গত জানুয়ারি মাসে গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচন বৈদ্যুতিক ভোটযন্ত্রে (ইভিএম) হয়েছিল। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে ছিল সিসিটিভি ক্যামেরা। ভোট গ্রহণের দিন নির্বাচন কমিশনের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ থেকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ও নির্বাচন কমিশনাররা (ইসি) এ কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেন।
বেশ কিছু কেন্দ্রে কমিশনের আওতাবহির্ভূত অনিয়ম পরিলক্ষিত হয়। বাতিল করা হয় সে ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়া। দায়দায়িত্ব নির্ধারণের জন্য তদন্ত হয় উচ্চতর পর্যায় থেকে। প্রতিবেদনও আসে।
এ অনিয়মের জন্য দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সে সম্পর্কে আমরা অবগত নই। তবে প্রশংসিত হয়েছে কমিশনের এ ধরনের তৎপরতা। সে উপনির্বাচনে সুষ্ঠু ভোট গ্রহণের জন্য তাদের নেওয়া ব্যবস্থা সময়ের উপযোগী ও যথোচিত ছিল বলে অনেকে মনে করেন। পাশাপাশি ভোট গ্রহণে ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দলের প্রার্থীর অন্যায্য প্রভাবও নজরে আসে।
শুধু একটি নির্বাচনী এলাকার উপনির্বাচনেও সরকারি দলের সমর্থিত প্রার্থী অবৈধ প্রভাব বিস্তার করেছেন। স্থানীয় প্রশাসন, সংশ্লিষ্ট ভোটকর্মী ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখানে থেকে যায় অনেকটাই নিষ্ক্রিয় কিংবা পক্ষপাতদুষ্ট। অথচ এ নির্বাচনের ফলাফল কোনো দলের সরকার গঠন বা পতনের নিয়ামক ছিল না। কিন্তু জাতীয় নির্বাচনে অবস্থাটা ভিন্নতর হবে।
তদুপরি সে নির্বাচনের আকৃতিও হবে মোটাদাগে এর ৩০০ গুণ। তাই এখানে প্রাপ্ত শিক্ষা জাতীয় নির্বাচনে ভোট গ্রহণের অনিয়ম বন্ধের জন্য একইভাবে প্রয়োগ করা যাবে না। কিন্তু একটি বাংলা পত্রিকার খবরে জানা যাচ্ছে, কমিশন দেশব্যাপী সর্বত্র সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপনের জন্য জোরালো উদ্যোগ নিয়েছে। এর জন্য তারা টাকা চাইছে সরকারের কাছে।
গাইবান্ধা-৫ নির্বাচনী এলাকায় ভোটকেন্দ্র ও ভোটকক্ষ ছিল যথাক্রমে ১৪৫ ও ৯৫২টি। একটি নির্বাচনী এলাকায় ১৫০ থেকে ২০০টি ভোটকেন্দ্র থাকে। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে থাকে পাঁচ থেকে ছয়টি ভোটকক্ষ। এ বিবেচনায় মনে হচ্ছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে কমবেশি ৫০ হাজার ভোটকেন্দ্র ও ২ লাখ ৫০ হাজার ভোটকক্ষ হবে। সিসি ক্যামেরার পুরো নজরদারিতে রাখতে হলে ভোটকক্ষের বাইরেও প্রতি কেন্দ্রে কয়েকটি ক্যামেরা রাখতে হবে। এতে সংখ্যা দাঁড়াবে ৩ লাখের মতো। অর্থাৎ প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় কমবেশি ১ হাজার। কমিশন বিবেচনায় নিয়েছে, এ বিশাল কার্যক্রম কেন্দ্রীয়ভাবে মনিটর করা যাবে না।
আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র গণতন্ত্র। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এ দেশবাসীর ওপর হামলা চালায় বলেই আসে স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধ। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখেই সংবিধানের প্রণেতারা নির্বাচন কমিশনকে অনেক ক্ষমতা ও দায়িত্ব দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন। জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা তঁাদের প্রধান দায়িত্ব। পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারলেই ভোটকেন্দ্র জনাকীর্ণ হয়ে যাবে। তাঁরা এ উদ্দেশ্যে গাইবান্ধা নির্বাচনকে মডেল হিসেবে নিতে পারেন না। তবে বিবেচনায় রাখতে পারেন সেখানকার নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পক্ষপাতদুষ্ট ও নিষ্ক্রিয়তাকে।
রিটার্নিং কর্মকর্তাদের দেওয়া হবে তাঁর এলাকায় নির্বাচন ব্যবস্থাদি তদারকির দায়িত্ব। এতেও তাঁদের আওতায় অনেক নির্বাচনী কেন্দ্র থাকবে। যেহেতু এ তদারকির মাধ্যমে অনিয়ম হলে নির্বাচন বাতিল করার মতো চরম ব্যবস্থা নেওয়া হয়, তাই নজরদারি হতে হবে যতটা সম্ভব নিবিড়। রিটার্নিং কর্মকর্তা ভোট গ্রহণের দিন সাংগঠনিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাবিষয়ক কার্যক্রম নিয়ে অতি ব্যস্ত থাকবেন। তাঁকে ছাড়া অন্য কাউকে এ কর্তৃত্ব দিতে হলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ নিয়ে জটিলতায় পড়তে হবে। তারপরও এগুলো তখনকার মতো রেখে পরে পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে ফলাফল ঘোষণাও বড় ধরনের বিতর্ক ডেকে আনবে।
এ ধারণা বাস্তবায়ন করতে হলে নির্বাচনী আইনে বড় ধরনের সংশোধনী দরকার। এর কোনো উদ্যোগ আমাদের নজরে আসছে না। আর কার্যত এ ধারণা নিয়ে খোলামেলা কোনো আলোচনাও হচ্ছে না। তাই এ ধরনের ক্যামেরা স্থাপন কতটা কাজে আসবে, তা নিয়ে সংশয়বাদী হতে হয়। এটা ক্রয় ও যথাসময়ে স্থাপনে যথেষ্ট টাকা খরচ হবে। কাজে লাগলে তা নিয়ে তেমন আপত্তি থাকত না। তবে মাঠের বাস্তবতা এমনটা সমর্থন করছে বলে মনে হয় না।
এরপর একটি মৌলিক বিষয়ে আলোচনার প্রয়োজন। গাইবান্ধায় কমিশন দেখেছে ওপর থেকে নিচ ভোটকর্মীরা পক্ষপাতদুষ্ট বা নির্বিকার ছিলেন। একই অবস্থায় ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। অবস্থার মোড় ঘোরাতে কমিশন কোনো কার্যক্রমের কথা ভাবছে কি না, আমাদের জানা নেই। জাতীয় নির্বাচন খুব দূরে নয়। আমাদের নির্বাচন বিদ্যমান প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমেই এযাবৎ হয়ে আসছে। নির্বাচন হিসেবে দেশ ও বিদেশে স্বীকৃত চারটি পর্ব গত তিন যুগে তারাই করেছে। নিরাপত্তাবিধানের দায়িত্ব ছিল এই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোরই। অবশ্য অত্যন্ত প্রয়োজনীয় সহযোগিতা ছিল সামরিক বাহিনীর।
তবে সেসব নির্বাচনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনিক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা ও সদস্যদের ওপর কমিশনের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতো নিরঙ্কুশভাবে। আগে থেকে কমিশন সে বিষয়ে মনোযোগী হতো। তাদের সহায়তায় থাকত সরকার। সংবিধানেও সে ব্যবস্থা রয়েছে। বিষয়টা নিশ্চিত করতে মাঠপর্যায়ে একটি বড় ধরনের রদবদলের রেওয়াজ রয়েছে। তেমনটা করা না হলে গাইবান্ধার চিত্রই বিরাজ করবে ব্যাপকভাবে।
