মূল্যবৃদ্ধির জন্য ‘যত দোষ কি সিন্ডিকেট ঘোষের’

কিছু হলেই সিন্ডিকেট, কেন এই প্রবণতা? তার কারণ হলো, এটা খুবই সহজবোধ্য ও আপাতদৃষ্টে বেশ যুক্তিযুক্ত একটা ব্যাখ্যা জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর। কিন্তু আসলেই কি সব ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট দায়ী, তা নিয়ে বিশ্লেষণ করেছেন রুশাদ ফরিদী

খুব সম্ভবত ২০০৯ সালের জুনের কোনো এক দিনের ঘটনা। একটা ফোন এল। ফোনে অন্য প্রান্তে একজন নারীর কণ্ঠ। তিনি বলছেন, সম্প্রতি একটি পত্রিকার কলামে আমার লেখা দেখে ফোন করেছেন।

আমি একটু অবাকই হলাম। আমি খুব বেশি নিয়মিত লিখি না। আর লিখলেও আমার লেখা কারও ভালো লাগলে পরিচিত না হলে সাধারণত ফোন করার কথা নয়। অপরিচিত ব্যক্তিরা সাধারণত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অথবা বড়জোর ই-মেইলে প্রতিক্রিয়া জানান।

তিনি জানান, তিনি পত্রিকায় যোগাযোগ করে আমার ফোন নম্বর নিয়েছেন। যা-ই হোক, কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর বুঝতে পারলাম, প্রথম আলোতে প্রকাশিত কলাম, যার শিরোনাম ছিল ‘ব্যবসা করা মহাপাপ’ লেখাটির কথা বলছেন। লেখাটি ছিল পবিত্র রমজান বা ঈদের আগে চিনির মূল্যবৃদ্ধি পরিস্থিতি নিয়ে।

চিনির দাম তখন বেড়ে যাওয়ায় আওয়ামী লীগ সরকার যথারীতি ফ্যাসিস্ট কায়দায় ব্যবসায়ীদের ধরে জেলে পাঠানো শুরু করে। ওই নারীর স্বামী এ রকম একজন চিনি ব্যবসায়ী ছিলেন এবং গ্রেপ্তার এড়াতে আত্মগোপনে ছিলেন।

তিনি স্বামী আর পরিবারের হয়ে আমার কাছে কৃতজ্ঞতা জানাতে চান। কারণ, সব আত্মীয়স্বজনের কাছে তাঁরা দাগি আসামির মতো নিজেদের মনে করছিলেন। এ সময় আমার লেখা দেখে তাঁরা বড়ই কৃতজ্ঞতা বোধ করেছেন। বিশেষ করে তাঁর স্বামী, ওই চিনি ব্যবসায়ী এই কৃতজ্ঞতা পৌঁছে দিতে বিশেষভাবে অনুরোধ করেছেন।

আমার সেই লেখার মূল বক্তব্য ছিল, ব্যবসায়ীরা যদি চাইলেই দাম বাড়াতে পারতেন, তাহলে তো তাঁরা নিশ্চয়ই রোজার জন্য অপেক্ষা করতেন না দাম বাড়ানোর জন্য। কারণ, ওটা একটা স্পর্শকাতর সময়। মিডিয়া ও সরকার এ সময় দামের ওপর কড়া নজর রাখে। তাহলে দাম বাড়ানো যদি তাঁদের নিয়ন্ত্রণে থাকে, তাহলে বোকার মতো ওই সময় কেন দাম বাড়াবেন?

ওই সময় দাম বাড়ার আসল কারণ ভোক্তারা চাহিদা বাড়িয়ে দেন, কিন্তু তখন জোগান অপরিবর্তিত থাকে। আর বাজারের অমোঘ নিয়মে তখন দাম বাড়ে। তখন দাম কমানোর একমাত্র উপায় সরবরাহ বাড়ানো। সরকার সেদিকে না গিয়ে ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তার অভিযান চালু করে। তাই ব্যবসা করাটাই ‘পাপ’ বলে মনে হচ্ছে।

অবাক হয়ে লক্ষ করলাম, এ ধারণা গত ১৫ বছরে বদলায়নি। সেই একই চর্বিত চর্বণ, যেকোনো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি ঘটলেই ‘সিন্ডিকেট, সিন্ডিকেট’ বলে সবাই ফেনা তুলে ফেলেন। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সাংবাদিক, মিডিয়া, অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা—সবাই শুধু সিন্ডিকেট নিয়ে পড়ে আছেন। সাম্প্রতিক দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণ হিসেবে দুষছেন সিন্ডিকেটকে।

কিছু হলেই সিন্ডিকেট, কেন এই প্রবণতা? তার কারণ হলো, এটা খুবই সহজবোধ্য ও আপাতদৃষ্টে বেশ যুক্তিযুক্ত একটা ব্যাখ্যা জিনিসপত্রের দাম বাড়ানোর। কারণ, আমি যখন বাজারে যাই আর যেকোনো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনি, তখন তো বিক্রেতার কাছ থেকেই কিনি। আর সে এক সপ্তাহ আগে যে দামে বিক্রি করতেন, তা আজ ২০ টাকা বেশি দিয়ে বিক্রি করেন।

তাহলে তো নিশ্চয়ই এই বোটা দায়ী। শুধু তিনি নন, দেখা যাচ্ছে বাজারে সবাই বেশি দামে বিক্রি করছেন। তাহলে নিশ্চয়ই তাঁরা এক হয়ে পরিকল্পনা করে করছেন। এই তো সিন্ডিকেট!

আপাতদৃষ্টে পানির মতো পরিষ্কার ‘ষড়যন্ত্রতত্ত্ব’ আসলে বেশির ভাগ সময় পুরোটাই ভুল। বিশেষ করে সেসব নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ক্ষেত্রে, যেগুলোর অনেক বিক্রেতা আর ক্রেতা আছেন এবং যেসব পণ্য মোটামুটি একই রকম।

তার মানে হলো, এক দোকানের পেঁয়াজ আরেক দোকানের থেকে আলাদা কিছু নয়। হলে তখন দামের পার্থক্য হতো। কিন্তু পেঁয়াজ, আলু, চাল, ডাল বা তেল—এ ধরনের পণ্যের মধ্যে যেহেতু এক দোকান থেকে আরেক দোকানে খুব একটা পার্থক্য নেই, তাই এসবের দামও মোটামুটি একই থাকে। এ ধরনের বাজারকে বলা হয় প্রতিযোগিতামূলক বাজার।

এ ধরনের প্রতিযোগিতামূলক বাজারে হাজার হাজার বিক্রেতার মধ্যে আসলে কোনো পরিকল্পনা বা যোগসাজশ করা সম্ভব নয়। যেটা পরিকল্পনা বা ষড়যন্ত্র করে দাম বাড়ানো বলে মনে হচ্ছে, সেটা আসলে বাজারের ‘অদৃশ্য হাত’, যেটা বিক্রেতা আর ক্রেতা দুই পক্ষই মিলে নিয়ন্ত্রণ করে।

বেশির ভাগ সময় দাম যখন বাড়ে, তখন খেয়াল করলে দেখা যাবে, দু-দুটি জিনিসের একটা অথবা দুটিই ঘটছে। হয় সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটেছে, নয়তো চাহিদা বেড়েছে। রোজা বা ঈদের সময় যেমন কিছু পণ্যের চাহিদা অবশ্যম্ভাবীভাবে বেড়ে যায়, যেমন চিনি, পেঁয়াজ, তেল ইত্যাদি। তখন একটা পণ্যের ‘সরবরাহ শৃঙ্খল’ বা সাপ্লাই চেইনের প্রতিটি স্তরে প্রভাব পড়ে। একই ঘটনা ঘটে যখন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাজারে কোনো পণ্যের সরবরাহ কমে যায়।

সাম্প্রতিক কালের সবজির মূল্যবৃদ্ধির উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে। ধরা যাক, নরসিংদীর কোনো এক আড়তে সবজি বিক্রি হচ্ছে। সেখানে ঢাকায় আনার জন্য বেশ কয়েকটি ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে যেটা ঘটে তা হলো, এই আড়ত থেকে ঢাকার কারওয়ান বাজারে সবজি নিয়ে আসতে ফড়িয়ারা একটা অলিখিত নিলামে অংশ নেন। সেই প্রক্রিয়াটি আমরা একটু বোঝার চেষ্টা করতে পারি।

