গতকাল সোমবার দেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন মো. সাহাবুদ্দিন। তাঁর শপথের মধ্য দিয়ে সাবেক রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বঙ্গভবন থেকে বিদায় নিলেন। বিদায়ী রাষ্ট্রপতির বিদায় অনুষ্ঠানই কেবল বর্ণাঢ্য ছিল না, বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনিই সবচেয়ে বেশি সময় ধরে রাষ্ট্রপতি পদ অলংকৃত করে ছিলেন—১০ বছর ৪১ দিন। ২০১৩ সালে রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের মৃত্যুর পর তিনি প্রথমে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, পরে দুই মেয়াদে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।
এর আগে আবদুল হামিদ সাতবার জাতীয় সংসদের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন, ছিলেন ডেপুটি স্পিকার, স্পিকার ও বিরোধী দলের উপনেতা। এর মধ্যে ডেপুটি স্পিকার ও স্পিকার হিসেবে তাঁর ভূমিকা জাতীয় সংসদের সরকারি দল তো বটেই, বিরোধী দলেরও আস্থা অর্জন করেছে।
বিশেষ করে নবম সংসদে স্পিকার থাকাকালে তিনি অনেক কঠিন ও জটিল অবস্থার মধ্যে দায়িত্ব পালন করেছেন। নবম সংসদে বিরোধী দলের সংসদ সদস্য অনেক কম থাকলেও তিনি উভয় দলকেই যথাযথ সময় দিতে সচেষ্ট ছিলেন। আমাদের সরকারি ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা প্রায়ই সীমা লঙ্ঘন করতেন। অমার্জিত ভাষা ব্যবহার করতেন। এই প্রেক্ষাপটে স্পিকার আবদুল হামিদ বলেছিলেন, ‘সংসদকে মাছের বাজারে পরিণত করবেন না।’
তবে পঞ্চম জাতীয় সংসদের স্পিকার শেখ আবদুর রাজ্জাককে এবং অষ্টম জাতীয় সংসদে জমির উদ্দিন সরকারকে যতটা কঠিন অবস্থার মধ্যে সংসদ চালাতে হয়েছিল, আবদুল হামিদকে সেটা করতে হয়নি। নবম সংসদে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সংসদ সদস্য ছিল ১০ শতাংশের মতো।
এরশাদের জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলের শরিকদের পক্ষ থেকে আবদুল হামিদকে কোনো ঝামেলা পোহাতে হয়নি। পরের দুই সংসদে স্পিকার ছিলেন শিরীন শারমিন চৌধুরী। দশম সংসদ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করে। ১১তম সংসদ নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলেও ফলাফল ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত ও অপ্রত্যাশিত। গত ডিসেম্বরে ১০ দফা দাবিতে আন্দোলনের অংশ হিসেবে বিএনপির সাতজন সদস্য পদত্যাগ করেন। ফলে তার আগে সংসদে বিরোধী দল মৃদুকণ্ঠে হলেও সংসদে যে ভূমিকা রাখতে পেরেছিল, সেটি এখন পুরোপুরি অনুপস্থিত। জাতীয় পার্টি কার্যত ‘হিজ মাস্টার্স ভয়েস’ হিসেবে কাজ করছে।
স্পিকার হিসেবে আবদুল হামিদ যতই নিরপেক্ষভাবে ভূমিকা নেওয়ার চেষ্টা করুন না কেন, সংসদীয় গণতন্ত্র টেকসই হতে পারেনি আমাদের চিরবৈরী ও বিদ্বেষমূলক রাজনীতির কারণে। নব্বই-উত্তর সংসদীয় গণতন্ত্রের একটা বড় ব্যর্থতা প্রায় অর্ধেক সময় সংসদে বিরোধী দলের অনুপস্থিতি ও সরকারি দলের জবরদস্তি। রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান তাঁরা সংসদের বাইরেই খুঁজেছেন, এখনো খুঁজছেন।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে শত বিরোধিতা সত্ত্বেও একটি বিষয়ে তাদের মধ্যে ঐকমত্য আছে। বিরোধী দল থাকলে তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে তারা অতি আকর্ষণীয় ব্যবস্থা বলে মনে করে, এর জন্য কোন দল কত দিন হরতাল-অবরোধ করেছে, তার ফিরিস্তি দেয়। কিন্তু ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থাকে নিজের মতো করে সাজাতে চেয়েছিল। আওয়ামী লীগ আদালতের দোহাই দিয়ে পুরো ব্যবস্থাটিই বাতিল করে দিয়েছে। যদিও সর্বোচ্চ আদালত বলেছিলেন, সংসদ চাইলে দুই মেয়াদে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা থাকতে পারে।
আবদুল হামিদ আমাদের রাজনীতির সবচেয়ে ভাগ্যবান মানুষ। ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদের সদস্য থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেওয়ার আগপর্যন্ত জাতীয় সংসদেই ছিলেন তিনি। হাস্যরস, ঠাট্টা ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি সংসদকে প্রাণবন্ত করে রাখতেন। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর বক্তৃতায়ও এই হাস্যরস ছিল, যদিও তা কখনো কখনো তা শ্রুতিকটু মনে হয়েছে।
মো. আবদুল হামিদ দুই মেয়াদের অধিক সময় ধরে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। এই সময়ে দেশে একের পর এক রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হলেও তাঁর পক্ষ থেকে সমস্যা সমাধানের কোনো উদ্যোগ লক্ষ করা যায়নি। তবে নির্বাচন কমিশন গঠনে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা ভালো উদ্যোগ বলেই মনে করি। যদিও এতে কাজের কাজ কিছুই হয়নি। এমন অনেক রাজনৈতিক সমস্যা থাকে, যা সব সময় সংবিধান ও আইন দ্বারা মীমাংসা করা যায় না। এরশাদ প্রবর্তিত সংবিধানের অধীনেই ১৯৯১ সালে নির্বাচন হয়েছিল।
অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন, জাতীয় সংকট সমাধানে রাষ্ট্রপতির ভূমিকা রাখতে না পারার কারণ আমাদের সংবিধান। এই সংবিধানে প্রধানমন্ত্রীর হাতে অবারিত ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ৪৮(১) ধারায় রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘বাংলাদেশে একজন রাষ্ট্রপতি থাকিবেন, যিনি আইন অনুযায়ী সংসদ সদস্যগণ দ্বারা নির্বাচিত হইবেন। ৪৮(২) এ বলা হয়, রাষ্ট্রপ্রধানরূপে রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অন্য সকল ব্যক্তির ঊর্ধ্বে স্থান লাভ করিবেন এবং এই সংবিধান ও অন্য কোনো আইনের দ্বারা তাহাকে প্রদত্ত ও তাহার উপর অর্পিত সকল ক্ষমতা প্রয়োগ ও কর্তব্য পালন করিবেন।’
এরপরই ৪৮ অনুচ্ছেদের (৩) ধারায় আসল কথাটি উঠে এসেছে। এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে ‘কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন।’
এখানে যে দুটি ব্যতিক্রমের কথা বলা হয়েছে, তা-ও রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছার বাইরে করতে পারেন না। জাতীয় সংসদে যিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের আস্থা অর্জন করবেন, রাষ্ট্রপতি তাঁকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ দিতে বাধ্য। একইভাবে প্রধান বিচারপতি নিয়োগও হয়ে থাকে নির্বাহী বিভাগের ইচ্ছায়।
আমরা স্মরণ করতে পারি, শেখ হাসিনার প্রথম সরকারের আমলে রাষ্ট্রপতি ছিলেন বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদ। পুরো পাঁচ বছরই তিনি প্রায় নির্বিঘ্নে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০১-এর নির্বাচনের আগপর্যন্ত সদ্য বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে তাঁর বড় কোনো ইস্যুতে মতবিরোধ হয়নি।
বরং প্রতিবারই জাতীয় সংসদে দেওয়া ভাষণে লিখিত বক্তব্যের বাইরেও তিনি অনেকটা বিবেকের মতো রাজনৈতিক সমঝোতার কথা বলতেন। সে কথা কেউ শুনেছেন বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তঁার সম্পর্কটা শেষের দিকে খুব ভালো যায়নি।
তাঁর বিদায় খুব প্রীতিকর হয়নি। একবার বিচারপতি সাহাবুদ্দীন খেদের সঙ্গে বলেছিলেন, মিলাদ পড়া ও কবর জিয়ারত ছাড়া তাঁর কোনো কাজ নেই। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন তাঁর পাঁচ বছরের রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালনকালে একবারও চিকিৎসার জন্য বিদেশে গেছেন, মনে পড়ে না। আবদুল হামিদ অনেকবার গেছেন। অনেকে বলেন, এর মাধ্যমে বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি একধরনের অনাস্থা তৈরি হয়। বিরাট লটবহর নিয়ে তাঁর সর্বশেষ বিদেশ সফর ব্যাপকভাবে সমালোচিত হয়েছে।
আবদুল হামিদ আমাদের রাজনীতির সবচেয়ে ভাগ্যবান মানুষ। ১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদের সদস্য থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেওয়ার আগপর্যন্ত জাতীয় সংসদেই ছিলেন তিনি। হাস্যরস, ঠাট্টা ইত্যাদির মাধ্যমে তিনি সংসদকে প্রাণবন্ত করে রাখতেন। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর বক্তৃতায়ও এই হাস্যরস ছিল, যদিও তা কখনো কখনো তা শ্রুতিকটু মনে হয়েছে।
সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রপতি ক্ষমতাহীন হলেও রাষ্ট্রের প্রধান ব্যক্তি হিসেবে তাঁর আলাদা মর্যাদা ও অবস্থান আছে। মো. আবদুল হামিদ সেটা কতটা রক্ষা করতে পেরেছেন, ভাবীকাল তার বিচার করবে।
সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি