পাকিস্তানে যে কারণে সন্ত্রাসী হামলা বাড়ছে

পেশোয়ারে পুলিশ লাইন মসজিদে সন্ত্রাসী হামলার পর সতর্ক নিরাপত্তা বাহিনী
ছবি: এএফপি

আফগানিস্তানের সীমান্ত লাগোয়া পাকিস্তানের খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের পেশোয়ার শহরের একটি মসজিদে গত ৩০ জানুয়ারি আত্মঘাতী বোমা হামলায় শতাধিক লোক নিহত ও সোয়া দুই শর বেশি লোক আহত হন। সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ এ হামলা হয়েছে উচ্চ নিরাপত্তায় ঘেরা একটি পুলিশ লাইনসের মধ্যে।

হামলার পরপরই তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানে (টিটিপি) যুক্ত একজন কমান্ডার দায় স্বীকার করে টুইট করলেও তার খানিকক্ষণ পর টিটিপির এক মুখপাত্র হামলায় তাঁদের সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগ নাকচ করেছেন।

পাকিস্তানের নেতারা যখন তাঁদের অভ্যন্তরীণ নানা সংকট সামাল দিতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন, ঠিক সেই মুহূর্তে সেখানে এই মাত্রার বোমা বিস্ফোরণ তাঁদের জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে বলে মনে হয় না।

সর্বশেষ এ হামলা দেশটির সন্ত্রাসবিরোধী নীতি কৌশলের বিশদ পুনর্মূল্যায়ন দাবি করছে। তবে পাকিস্তানে সম্প্রতি যে আর্থসামাজিক অস্থিরতা ও রাজনৈতিক মেরুকরণ চলছে, তাতে দেশটির নেতারা ক্রমবর্ধমান নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জগুলো সফলভাবে মোকাবিলা করতে পারবেন কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে।

১৫ বছর ধরে থেমে থেমে সহিংস তৎপরতা চালানো টিটিপি যদিও সোমবারের ওই জঘন্য হামলা থেকে নিজেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছে, তথাপি এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে গ্রুপটি ও তাদের মিত্র গ্রুপগুলো পুলিশ ও অন্যান্য নিরাপত্তা কর্মীদের নিশানা করে হামলা চালাচ্ছে এবং খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশের বাইরেও তাদের তৎপরতা বিস্তার করার চেষ্টা করছে। গত নভেম্বর থেকে এ পর্যন্ত টিটিপি প্রায় ১০০টি হামলা চালিয়েছে।

পাকিস্তানের নীতিনির্ধারকেরা বলছেন, ২০২১ সালে প্রতিবেশী দেশ আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতা দখলের পর টিটিপি সাংঘাতিক উপকৃত হয়েছে এবং আফগানিস্তান তাদের জন্য অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে।

সন্ত্রাসী হামলায় বিধ্বস্ত পুলিশ লাইন মসজিদ। পেশোয়ার
ছবি: এএফপি

আফগান তালেবান মনে করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে হাতিয়ার হিসেবে টিটিপিকে কাজে লাগানো যেতে পারে এবং এ কারণেই তারা টিটিপির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী নয়। টিটিপিকে আশ্রয় দিয়ে আফগান তালেবান পাকিস্তানের নিরাপত্তা ও প্রতিষ্ঠানগুলোকে নাজুক করতে চায়, যাতে তারা তাদের নিজেদের কৌশলনীতিকে সর্বোচ্চ মাত্রায় স্বনির্ভর করতে পারে।