আমরা জানি, এ বছর দুই থেকে তিন দফা বন্যা হয়েছে। সেই সঙ্গে অস্বাভাবিক প্রবল বৃষ্টি একেবারে অসময়ে। এ কারণে সবজির চাষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই তাই বাজারে সবজি কম এসেছে। যেহেতু বাজারে সরবরাহ কম, তাই সেই অলিখিত নিলামে যে বেশি দাম হাঁকছেন, সেই ফড়িয়া ঝটপট সবজি তুলছেন ট্রাকে।

সেই সবজি যখন কারওয়ান বাজারে বিক্রি হচ্ছে, তখন সব খুচরা বিক্রেতা ওই ফড়িয়ার কাছ থেকে বেশি দামে কিনছেন। কারণ, ওই ফড়িয়া নিজেও বেশি দামে কিনেছেন। তখন স্বাভাবিকভাবেই সব খুচরা বিক্রেতা বেশি দামে বিক্রি করবেন। আর তখন মনে হবে সেসব বিক্রেতা নিশ্চয়ই ষড়যন্ত্র করে বেশি দামে বিক্রি করছেন। এই তো সিন্ডিকেট!

একই ঘটনা ঘটেছে এ সময়ে আলোচিত আরেকটি পণ্য ডিমের বাজারে। এই বছর প্রচণ্ড গরমে, বিশেষ করে মে মাস থেকে শুরু করে সেই গরম আর আর্দ্রতা চলে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত। প্রচণ্ড গরমে মুরগির ওজন অনেক কম হয়। অনেক মুরগি মারা যায়। সব মিলিয়ে মুরগির ডিম উৎপাদনক্ষমতা অনেক কমে যায়। এর ফলে স্বাভাবিকভাবে বাজারে ডিমের সরবরাহ কমে যায়।

এরপর মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আসে একাধিক বন্যা। এতে পোলট্রি খামারিরা আরও প্রতিকূলতার সম্মুখীন হন। ফলে সবজির বাজারের মতো ওই বাজারেও সংকট তৈরি হয়। বাজারের স্বাভাবিক নিয়মে ডিমের দাম বেড়ে যায়। এখানেও আসলে সিন্ডিকেট বলে কিছু নেই। সিন্ডিকেট করা সম্ভব নয়। কারণ, ডিমের বাজারও অন্যান্য নিত্যপণ্যের বাজারের মতো তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বাজার।

সিন্ডিকেটের সঙ্গে সম্পর্কিত আরেকটি ধারণা হলো যে উৎপাদককে ঠকিয়ে মধ্যস্বত্বভোগী ব্যক্তিরা অসাধু উপায়ে বেশি মুনাফা করেন এবং সে কারণে বাজারে যেকোনো পণ্যের দাম অনেক বেড়ে যায়। এটা ঠিক যে কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে উৎপাদক বা অন্য যেকোনো এজেন্ট, যারা একটা পণ্যের সরবরাহের যেকোনো একটা স্তরে (সাপ্লাই চেইনে) আছে, তারা সবাই এই মূল্যবৃদ্ধির সুবিধা সমানভাবে পায়নি।

এই সুবিধা পাওয়া না–পাওয়া অনেকটা নির্ভর করে সেই এজেন্টের পণ্য সংরক্ষণের ক্ষমতা (স্টোরেজ ক্যাপাসিটি) কতটুকু আছে। তাই বাজারে দাম বাড়ছে, এই খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যার কাছে যে পণ্য আছে, সেটার বিক্রি কমিয়ে দেবেন, বিক্রেতা এই আশায় যে দাম আরও বাড়বে। এটা বাজারের খুবই স্বাভাবিক একটি প্রবণতা। যদিও অনেকে একে মজুতদারি বলে বিরাট একটি অপরাধের তকমা দেন। কিন্তু একজন বিক্রেতার কি পূর্ণ অধিকার আছে যে তাঁর যখন সুবিধা, তখন তিনি পণ্য বিক্রি করবেন?