যে নির্বাচনগুলোর কথা হলো, সেগুলো হয়েছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতায়। এখন সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, এর কোনো সুযোগ সংবিধানে নেই। জনগণের চাহিদায় সংশোধনী আসে। ২০০৭ সালের জানুয়ারিতেও একটি নির্বাচন হতে যাচ্ছিল। এর বিরুদ্ধেও অবস্থান নেয় আজকের সরকারি দল। দেশে একটি অরাজক পরিস্থিতিতে আসে এক–এগারোর নামে পরিচিত একটি ব্যবস্থা। তারাও আয়োজন করে একটি নির্বাচন। এর আগে সম্পন্ন করে দেশব্যাপী সব ভোটারের ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা ও পরিচয়পত্র দেওয়ার কাজ। সময় নেয় দুই বছর। এমনটাও সংবিধানে ছিল না। তা–ও বাস্তবতা মেনে নিতে হয় সবাইকে।
এখন নির্বাচন কমিশন বলছে, নির্বাচনকালীন সরকারকাঠামো কিংবা দলগুলোর মধ্যে সমঝোতার কাজ রাজনৈতিক এবং তা তাদের আওতায় নেই। প্রকৃতপক্ষে কমিশনের বিবেচনায় রাখা প্রয়োজন নির্বাচনী ব্যবস্থাপনাবিষয়ক সব কার্যক্রমই রাজনৈতিক। আর প্রজাতন্ত্রের যে কর্মচারীদের নিয়ে জাতীয় নির্বাচন করা হবে, তাঁদের চাকরি কমিশনের আওতায় ন্যস্ত করারও কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে বলে আমাদের জানা নেই। নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হয়ে গেছে। বিশাল বিশাল জনসভা করে ভোট চাওয়া হচ্ছে। তবে সেটা পরিচালনার জন্য কমিশনের যে হাতিয়ার প্রয়োজন, তা তৈরি হয়েছে বলে আপাতদৃষ্টে মনে হয় না।
তাহলে এ সিসিটিভি দিয়ে কী হবে? মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য যে প্রক্রিয়া, তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব কমিশনের। সেখানে কমিশনের কাজ শুধু সাংগঠনিক নয়। নির্বাচনী ব্যবস্থায় সংশ্লিষ্ট হতে বিভিন্ন দলকে উদ্বুদ্ধ করারও তাদের একটি দায়িত্ব আছে। ভোটের আগে সব দলমতের প্রার্থীরা যেন জনগণের কাছে যেতে পারেন, এমন ব্যবস্থাও নিশ্চিত করতে হবে অতীতের ব্যর্থতার আলোকে। হতে পারে আগের কমিশন বিদায় নিয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠান হিসেবে রয়েছে এর ধারাবাহিকতা। এমনটাই হতে থাকলে বর্তমান কমিশনের বিষয়েও আমাদের হতাশা ব্যক্ত করা ছাড়া আর কিছু বলার থাকে না।
আমাদের স্বাধীনতার মূলমন্ত্র গণতন্ত্র। একটি সুষ্ঠু নির্বাচনের ফলাফলকে অস্বীকার করে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এ দেশবাসীর ওপর হামলা চালায় বলেই আসে স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধ। এসব বিষয় বিবেচনায় রেখেই সংবিধানের প্রণেতারা নির্বাচন কমিশনকে অনেক ক্ষমতা ও দায়িত্ব দিয়ে প্রতিষ্ঠা করেছেন। জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা তঁাদের প্রধান দায়িত্ব। পরিবেশ ফিরিয়ে আনতে পারলেই ভোটকেন্দ্র জনাকীর্ণ হয়ে যাবে। তাঁরা এ উদ্দেশ্যে গাইবান্ধা নির্বাচনকে মডেল হিসেবে নিতে পারেন না। তবে বিবেচনায় রাখতে পারেন সেখানকার নির্বাচনসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের পক্ষপাতদুষ্ট ও নিষ্ক্রিয়তাকে।
আলী ইমাম মজুমদার সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব