তুরস্কের প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের উত্তেজনা থিতু হয়ে এসেছে এবং রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান তাঁর ক্ষমতার তৃতীয় দশক শুরু করেছেন। এবার প্রতিবেশী সিরিয়ার সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্কটি তাঁর মনোযোগের কেন্দ্রে আসতে পারে। সিরীয় শরণার্থী, সিরিয়ায় তুরস্কের সামরিক সম্পৃক্ততা এবং প্রেসিডেন্ট বাশার আল–আসাদের সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের বিষয়গুলো তুরস্কের নির্বাচনের কারণে ঝুলে ছিল।
আঙ্কারা ও দামেস্কের মধ্যে রাশিয়ার মধ্যস্থতায় যে সংলাপ চলমান রয়েছে, তার গতিপথ কী হবে—সেটা তুরস্কের নির্বাচনের ফলাফলের ওপর নির্ভর করছিল। এরদোয়ানের বিজয় এবং আরব লিগে সিরিয়ার প্রত্যাবর্তন—দুই পক্ষেই ইতিবাচক ও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। কয়েক বছরের কূটনৈতিক প্রচেষ্টার পর আঙ্কারা ও দামেস্ককে সংলাপে বসাতে সফল হয় মস্কো।
এ ছাড়া ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ার সংঘাতে তুরস্কের সম্পৃক্ততার কারণে আরব দেশগুলোর সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্কে অবনতি হয়েছে। ওই অঞ্চলে আঙ্কারার ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকানোর উপায় খুঁজছে তারা। সিরিয়ায় তুরস্কের সেনাবাহিনীর উপস্থিতি নিয়ে সরাসরি কোনো অবস্থান নেওয়ার কথা বলবে বলে মনে হয় না, কিন্তু আরব লিগের সঙ্গে সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ুক, সেটাও চাইবেন না তিনি।
কয়েক স্তরের দেনদরবার শেষে দুই পক্ষ আলোচনায় বসে। প্রথমে তুরস্ক ও সিরিয়ার গোয়েন্দাপ্রধানেরা বসেন, পর্যায়ক্রমে আলাপ–আলোচনা প্রতিরক্ষামন্ত্রী পর্যায় পর্যন্ত গড়ায়। সম্প্রতি মস্কোয় সিরিয়া ও তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের যে সংলাপটি অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেটাকে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি বলা যায়। সিরিয়া–তুরস্ক সম্পর্ক সম্প্রসারণের লক্ষ্যে উচ্চপর্যায়ে যোগাযোগ ও সম্পৃক্ততা বজায় রাখার সিদ্ধান্ত হয় সর্বশেষ সংলাপে।
গত বছর দুই পক্ষের গোয়েন্দাপ্রধানদের মধ্যে প্রথম যখন দেনদরবার শুরু হয়েছিল, সে সময় তুরস্কের পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হাকান ফিদান। ৩ জুন এরদোয়ান তাঁর মন্ত্রিসভায় নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে ফিদানকে দায়িত্ব দিয়েছেন। সিরিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ক্ষেত্রে এটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারে।
যাহোক, দুই পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তিতে পৌঁছানোর পথটি এখনো কণ্টাকাকীর্ণ। দুই দেশের দাবিদাওয়ার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পার্থক্য রয়েছে। তুরস্কের অগ্রাধিকার হলো সিরিয়ার উত্তর–পূর্বাঞ্চলের কুর্দি পরিচালিত প্রশাসন ভেঙে দেওয়া এবং সিরীয় শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন। অন্যদিকে আসাদের মূল চাওয়া হলো, সিরিয়ার ভূখণ্ড থেকে তুরস্কের সেনাবাহিনীর পুরোপুরি প্রত্যাহার।
আসাদের জন্য নতুন বাস্তবতা
সর্বশেষ সংলাপের পর বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। নির্বাচনে বিজয় এরদোয়ানকে তার দেশের ভেতরের চাপ থেকে অনেকটা মুক্ত করেছে। সিরীয় শরণার্থীদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় অগ্রগতি ঘটছে—সেটা দেখানোর জন্য এরদোয়ান নির্বাচনের আগেই আসাদের সঙ্গে দেখা করার আগ্রহ দেখিয়েছিলেন।
যাহোক, এরদোয়ানের উদ্দেশ্য নিয়ে আসাদ যথেষ্ট সজাগ ছিলেন। মস্কোর চাপ থাকার পরও তড়িঘড়ি করে একটা চুক্তি করে এরদোয়ানকে সহযোগিতা তিনি করেননি। তুরস্কে নতুন কারা ক্ষমতায় আসবে, সেটা দেখতে চেয়েছেন আসাদ। তিনি মনে করেছেন, নতুন সরকারের সঙ্গে দর–কষাকষি করলে কিছুটা সুবিধা আদায় করে নিতে পারবেন।
এরদোয়ান যখন পাঁচ বছরের জন্য তাঁর ক্ষমতা সুসংহত করেছেন, এখন আসাদকে তাঁর ‘অপেক্ষা করো ও দেখো’—এই কৌশল পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। নতুন যে বাস্তবতা তৈরি হয়েছে, সেই আলোকেই তাঁকে বিকল্পটা চিন্তা করা উচিত। গত মে মাসে আরব লিগের সম্মেলনে আসাদ আমন্ত্রণ পান। দীর্ঘদিন ধরে কূটনৈতিকভাবে একঘরে হয়ে থাকা আসাদ সরকার আরব সম্প্রদায়ের কাছ থেকে যে উষ্ণ অভ্যর্থনা পেয়েছে, তাতে তুরস্কের সঙ্গে সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠা তাঁর কাছে গুরুত্ব হারাতে পারে।
এ ছাড়া ইরাক, লিবিয়া ও সিরিয়ার সংঘাতে তুরস্কের সম্পৃক্ততার কারণে আরব দেশগুলোর সঙ্গে আঙ্কারার সম্পর্কে অবনতি হয়েছে। ওই অঞ্চলে আঙ্কারার ক্রমবর্ধমান প্রভাব ঠেকানোর উপায় খুঁজছে তারা। সিরিয়ায় তুরস্কের সেনাবাহিনীর উপস্থিতি নিয়ে সরাসরি কোনো অবস্থান নেওয়ার কথা বলবে বলে মনে হয় না, কিন্তু আরব লিগের সঙ্গে সম্পর্কে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ুক, সেটাও চাইবেন না তিনি।
পরিবর্তিত বাস্তবতায় তুরস্ক ও সিরিয়ার মধ্যে একটি চুক্তি যাতে সম্পাদিত হয়, সেই ক্ষেত্র তৈরি করতে রাশিয়াকে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। কিন্তু ইউক্রেন যুদ্ধে রাশিয়াকে যেভাবে মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে হচ্ছে, তাতে তুরস্ক ও সিরিয়ার দিকে তাদের কতটা মনোযোগ দেওয়া সম্ভব?
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ
হাইদ হাইদ আন্তর্জাতিক থিঙ্কট্যাংক চ্যাটাম হাউসের মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকা কর্মসূচির আসোসিয়েট ফেলো