কারণ, যখন বাজারে মূল্যহ্রাস ঘটতে থাকে, তখন বিক্রেতার ক্ষতি হলেও তিনি বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। তখন তো বাজারে হইচই ওঠে না যে এই বিক্রেতা কেন ক্ষতি করে তাঁর পণ্য বিক্রি করছেন। সে কোন সময়ে কতটুকু বিক্রি করবেন আর কতটুকু সংরক্ষণ করবেন, সেটি সম্পূর্ণ তাঁর কৌশলগত ব্যবসায়িক সিদ্ধান্ত।

আর এটাও মাথায় রাখতে হবে, যেসব সাপ্লাই চেইন এজেন্ট পণ্য সংরক্ষণ করতে পারে, স্বাভাবিকভাবেই তার মুনাফা নির্ধারণ করার ক্ষমতা বেশি থাকে। কারণ, এই সংরক্ষণ বা স্টোরেজ ক্যাপাসিটি তৈরি করার জন্য তার ব্যয় করতে হয়েছে। সে জন্য তার লাভ স্বাভাবিকভাবেই বেশি থাকবে। কিন্তু মিডিয়াতে দুম করে চলে আসবে, সিন্ডিকেট করে উৎপাদকের চেয়ে বেশি লাভ করছেন আড়তদার।

তবে কিছু পণ্য যেগুলো মূলত আমদানিনির্ভর, যেমন পেঁয়াজ, তেল—সেখানে আমদানি পর্যায়ে সিন্ডিকেট তৈরি হতে পারে, এটা অস্বীকার করার জো নেই। কারণ, আমদানি একটি ব্যয়বহুল প্রক্রিয়া এবং এখানে ব্যবসার পরিধি খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, আপনি চাইলেই ১০ কেজি পেঁয়াজ আমদানি করতে পারবেন না। আমদানি করতে গেলে অন্তত হাজার মেট্রিক টনে যেতে হবে। সে রকম ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান স্বাভাবিকভাবেই কম এবং তখন সেটা প্রতিযোগিতামূলক বাজার আর না-ও থাকতে পারে। কিন্তু এ রকম বাজারেও সিন্ডিকেট আছে কি না, সেটাও উপযুক্ত গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণসাপেক্ষ।

এ তো গেল বড় ব্যবসায়ীদের বিষয়। এদিকে যাঁরা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, ক্ষুদ্র চাষি বা কৃষক, তাঁরা পচনশীল দ্রব্য যেমন শাকসবজি, মাছ এসব সরবরাহ বেড়ে গেলে ক্ষতিতে বাজারে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন। কারণ, কম দামে বিক্রি এড়ানোর জন্য সেগুলো সংরক্ষণের কোনো উপায় তাঁদের নেই।

তাই আমরা যদি মনে করি, দরিদ্র কৃষকের ন্যায্যমূল্য পাওয়া উচিত, তাহলে একজন আড়তদার কেন বেশি মুনাফা করছেন, তাই নিয়ে হায় হায় করলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। বরং এর চেয়ে বেশি দরকার, কী করে দরিদ্র কৃষকের পণ্য সংরক্ষণের ক্ষমতা বাড়ানো যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া দরকার। প্রান্তিক পর্যায়ে কোল্ডস্টোরেজ তৈরি করে বিনা মূল্যে বা স্বল্প মূল্যে তা কৃষকদের ব্যবহার করতে দিতে হবে। এসব পদক্ষেপ অনেক বেশি কার্যকর হবে ‘সিন্ডিকেট’, ‘সিন্ডিকেট’ বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলার বদলে।

পরিশেষে এটাই বলব, মূল্যবৃদ্ধিতে এসব হরেদরে সিন্ডিকেটের ধুয়া তোলা বন্ধ করতে হবে। তবে কোনো কোনো পণ্যে যে সিন্ডিকেট নেই, সেই দাবি আমি মোটেও করছি না, থাকতেই পারে। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো নির্ভরযোগ্য গবেষণা চোখে পড়েনি যেটি প্রমাণ করতে পেরেছে যে ‘অমুক’ পণ্যের বাজারে সিন্ডিকেট আছে। যা আছে সবই জনতুষ্টিকর সরল সংবাদ পরিবেশনা, যেটা এই ক্ষতিকর বয়ান তৈরি করছে যে জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধি মানেই পেছনে, সিন্ডিকেট। এর ফলে সবচেয়ে ক্ষতি যেটা হচ্ছে যে আসলেই যদি কোনো পণ্যে সিন্ডিকেটের প্রভাব থাকে, তাহলে সেটি আড়াল হয়ে যাচ্ছে।

আপনি যখন সবাইকে ঠক তকমা দিয়ে গঁা উজাড় করে দিচ্ছেন, তখন আসল ঠক কিন্তু আড়ালে পড়ে যাচ্ছে আর মিটিমিটি হাসছে।

  • ড. রুশাদ ফরিদী, সহকারী অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়