জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর) বাংলাদেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে সরকারের কাছে পাঠানো সুপারিশে আইনের যে দুটি ধারা বাতিল এবং আটটি ধারা সংশোধনের কথা বলেছে, সেগুলো বিষয়ে দেশের নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকারকর্মীরা আগেই আপত্তি জানিয়েছিলেন। জাতিসংঘের পক্ষ থেকে বাতিলের জন্য বলা ধারা হচ্ছে ২১ ও ২৮। যেগুলো সংশোধনের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো হচ্ছে ৮, ২৫, ২৭, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩ ধারা (প্রথম আলো ৬ এপ্রিল ২০২৩)।
স্মরণ করা যেতে পারে, ২০১৮ সালে নির্বাচনের মুখে সরকার যখন এ আইনে পাসের উদ্যোগ নেয়, তখন এসব ধারা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা ও প্রতিবাদ হয়েছিল। সম্পাদক পরিষদ ২০১৮ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে তাদের উদ্বেগের বিশদভাবে ব্যাখ্যা করে বিবৃতিও দিয়েছিল, তাতে আইনটির ৯টি ধারার (৮, ২১, ২৫, ২৮, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩) মৌলিক কিছু ত্রুটি চিহ্নিত করেছিল। এরপর গত সাড়ে চার বছরে বাংলাদেশের মানবাধিকার, নাগরিকের মতপ্রকাশের অধিকার এবং সংবাদক্ষেত্রের স্বাধীনতা যাঁরাই পর্যবেক্ষণ করেছেন, তাঁরাই এ নিয়ে বারবার বলেছেন যে সামগ্রিকভাবে এ আইন ও বিশেষভাবে কতিপয় ধারা অগ্রহণযোগ্য এবং তা আন্তর্জাতিক যেসব সনদে বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে, তার সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ।
এসব আইনের মধ্যে যে দুটি বাতিলের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো নিয়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে এ কারণে যে এগুলো অস্বচ্ছ এবং এগুলোর রাজনৈতিক ব্যবহারের সুযোগ সবচেয়ে বেশি। আইনের ২১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা ও প্রচারণা চালান বা উহাতে মদদ প্রদান করেন’, তাহলে তিনি অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে সাজা হবে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা ৩ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করার বা উসকানি প্রদানের অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অনধিক ৫ বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে সাজা হবে অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ড বা ২০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড।
এ ধরনের আইনের পরিধি এতটাই ব্যাপক যে যেকোনো ব্যক্তি যে কারও বিরুদ্ধে এ আইন বরখেলাপের অভিযোগ করতে পারেন এবং সে কারণে কারাভোগ, এমনকি দোষী বলে সাব্যস্ত হতে পারেন। আইনের এ ধারাগুলো কীভাবে ব্যবহৃত হয়েছে, সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের (সিজিএস) পক্ষ থেকে করা গবেষণায় আমরা সেটা দেখতে পেয়েছি। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাস থেকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ব্যবহার বিষয়ে আমি যে গবেষণাকাজ করছি, তাতে যে চার আইনের সর্বাধিক ব্যবহার দেখতে পেয়েছি, সেগুলো হচ্ছে ২৫, ২৯, ৩১ ও ৩৫। আমাদের প্রকাশিত তিনটি প্রতিবেদনে (এপ্রিল ২০২১, এপ্রিল ২০২২ ও জানুয়ারি ২০২৩) আমরা তার বিভিন্ন দিকে তুলে ধরেছি।
২০১৮ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত আমরা ১ হাজার ২৯৫টি মামলার সম্পূর্ণ তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি। এসব মামলায় অভিযুক্ত হয়েছেন ৩ হাজার ৬৪৪ জন এবং তাঁর মধ্যে ১ হাজার ৩৭৮ জন আটক হয়েছিলেন। আটক ব্যক্তিদের অনেকে জামিনে মুক্ত হলেও অনেকেই বিচারাধীন অবস্থায় আটক আছেন। আটক অবস্থায় লেখক মুশতাক আহমদ কারাগারে মৃত্যুবরণ করেন।
সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মীরা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও মামলা করছেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আটক করা হচ্ছে। নির্বাচনের আগে এই প্রবণতা যে আরও বৃদ্ধি পাবে, এগুলো তারই লক্ষণ।
আমাদের কাছে যেসব তথ্য আছে, তাতে দেখা যাচ্ছে যে ২১ ধারায় মামলা হয়েছে ১৮টি, অভিযুক্ত হয়েছেন ২৪২ জন এবং আটক হয়েছেন ১৯ জন। তাঁদের পেশাগত বিভাজন করলে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত হয়েছেন রাজনীতিবিদেরা। এরপর যেসব পেশার লোক এতে অভিযুক্ত হচ্ছেন, তার মধ্যে আছেন আইনজীবীরা (১১ জন)।
