিল্ডার্সের চমকে দেওয়া বিজয় ইউরোপীয় রাজনীতিতে একটি উত্থান-পতনের ইঙ্গিত দিচ্ছে। তবে তাঁর এই জয়ের পেছনে দুটি ঘটনার ‘উসকানি’ আছে।
প্রথমটি হলো, ৭ অক্টোবরের পর হামাসের সমর্থনে নেদারল্যান্ডসসহ ইউরোপজুড়ে মুসলমান অভিবাসীদের গণবিক্ষোভ। এই গণবিক্ষোভের মধ্যে একধরনের জয়ের উন্মাদনা ছিল, যা সংখ্যালঘুদের মধ্যে ভবিষ্যতে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়ার আশাকে জাগ্রত করতে পারে।
বর্তমানে ইউরোপের সবচেয়ে আলোচিত ইস্যু হলো সেখানে অনিয়ন্ত্রিতভাবে গণহারে আছড়ে পড়া অভিবাসী। এর মধ্যে হামাসের সমর্থনে অভিবাসীদের মিছিল পশ্চিমা নাগরিকদের মধ্যে চিন্তা বাড়িয়েছে।
মূলধারার দলগুলো অনিয়ন্ত্রিত অভিবাসনকে গোটা মহাদেশের অন্যতম সমস্যা হিসেবে ঘোষণা দিতে ব্যর্থ হয়েছে—এই বিষয়টিকে ভিল্ডার্সের দল ভোটারদের বোঝাতে সমর্থ হয়েছে। কয়েক মাস আগেও অভিবাসন ইস্যুকে শুধু রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে দেখা হতো। কিন্তু হামাসের সমর্থনে অভিবাসীরা মিছিল করার পর ইউরোপের জনসাধারণের উদ্বেগ বেড়েছে। এর ফলে অভিবাসনবিরোধিতা ও মুসলিমবিদ্বেষের জন্য পরিচিতি পাওয়া ভিল্ডার্সের জনপ্রিয়তা বেড়ে যায়।
দ্বিতীয় বিষয়টি হলো, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রতি ইউরোপিয়ান নাগরিকদের আগ্রহ হারিয়ে ফেলা (যে যুদ্ধে ইউক্রেন দৃশ্যত হারতে চলেছে)।
চরমপন্থী হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে উপহাসের খোরাক হওয়া ইউরোপের ডানপন্থী দলগুলো এখন প্রথাগত প্রজ্ঞাসম্পন্ন লোকদের শেষ ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। তাঁদের জাতীয়তাবাদের সঙ্গে মারি লো পেনের চেয়ে শার্ল দো গলের আদর্শের বেশি মিল রয়েছে। অভিবাসন, রাশিয়া, চীন এবং যুক্তরাষ্ট্র ইস্যুতে তাদের মতামত যুক্তিযুক্ত ও বিবেচনাপ্রসূত মনে করা হয়।
হাঙ্গেরির প্রধানমন্ত্রী ভিক্তর ওরবান (যিনি নিজেকে প্রয়াত জার্মান চ্যান্সেলর হেলমুট কোহলের মতো একজন খ্রিষ্টান ডেমোক্র্যাট হিসেবে বর্ণনা করে থাকেন) নতুন ইউরোপীয় অধিকারের একজন আদর্শ-বাহক। হামাসের হামলার পর তাঁর জনপ্রিয়তা বেড়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি ইউরোপীয় দেশে সম্ভাব্য বেশ কয়েকজন নেতাও উঠে আসছেন।
ভিল্ডার্স নিশ্চিতভাবে জাতিকে তাঁর দেশের মুসলমানদের সমস্যা হিসেবে দেখিয়েছেন। তিনি পর্যায়ক্রমে তাঁর দেশে কোরআন নিষিদ্ধ করার এবং মসজিদ বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। এগুলো যতটা না তাঁর নীতিগত বক্তব্য, তার চেয়ে বেশি রাজনৈতিক বাগাড়ম্বর। তবে বৈধ হোক আর অবৈধ হোক, অভিবাসনই আসলে ইউরোপীয় সমাজের চরিত্র পরিবর্তন করছে। আনুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়ে থাকে, ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং জার্মানির জনসংখ্যার প্রায় ৭ শতাংশ মুসলমান অভিবাসী। কিন্তু প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি।
২০১৭ সালে পিউ রিসার্চ ইনস্টিটিউট গবেষণা চালানোর পর বলেছে, ফ্রান্সের বাসিন্দাদের ৮ দশমিক ৮ শতাংশ মুসলমান এবং ২০৫০ সাল নাগাদ এই সংখ্যা ১৮ শতাংশে উন্নীত হবে। জার্মানির হামবুর্গ শহরের সমস্ত স্কুলছাত্রের অর্ধেকের বেশি অভিবাসী পরিবারের। এসব জরিপ, ইউরোপিয়ান নাগরিকদের চিন্তিত করছে।
৭ অক্টোবরের হামাসের হামলার আগে ভিল্ডার্স মোট ভোটের মাত্র ১০ শতাংশ পেয়েছিলেন। কিন্তু বেশির ভাগ প্রধান ইউরোপীয় শহরে হামাসের সমর্থনে ইউরোপীয় মুসলিমরা ব্যাপক বিক্ষোভ করার পর তিনি ৩৫ শতাংশ আসন জেতেন।
ইউ ডট গভ নামের একটি জরিপে দেখা গেছে, ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ৫৯ শতাংশ জার্মান তাঁদের দেশে ব্যাপক সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা করছেন। জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ২৭ শতাংশ জার্মান ভাবছেন সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা নেই।
ইউরোপের ডানপন্থীরা সফলভাবেই সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে এই সন্দেহ ঢুকিয়ে দিতে পেরেছেন যে ইউরোপে অভিবাসী হয়ে আসা মুসলমানরা ইউরোপীয়দের জন্য হুমকি হয়ে উঠবে। এই ধারণা যত বেশি ছড়াচ্ছে, ততই ডানপন্থী দলগুলো জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এরই ধারাবাহিকতায় নেদারল্যান্ডসে অতি দক্ষিণপন্থীদের জয় হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছে, এই ধারা অব্যাহত থাকবে এবং ইউরোপের অন্যান্য দেশেও মুসলিমবিরোধী দলগুলো জয়ী হবে। এটি মুসলমান অভিবাসীদের জন্য নিশ্চিতভাবে দুশ্চিন্তার বিষয়।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত
ডেভিড পল গোল্ডম্যান আমেরিকান অর্থনৈতিক কৌশলবিদ ও লেখক