৫ মার্চ রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকায় একটি তিনতলা ভবনে বিস্ফোরণে তিনজনের মৃত্যু হয় ও ১৪ জন আহত হন। এর দুই দিনের মাথায় ৭ মার্চ পুরান ঢাকার সিদ্দিকবাজারের একটি সাততলা ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ভবনটির বেজমেন্ট, নিচতলা ও দোতলা একরকম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় এবং ক্ষতিগ্রস্ত হয় দুই পাশে লাগোয়া দুটি ভবনের কিছু অংশ। এ ঘটনায় ১১ মার্চ পর্যন্ত ২৪ জনের মৃত্যু ঘটেছে এবং আহত হয়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। আহত ব্যক্তিদের মধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন ৩১ জন। (সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণের ঘটনায় আরও একজনের মৃত্যু, প্রথম আলো, ১১ মার্চ ২০২৩)
ফায়ার সার্ভিস ও পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের প্রাথমিক তদন্ত অনুসারে, দুটি ক্ষেত্রেই তিতাস গ্যাস-সংযোগের লিকেজ বা ছিদ্র থেকে নির্গত গ্যাস আবদ্ধ স্থানে জমে এসব বিস্ফোরণ ঘটেছে। সায়েন্স ল্যাবরেটরি এলাকার ভবনটির ক্ষেত্রে গ্যাস জমে ছিল তৃতীয় তলার আবদ্ধ কোনো কুঠুরিতে আর সিদ্দিকবাজারের ভবনটির ক্ষেত্রে গ্যাস জমে ছিল বেজমেন্টের শীততাপনিয়ন্ত্রিত কোনো একটি কক্ষের বদ্ধ কুঠুরিতে। (তিতাসের ‘গ্যাস থেকে’ বিস্ফোরণ, প্রথম আলো, ১০ মার্চ ২০২৩)
সিটিটিসির বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের অনুসন্ধান অনুসারে, সিদ্দিকবাজারের কুইন স্যানিটারি মার্কেট হিসেবে পরিচিত সাততলা ভবনটির বেজমেন্টে তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের একটি পরিত্যক্ত লাইন ছিল। এ পরিত্যক্ত গ্যাসের লাইনটি একসময় নিচতলার হোটেলের জন্য রান্নার কাজে ব্যবহৃত হতো। একপর্যায়ে গ্যাস-সংযোগের লাইনটি রাইজার (গ্যাস সরবরাহের সংযোগস্থল) থেকে বিচ্ছিন্ন করা হলেও সংযোগ লাইন অপসারণ করা হয়নি, ফলে সেটিতে গ্যাসের সরবরাহ ছিল। ধারণা করা হচ্ছে, ওই লাইনের ছিদ্র থেকে বেজমেন্টের শীততাপনিয়ন্ত্রিত কোনো একটি কক্ষের বদ্ধ কুঠুরিতে গ্যাস জমে এ ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে।
শুধু গ্যাস বিস্ফোরণের ক্ষেত্রেই নয়, এ দেশে যেকোনো দুর্ঘটনার পর আরেকটি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে দুর্ঘটনার পূর্বশর্ত ও অন্তর্নিহিত কার্যকারণ শনাক্ত করে তা দূর করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয় না। দুর্ঘটনার পর রুটিন অনুসারে এক বা একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেসব তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় না। প্রকাশিত হলেও কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না। তদন্তেও অনেক সময় বিভিন্ন ব্যক্তি-গোষ্ঠীগত স্বার্থে প্রকৃত ঘটনা উঠে আসে না। তাতে সমস্যার প্রকৃত সমাধান পাওয়া যায় না।
তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ বিষয়টি অস্বীকার করলেও স্থানীয় এলাকাবাসীর বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে দেখা যায়, এ ঘটনার কিছুদিন আগেই বিধ্বস্ত ক্যাফে কুইন ভবনে গ্যাসের লাইন মেরামত করতে গিয়েছিল তিতাস। দুর্ঘটনার পর ওই এলাকার বেশ কয়েকটি বাড়ির গ্যাসের লাইনের রাইজারের আশপাশে গ্যাসের গন্ধও পাওয়া যায়। (জমজমাট সিদ্দিকবাজার মুহূর্তে মৃত্যুপুরী, সমকাল, ৯ মার্চ ২০২৩)
সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণের ঘটনায় ভবনমালিক, রাজউক ও তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ—সবারই দায় রয়েছে। ভবনমালিকের দায় হলো, নকশা অনুযায়ী ভবনের নিচতলায় গ্যারেজ না করে স্যানিটারির দোকান ভাড়া দেওয়া এবং কোনো ভেন্টিলেশন বা বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা না রাখা। নকশা অনুযায়ী গ্যারেজ নির্মাণ করা হলে পুরো বেজমেন্ট শীতাতপনিয়ন্ত্রিত করে বাতাস চলাচল বন্ধ করতে হতো না, আর গ্যাস জমে এ ধরনের বিস্ফোরণও ঘটত না। রাজউকের দায়িত্ব ছিল, ভবনগুলো অনুমোদিত নকশা অনুযায়ী নির্মিত কি না তার তদারকি করা এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা। দুর্ঘটনার পর রাজউকের আওতাধীন এলাকার ভবনগুলোর বেজমেন্টের ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করে প্রতিবেদন দিতে আটটি আঞ্চলিক কমিটি গঠনের কথা জানিয়েছে রাজউক, কিন্তু কাজটি রাজউকের নিয়মিত করার কথা ছিল, যা পালন করা হলে হয়তো এ দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো। (‘ক্যাফে কুইন’ ভবনজুড়েই নানা অনিয়ম, সমকাল, ১০ মার্চ ২০২৩)
আর তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের দায় হলো, গ্যাস-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার সময় গ্যাস সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ না করা, গ্যাস-সংযোগগুলো একবার দেওয়ার পর আর কোনো তদারকি না করা, গ্যাসলাইনে কোনো ছিদ্র হলো কি না, তা খতিয়ে না দেখা।
আফসোসের ব্যাপার হলো, তিতাসের গাফিলতির কারণে এর আগে ২০২০ সালে নারায়ণগঞ্জের একটি মসজিদে এবং ২০২১ সালে ঢাকার মগবাজারে একটি ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ব্যাপক প্রাণহানির পরও যথাযথ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে তল্লা এলাকায় বায়তুস সালাত নামের শীতাতপনিয়ন্ত্রিত একটি মসজিদের ভেতরে গ্যাস জমে বিস্ফোরণ থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় ৩৪ জন পুড়ে মারা যান। এ মসজিদের আশপাশে গ্যাসের গন্ধ পাওয়ার কথা স্থানীয় লোকজন দুর্ঘটনার আগে জানালেও তা আমলে নেয়নি তিতাস।
শুধু তা-ই নয়, মসজিদে বিস্ফোরণে প্রাণহানির পর পাশের মাটি খুঁড়ে দেখা যায়, গ্যাসের একটি পরিত্যক্ত পাইপলাইনে ছয়টি ছিদ্র রয়েছে, সেসব ছিদ্র থেকে গ্যাস নির্গত হয়ে মসজিদে জমে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। মূল সরবরাহ লাইন থেকে নতুন সংযোগ লাইন নেওয়ার পর পুরোনো পরিত্যক্ত লাইনে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ না করার কারণেই এ ঘটনা ঘটেছিল। (মসজিদে বিস্ফোরণ: পাইপ পরিত্যক্ত ২২ বছর, গ্যাস বন্ধ করেনি তিতাস, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২২)
এ ঘটনার পর তিতাসের আট কর্মকর্তা-কর্মচারীকে সাময়িক বরখাস্ত করে দায় সারা হয়। কিন্তু গ্যাস বিতরণ লাইনে ছিদ্র বা ত্রুটি শনাক্ত করার আধুনিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় গ্যাস লিক হয়ে বিস্ফোরণের ঝুঁকি রয়েই যায়। পাইপলাইনের ছিদ্র শনাক্ত করার আধুনিক ব্যবস্থা না থাকায়, কোথাও সমস্যা হলে গ্রাহক ফোন করে তিতাসকে জানালে তখন তিতাস ব্যবস্থা নেয়। অনেক সময় গ্যাসের ছিদ্র যথাযথভাবে শনাক্ত না করতে পারার কারণে সমস্যার যথাযথ সমাধান হয় না, ঝুঁকি রয়েই যায়। (আধুনিক হতে পারেনি তিতাস, এখনও লিকেজ রয়েছে ৮১৪টি, বাংলা ট্রিবিউন, ১০ ডিসেম্বর ২০২০) অথচ গ্যাস সরবরাহের লাইনের ত্রুটি বা ছিদ্র শনাক্ত করার জন্য নানা ধরনের প্রযুক্তি রয়েছে, যা ব্যবহার করা হলে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়ানো সম্ভব হতো।
যুক্তরাষ্ট্রের ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জির দেওয়া তথ্য অনুসারে, এসব প্রযুক্তির মধ্যে রয়েছে—অ্যাকুস্টিক সেন্সরস, গ্যাস স্যাম্পলিং, সয়েল মনিটরিং, ফ্লো মনিটরিং, ডায়নামিক মডেলিং, লিডার অ্যাবসরপশন, ডায়োড লেসার অ্যাবসরপশন, ব্রডব্যান্ড অ্যাবসরপশন, মিলিমিটার ওয়েভ রাডার সিস্টেম, থার্মাল ইমেজিং ইত্যাদি। (টেকনিক্যাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট অন ন্যাচারাল গ্যাস লিক ডিটেকশান ইন পাইপ লাইনস, ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব এনার্জি)
নারায়ণগঞ্জের মসজিদে বিস্ফোরণে ৩৪ জনের মৃত্যুর পরও তিতাসের গ্যাস পাইপলাইনগুলো নিরাপদ করার যথাযথ উদ্যোগ না নেওয়ার কারণে ৯ মাসের মাথায় একই রকমভাবে পরিত্যক্ত গ্যাস পাইপলাইনের ছিদ্র থেকে নির্গত গ্যাস জমে ২০২১ সালের ২৭ জুন ঢাকার মগবাজারে ‘রাখি নীড়’ নামের একটি ভবনের নিচতলায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে ১২ জনের মৃত্যু হয়। তদন্তে দেখা যায়, ভবনের সামনের রাস্তার পাশে তিতাস গ্যাসের একটি রাইজার ছিল। ২০১৪ সালে ওই ভবনের সংযোগটি বিচ্ছিন্ন করা হলেও ওই পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ স্থায়ীভাবে বন্ধ করা হয়নি। ফলে সিটি করপোরেশনের পয়োনিষ্কাশন লাইনের কাজ করার সময় গ্যাসের সংযোগের পাইপলাইনের ছিদ্র থেকে গ্যাস বের হয়ে ভবনের নিচতলার শরমা হাউসের ভেতরে জমা হয় এবং বিস্ফোরণ ঘটে। (তিতাসের গ্যাস থেকেই মগবাজারে বিস্ফোরণ, প্রথম আলো, ১৬ জুলাই ২০২১)
নারায়ণগঞ্জের পর অন্তত মগবাজার বিস্ফোরণ থেকেও শিক্ষা নিয়ে যদি যথাযথ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হতো এবং দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দেওয়া হতো, তাহলে সিদ্দিকবাজারের সাম্প্রতিক বিস্ফোরণ এড়ানো যেত। কিন্তু মগবাজার বিস্ফোরণের মামলার তদন্ত এক বছর আট মাসেও শেষ হয়নি, মামলায় কেউ গ্রেপ্তারও হননি। (মগবাজারে ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণের তদন্ত কবে শেষ হবে, প্রথম আলো, ৯ মার্চ ২০২৩) মগবাজারের বিস্ফোরণের মতো ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ করতে পুলিশ সদর দপ্তরের গঠিত অনুসন্ধান কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে ২৮ দফা সুপারিশ করা হয়েছিল, যেসব সুপারিশও ফাইলবন্দী রয়ে গেছে।
এসব সুপারিশের মধ্যে উল্ল্যেখযোগ্য: এলপিজি বা প্রাকৃতিক গ্যাস ব্যবহারের ক্ষেত্রে লিকেজ (ছিদ্র) শনাক্ত করার জন্য কটু গন্ধ ব্যবহার বাধ্যতামূলক। যেন গ্যাস নির্গত হলে সহজেই বোঝা যায় এবং দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া যায়; প্রাকৃতিক গ্যাস-সংযোগ বা এলপিজি মজুতস্থলে হাইড্রোকার্বন গ্যাস ডিটেক্টিং সেন্সর বা অ্যালার্ম ব্যবহার করা; ক্ষয়ে যাওয়া বা নষ্ট হওয়া প্রাকৃতিক গ্যাসের পাইপলাইন পরিবর্তন বা নিয়মিত মেরামত করা; অবিলম্বে সব ধরনের হাইড্রোকার্বন গ্যাস নেটওয়ার্ক পরিদর্শন করে লিকেজ শনাক্ত করে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ; গ্যাস-সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর সেই পাইপলাইন পুরোপুরি অপসারণ করা; ডিজিটাল পদ্ধতিতে গ্যাসের প্রবাহ নজরদারির ব্যবস্থা চালু করা; গ্যাস-সংযোগ রয়েছে—এমন আবদ্ধ ঘরে পর্যাপ্ত বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা করা; ভবনের বিদ্যুৎ ও হাইড্রোকার্বন গ্যাস সংযোগদাতা কর্তৃপক্ষ এবং অগ্নিনির্বাপণকারী কর্তৃপক্ষকে প্রতিবছর নিয়মিত পরিদর্শন করে প্রতিবেদন দাখিল বাধ্যতামূলক করা; রাজউকের পক্ষ থেকে প্রতিটি ভবন নিয়মিত পরিদর্শন বাধ্যতামূলক করা ইত্যাদি। (সব সুপারিশ ফাইলবন্দী, সমকাল, ১০ মার্চ ২০২৩)
এসব সুপারিশ পর্যালোচনা করলে স্পষ্ট বোঝা যায়, সুপারিশগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা হলে সিদ্দিকবাজারের ওই ভবনে পরিত্যক্ত গ্যাসলাইন থেকে গ্যাস লিকেজ হতো না এবং বিস্ফোরণের ঘটনাও ঘটত না। আভিধানিক সংজ্ঞা অনুসারে, দুর্ঘটনা হলো একটি অদৃষ্টপূর্ব, আকস্মিক ঘটনা। কিন্তু নির্দিষ্ট কিছু ঘটনা যখন একই রকম কারণে বারবার ঘটতে থাকে, যেসব কারণ ব্যবস্থা বা কাঠামোর সঙ্গে সংযুক্ত, তখন সেগুলো আর আকস্মিক বা অদৃষ্টপূর্ব থাকে না। সেগুলো আর সাধারণ দুর্ঘটনা থাকে না। হয়ে ওঠে ব্যবস্থাপনা বা কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড। নারায়ণগঞ্জের বিস্ফোরণটিকে যদি আকস্মিক বা অভূতপূর্ব ঘটনা হিসেবে ধরেও নেওয়া হয়, ৯ মাস পর একই কারণে মগবাজারে ঘটনা বিস্ফোরণটিকে মোটেই আকস্মিক দুর্ঘটনা বলা যাবে না। একইভাবে দুর্ঘটনা বলা যাবে না সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণটিকে। এগুলো পরিষ্কার কাঠামোগত হত্যাকাণ্ড, যার জন্য তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ ও ভবনমালিক থেকে শুরু করে তদারকি সংস্থাগুলো দায়ী।
শুধু গ্যাস বিস্ফোরণের ক্ষেত্রেই নয়, এ দেশে যেকোনো দুর্ঘটনার পর আরেকটি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে দুর্ঘটনার পূর্বশর্ত ও অন্তর্নিহিত কার্যকারণ শনাক্ত করে তা দূর করার কোনো কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয় না। দুর্ঘটনার পর রুটিন অনুসারে এক বা একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সেসব তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় না। প্রকাশিত হলেও কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হয় না। তদন্তেও অনেক সময় বিভিন্ন ব্যক্তি-গোষ্ঠীগত স্বার্থে প্রকৃত ঘটনা উঠে আসে না। তাতে সমস্যার প্রকৃত সমাধান পাওয়া যায় না। আবার তদন্তে দোষী সাব্যস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অনেক ক্ষেত্রেই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। এসব কারণে একই ধরনের দুর্ঘটনা বারবার ঘটতে থাকে, যা বেশির ভাগ দুর্ঘটনার পেছনের কাঠামোগত পূর্বশর্তের প্রাধান্যের দিকটাই নির্দেশ করে।
এ দেশে দুর্ঘটনার জন্য কোনো ভবন, কারখানা বা কোনো প্রতিষ্ঠানের মালিক ও ব্যবস্থাপক থেকে শুরু করে তিতাসের মতো কোনো সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান কিংবা অনুমোদন ও তদারককারী বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের জবাবদিহি ও শাস্তির মুখোমুখি হতে হয় না। বিশ্বের যেসব দেশে তদারককারী কর্তৃপক্ষকে রাজনৈতিক নেতৃত্বের কাছে এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বকে প্রতিটি দুর্ঘটনার জন্য জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হয়, সেসব দেশে দুর্ঘটনার হার অনেক কম। বাংলাদেশে এমন কোনো জবাবদিহিমূলক প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে ওঠেনি বলেই দুর্ঘটনার কাঠামোগত ভিত্তিগুলো দিনের পর দিন অক্ষুণ্ণই থেকে যায়।
কল্লোল মোস্তফা বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবেশ ও উন্নয়ন অর্থনীতিবিষয়ক লেখক, প্রকাশিত গ্রন্থ: ‘বাংলাদেশে উন্নয়নের রাজনৈতিক অর্থনীতি’, ‘ডিজিটাল কর্তৃত্ববাদ, নজরদারি পুঁজিবাদ ও মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার ভবিষ্যৎ’। ই-মেইল: [email protected]