২০২০ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যখন হোয়াইট হাউস ছাড়তে হলো, ইউরোপের ‘স্ট্রং মেন’, জনতুষ্টিবাদী ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রত্যাখ্যানকারীরা তাদের একজন মিত্র ও রক্ষককে হারাল। এর মধ্যে ট্রাম্প হার মানবেন না বলে গোঁ ধরলেন, তাঁর সমর্থকেরা কংগ্রেস লন্ডভন্ড করে ছাড়লেন। কিন্তু ইউরোপের খুদে ট্রাম্পরা টিকে থাকলেন। রিপাবলিকানদের প্রিয় প্রার্থী হিসেবে ট্রাম্প আবার ফিরে আসবেন এই আশায় তাঁদের পালে এখন নতুন করে হাওয়া লেগেছে।
যে চার বছর ক্ষমতায় ছিলেন ট্রাম্প, সে সময় তিনি ইউরোপীয় ইউনিয়নকে ‘শত্রু’ আর ন্যাটোকে ‘অচল’ বলে ঘোষণা করলেন। তিনি প্রকাশ্যে যুক্তরাজ্যের ব্রেক্সিটের পক্ষে ভোটকে স্বাগত জানিয়েছিলেন। বলেছিলেন অন্য দেশগুলোরও উচিত সে পথে হাঁটা।
ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রকে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বৈশ্বিক বিভিন্ন চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করে নেন। অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি ছুড়ে ফেলেন, মিত্র দেশগুলোর ওপর ট্যারিফ আরোপ করেন এবং বাণিজ্য ও সামরিক খাতের ব্যয় নিয়ে জার্মানির সঙ্গে বিবাদে জড়ান। পোল্যান্ড ও হাঙ্গেরির জনতুষ্টিবাদী নেতাদের জন্য লাল গালিচা পেতে দিয়েছেন।
আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশের জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তারা ২০২৪ সালে প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের ফেরা নিয়ে ভয়ে কাঁপছেন। কারণ ট্রাম্প ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার যুদ্ধে ইউক্রেনকে সমর্থন দিতে রাজি হননি। এ ছাড়া তিনি ইইউ থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর ট্যারিফ বসাবেন বলে আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন।
হাঙ্গেরির ভিক্টর ওরবান বা পোল্যান্ডের ইয়ারোস্লাভ ক্যাজিস্কি, যারা ইউরোপে ট্রাম্পের মতো আগ্রাসী রাজনীতি করেন তাঁরা এখনো ক্ষমতায় আছেন। তাঁরা নিয়মিত শাসন, অভিবাসন ও যৌন সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে ব্রাসেলসের সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করছেন।
মূলধারার গণমাধ্যমকে এড়িয়ে ডানপন্থী সংবাদমাধ্যমকে প্রাধান্য দেওয়ার যে কৌশল চালু করেছিলেন ট্রাম্প, সেটা এখন ইউরোপেও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ডানপন্থী ফক্স নিউজের আদলে বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম গড়ে উঠেছে ইউরোপের দেশগুলোয়। চ্যানেলগুলো চরম ডান রাজনীতিবিদদের কথা বলার একচেটিয়া সুযোগ করে দিয়েছে। তারা যা খুশি তাই বলতে পারে এবং তাদের কোনোরকম যাচাই-বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয় না। অন্যান্য দেশে জনতুষ্টিবাদী সরকারগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে তাদের অনুসারীদের কাছে পৌঁছাতে চায়।
স্লোভাকিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী রবার্ট ফিকো যদি ৩০ সেপ্টেম্বরের নির্বাচনে ফিরতে পারেন, তাহলে অনুদার নেতাদের এই জোট আরও বড় হবে। বলা হয়ে থাকে রবার্ট ফিকো পুরোপুরি অনুসরণ করে থাকেন ট্রাম্পকে। ক্ষমতাসীন উদারনৈতিক সরকারের বিরুদ্ধে ফিকো ভোট চুরির জিগির তুলেছিলেন। কারণ তার ফিকোর সহযোগী আপাদমস্তক দুর্নীতিবাজ পুলিশ প্রধান তদন্তে দোষী প্রমাণিত হন ও তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়।
ফিকোর দল ‘স্মের’ ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক-গণতান্ত্রিক জোটভুক্ত রাজনৈতিক দল। তিনি ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোকে দায়ী করেন। পাশাপাশি তিনি এও ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন যে, জিতে আসলে কিয়েভকে আর সাহায্য দেবেন না। স্লোভাকিয়ার বিশ্লেষকদের আশঙ্কা তিনি এবার সরকার গঠন করলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কেড়ে নেবেন ও দুর্নীতি বিরোধী কার্যক্রমকে থামিয়ে দেবেন। ঠিক যেমনটি ঘটিয়েছেন ভিক্টর ওরবান এবং ক্যাজিস্কি। অভিবাসন নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়নের যে চুক্তি সেখান থেকেও হয়তো ফিকো বেরিয়ে আসতে চাইবেন। ওই চুক্তি অনুযায়ী ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোকে নির্দিষ্ট সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দিতে হয়, নয়তো আর্থিকভাবে সাহায্য করতে হয়।
ব্রাটিসলাভা পর ইউরোপের ট্রাম্পীয় নেতাদের জন্য বড় পরীক্ষা হবে ওয়ারশ তে। এখানে ক্যাজিস্কির রক্ষণশীল জাতীয়তাবাদী দল ল অ্যান্ড জাস্টিস পার্টি তৃতীয়বারের মতো নির্বাচিত হয়ে আসতে চায়। আগামী ১৫ অক্টোবর সেখানে নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। ক্যাজিস্কি উদারপন্থী দক্ষিণ-কেন্দ্রপন্থী বিরোধী দলীয় নেতা ডোনাল্ড টাস্ককে ক্রমাগত চেষ্টায় খল চরিত্র বানিয়ে বসেছেন। শুধু তাই নয়, রাশিয়া, জার্মানি, ব্রাসেলসের পর তাঁর নিশানা এখন ইউক্রেন। ওই সব দেশ থেকে শস্য আমদানি করায় পোল্যান্ডের কৃষকেরা শেষ হয়ে যাচ্ছেন এমন প্রচার চালাচ্ছেন তিনি।
হাঙ্গেরির ওরবান গত বছর যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীল দল কনজারভেটিভ পলিটিক্যাল কনফারেন্স (সিপ্যাক) বুদাপেস্টে আমন্ত্রণ করেছিলেন। তিনি আবার ফক্স টিভির উপস্থাপক টাকার কার্লসনের বন্ধুও। ওরবান তাঁর দেশের সংবাদমাধ্যম, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং রাষ্ট্রের অন্য প্রতিষ্ঠানকে কবজা করে গত বছর বিরোধী দলকে কোণঠাসা করে ফেলেন।
স্লোভেনিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী জানেয জান এ ভোট গণনা শেষ হওয়ার আগেই ট্রাম্প জয়ী হয়েছেন বলে টুইট করেন। গত বছর তাঁকে উদারপন্থীরা হারিয়ে দিয়েছে। তবে এই প্রৌঢ় রাজনীতিবিদ দেশের বৃহত্তম বিরোধী দলের নেতা। রাজনীতির কবর থেকে যেকোনো সময় বেরিয়ে আসার জন্য উন্মুখ হয়ে আছেন।
মূলধারার গণমাধ্যমকে এড়িয়ে ডানপন্থী সংবাদমাধ্যমকে প্রাধান্য দেওয়ার যে কৌশল চালু করেছিলেন ট্রাম্প, সেটা এখন ইউরোপেও জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। ক্যাজিস্কি বা ওরবান রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যমগুলোকে তালুবন্দী করেছেন। ডানপন্থী ফক্স নিউজের আদলে বেশ কিছু সংবাদমাধ্যম গড়ে উঠেছে ইউরোপের দেশগুলোয়। যেমন ফ্রান্সের সিনিউজ। এই চ্যানেলটি চরম ডান রাজনীতিবিদদের কথা বলার একচেটিয়া সুযোগ করে দিয়েছে। তারা যা খুশি তাই বলতে পারে এবং তাদের কোনোরকম যাচাই-বাছাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয় না। অন্যান্য দেশে জনতুষ্টিবাদী সরকারগুলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে ব্যবহার করে তাদের অনুসারীদের কাছে পৌঁছাতে চায়।
তবে ট্রাম্পের পরামর্শদাতা স্টিভ ব্যানন ইউরোপের ডানপন্থী দলগুলোর যে জোট তৈরি করতে চেয়েছিলেন তা ব্যর্থ হয়েছে। তাঁর ইচ্ছে ছিল এই জোট ইউরোপীয় পার্লামেন্টে প্রভাব রাখবে এবং ইইউকে দুর্বল করে দেবে। তিনি এমনকি ইতালীয় একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে তরুণ ডানপন্থীদের লেখাপড়ার সুযোগ করে দিতে চেয়েছিলেন। যদিও আইনি বাধায় তাঁর এই চেষ্টা আর সফল হয়নি। ইউরোপের খুদে ট্রাম্পরা এখনো এক হতে পারেননি, অন্তত একটি বিষয়ে। আর তা হলো তাঁরা কি ইউক্রেনকে সমর্থন দেবেন নাকি দেবেন না।
যুক্তরাজ্যের অর্থনীতিতে ব্রেক্সিটের ক্ষতিকর প্রভাব দেখে ইউরোপের ডানপন্থীরা এখন আর ইইউ থেকে বেরিয়ে যাওয়া বা ইউরোর ব্যবহার নিষিদ্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে না। তারা এখন ‘ইউরোপীয় জাতিরাষ্ট্র’ গঠনের আওয়াজ তুলেছে। তারা চায় ইইউ’র আইনকানুনের চেয়ে জাতীয় আইন গুরুত্ব বেশি পাক।
হোয়াইট হাউসে ট্রাম্পের ফেরায় তাঁর ইউরোপীয় বন্ধুরা উজ্জীবিত হয়ে হয়তো ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিরোধী জোট গঠন করে ফেলতে পারবেন না। তবে রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক খাতে মাথাব্যথার কারণ হয়ে উঠতে পারেন। এটার মুখোমুখি হওয়ার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি কিন্তু দেশগুলোর নেই।
পল টেইলর ফ্রেন্ডস অফ ইউরোপ নামের একটি থিঙ্কট্যাঙ্কের জ্যেষ্ঠ ফেলো
দ্য গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