শুরুতে আফগান তালেবানের বিষয়ে ইসলামাবাদের কঠোরতা নিয়ন্ত্রিত অবস্থায় থাকলেও তালেবান কাবুল দখল করে নেওয়ার পর থেকে সেই কঠোরতা হ্রাস পেয়েছে। সে কারণেই পাকিস্তানের কর্মকর্তারা তালেবানের বিষয়ে ‘এক দিকে গাজর, আরেক দিকে লাঠি’ নীতি অনুসরণ করছেন। একদিকে তাঁরা আফগান তালেবানের মধ্যস্থতায় টিটিপির নেতাদের সঙ্গে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসে সমঝোতার চেষ্টা করছেন, অন্যদিকে তাঁরা আফগানিস্তানে ঢুকে গোয়েন্দাদের দিয়ে টিটিপি কমান্ডারদের লক্ষ্য করে অভিযান চালাচ্ছেন।

পাকিস্তানের এ ধরনের অভিযানে কৌশলগত কিছুটা সাফল্য পাওয়াও গেছে। যেমন পাক সেনাদের অভিযানে গত বছর টিটিপির কমান্ডার খালিদ খোরাসানি নিহত হয়েছিলেন। তবে মোটের ওপর পাকিস্তানের এই দ্বৈত কৌশল তাদের টিটিপি দমনের উদ্দেশ্যকে সফল করতে পারছে না।

আরও পড়ুন

গত নভেম্বরে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী সীমান্ত এলাকায় সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান চালানোর পর টিটিপি পাঁচ মাসের অস্ত্রবিরতি থেকে বেরিয়ে আসে। গত সোমবারের হামলার পর টিটিপির দেওয়া প্রথম বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, তাঁদের নেতা খোরাসানির হত্যার বদলা হিসেবেই ওই হামলা চালানো হয়েছে।

এ পর্যন্ত টিটিপির সঙ্গে যতবার আলোচনা হয়েছে, ততবার স্বল্প মেয়াদের অস্ত্রবিরতির চেয়ে বেশি কিছু ফল পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে টিটিপি সারা দেশে তাদের ঘোষিত কঠোর শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠা এবং ২০১৮ সালে ফেডারেলি অ্যাডমিনিস্ট্রার্ড ট্রাইবাল এরিয়াস (সংক্ষেপে ‘ফাটা’) নামের উপজাতি অধ্যুষিত যে এলাকাটি খাইবার পাখতুনখাওয়ার সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে, সেটিকে আগের আধা স্বায়ত্তশাসিত এলাকার মর্যাদায় ফিরিয়ে নেওয়ার সংকল্পে অনড় আছে।

ইসলামাবাদের ক্ষমতাসীন জোটকে আগাম নির্বাচন দিতে বাধ্য করার কৌশল হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের দল তেহরিক-ই-ইনসাফ তাদের অধীন থাকা পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখাওয়ার প্রাদেশিক সরকার ভেঙে দিয়েছে। সেখানে তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিয়েছে। ৯০ দিনের মধ্যে সেখানে নতুন নির্বাচন দেওয়ার কথা। কিন্তু রাজনৈতিক সরকার সেখানে না থাকায় যে শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে, টিটিপি নির্ঘাত তার সুযোগ নেবে।

এ রাজনৈতিক শূন্যতার সুযোগ নিয়ে জঙ্গি গোষ্ঠী খাইবার পাখতুনখাওয়ার বেসামরিক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর যে হামলা চালাচ্ছে, তা দেখে মনে হচ্ছে, এর মাধ্যমে তারা সহিংস জঙ্গি তৎপরতা ঠেকাতে প্রাদেশিক সরকারের দুর্বলতাকে প্রকাশ করতে চাচ্ছে এবং একই সঙ্গে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীতে নতুন সদস্য জোগাড়ের চেষ্টা করছে।

টিটিপিসহ অন্য জঙ্গি গোষ্ঠীগুলো জানে, এ মুহূর্তে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই নাজুক। এ কারণে সামাজিক অস্থিরতা বাড়ছে। আর সেটিকেই তারা তাদের বিস্তৃতির সুযোগ হিসেবে নিচ্ছে।

আল–জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত

  • ফাহাদ হুমায়ূন ইয়েল ইউনিভার্সিটির পিএইচডি গবেষক।