২৮ ধারায় মামলা হয়েছে ৪৪টি, অভিযুক্ত হয়েছেন ১১৮ জন এবং আটক হয়েছেন ২৫ জন। তাঁদের পেশাগত বিভাজন করলে দেখা যায়, যে ৩৪ জনের পেশাগত পরিচয় পাওয়া গেছে, তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি অভিযুক্ত হয়েছেন সাংবাদিক ও শিক্ষক, ৬টি করে মামলা হয়েছে; আটক হয়েছেন যথাক্রমে ২ ও ৩ জন। এরপর যেসব পেশার লোক এতে অভিযুক্ত এবং আটক হয়েছেন, তার মধ্যে রাজনীতিবিদ বেশি। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের ২১ দশমিক ১৯ শতাংশ আটক হন।
ওএইচসিএইচআর সে সব ধারা সংশোধনের কথা বলেছে (৮, ২৫, ২৭, ২৯,৩১, ৩২), সেগুলোর ব্যবহারের মাত্রাও আশঙ্কাজনক। যেমন ২৫ ধারা। আমাদের গবেষণায় সংগৃহীত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, এতে মামলা হয়েছে ২১২টি, অভিযুক্ত হয়েছেন ৬৮৮ জন এবং আটক হয়েছেন ১৪১ জন।
একই ধরনের প্রবণতা আছে ২৯ ধারা প্রয়োগের ক্ষেত্রেও। ২৯ ধারায় মামলা হয়েছে ২১১টি এবং তাতে অভিযুক্ত হয়েছেন ৬৭৭ জন। এই ধারায় বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে দণ্ডবিধির ৪৯৯ ধারায় বর্ণিত মানহানিকর তথ্য প্রকাশ ও প্রচার করেন, তজ্জন্য তিনি অনধিক ৩ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড বা অনধিক ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত কারাদণ্ডে বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।’ যদিও মানহানির জন্য দণ্ডবিধির ৫০০ থেকে ৫০১ ধারায় বিচারের ব্যবস্থা আছে। প্রত্যেক ধারায় সর্বোচ্চ শাস্তি দুই বছরের কারাদণ্ড এবং সঙ্গে অর্থদণ্ডের বিধানও রয়েছে।
কিন্তু দেখা গেছে, ২০১৮ সালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন চালু হওয়ার পর এ আইনেই মামলা করা হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলার ক্ষেত্রে পুলিশের পক্ষ থেকে যে ধরনের তৎপরতা লক্ষ করা যায়, তা–ই এ ধারায় মামলা করায় উৎসাহী করে। তারপরও এটাও স্মরণ করা দরকার, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অধিকাংশ ধারা জামিন-অযোগ্য বলে এ আইনের মামলায় আটক ব্যক্তিরা বিচারের আগেই দীর্ঘদিন কারাগারে থাকতে বাধ্য হন।
আমাদের গবেষণায় আমরা এটাও দেখেছি, আইনের যে সময়ের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়ার কথা, সেই সময়ে প্রতিবেদন না দেওয়ার কারণে এ কারাভোগের সময় হয়ে ওঠে দীর্ঘ ও অনিশ্চিত। এগুলো প্রতিপক্ষকে, বিশেষত রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে, হেনস্তা করার এক বড় হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।
জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এই সুপারিশমালা পাঠানো হয়েছে গত বছরের জুন মাসে, কিন্তু সরকার সেগুলো ধর্তব্যে নিচ্ছে—এমন কোনো লক্ষণ নেই। উপরন্তু ইদানীং এ আইনে মামলার সংখ্যা বাড়ছেই। সাম্প্রতিক কালে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান এবং সাংবাদিক শামসুজ্জামান সামসের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলার পর এ নিয়ে দেশে-বিদেশে নিন্দার ঝড় ওঠে। এ দুই মামলার তাৎপর্য ও গুরুত্ব বিশাল হলেও একার্থে এগুলো ব্যতিক্রম নয়।
সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের নেতা–কর্মীরা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোথাও না কোথাও মামলা করছেন, অভিযুক্ত ব্যক্তিদের আটক করা হচ্ছে। নির্বাচনের আগে এই প্রবণতা যে আরও বৃদ্ধি পাবে, এগুলো তারই লক্ষণ। জাতিসংঘের এই সুপারিশ এবং গত ৩১ মার্চ জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার ফলকার টুর্ক আইনটি অবিলম্বে স্থগিত করার আহ্বান জানালেও গত রোববার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, আইনটি কোনোমতেই বাতিল করা যায় না।
গবেষণায় পাওয়া তথ্য, নাগরিক সমাজের প্রতিবাদ এবং জাতিসংঘের সুপারিশের পরও এ আইন বহাল রাখার ব্যাপারে সরকারের অনমনীয় অবস্থান আগামী দিনগুলোয় এ আইনের আরও ব্যাপক ব্যবহারেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে।
আলী রীয়াজ যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি ও সরকার বিভাগের ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর, আটলান্টিক কাউন্সিলের অনাবাসিক সিনিয়র ফেলো এবং সুইডেনের গথেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভ্যারাইটিজ অব ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউটের ভিজিটিং রিসার্চার