আজারবাইজান ও আর্মেনিয়ার মধ্যকার উত্তেজনা দক্ষিণ ককেশাসে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির হুমকি সৃষ্টি করেছে। ঘটনাক্রমে ইরান এই আঞ্চলিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে কি না, সেই আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রশ্ন হলো, ইরান কি প্রকৃতপক্ষেই আর্মেনিয়াকে রক্ষা করতে গিয়ে শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশ আজারবাইজানে আগ্রাসন চালাবে? সম্প্রতি তেহরানের দিক থেকে যে সামরিক তৎপরতা, সেটা কি আরও দূর গড়াবে?
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আজারবাইজানের ভূখণ্ড নাগারনো-কারাবাখ। তা সত্ত্বেও আর্মেনিয়া সেই অঞ্চলটি তিন দশকের বেশি সময় ধরে দখল করে আছে। সম্প্রতি আজারবাইজানের সামরিক বাহিনী নাগারনো-কারাবাখের অংশবিশেষ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। আজারবাইজান অভিযোগ করেছে, ইরান তাদের উত্তর-পশ্চিমের সীমান্তের নাখচিভান ছিটমহলে সেনা সমাবেশ করেছে।
আজারবাইজানের এই অভিযোগ তেহরান অস্বীকার করেনি। ইরানের ইসলামিক রেভল্যুশনারি গার্ড করপসের (আইআরজিসি) পাঁচটি শাখার একটি আল-কুদস বাহিনী আর্মেনিয়া-আজারবাইজানের সীমান্তের কাছাকাছি ঘাঁটি স্থাপন করেছে বলে খবরে প্রকাশ হয়েছে। এ ঘটনা আজারবাইজানে সম্ভাব্য হামলার ক্ষেত্রে উচ্চমাত্রার সতর্কবার্তা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে।
এদিকে আজারবাইজানের সেনাবাহিনী যেভাবে তাদের ভারী সামরিক সরঞ্জাম মোতায়েন করছে, তাতে এই উদ্বেগ তৈরি হচ্ছে যে আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে একটি অভিযান আসন্ন। গত শুক্রবার আইআরজিসি কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ পাকপৌর অঞ্চলটি পরিদর্শনও করে এসেছেন।
এমন খবরও এসেছে যে ইরানের পূর্ব ও পশ্চিম আজারবাইজান প্রদেশের বাসিন্দাদের (নৃতাত্ত্বিকভাবে আজেরিস) উদ্দেশে আইআরজিসি লড়াইয়ের জন্য পুরোপুরি প্রস্তুত থাকতে বলেছে।
সাম্প্রতি ছড়িয়ে পড়া এই উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সত্ত্বেও দক্ষিণ ককেশাসের যুদ্ধ পরিস্থিতি প্রশমন করা সম্ভব এবং এ ক্ষেত্রে ইরানের হিসাব–নিকাশ যতটা কৌশলের, তার চেয়ে কৌশলগত।
নাগারনো-কারাবাখ সংঘাতকে ব্যবহার করে আজারবাইজান আর্মেনিয়ার ওপর চাপ তৈরি করতে চায়, যাতে নাখচিভানে তারা করিডর নির্মাণ করতে পারে। এই স্থল করিডরটি আজারবাইজানের মূলভূমিকে আর্মেনিয়ার সুনিক প্রদেশের মধ্য দিয়ে নাখচিভান ছিটমহলের সঙ্গে যুক্ত করবে।
আজারবাইজানের শর্ত অনুযায়ী যদি এই করিডর স্থলপথটি নির্মাণ করা হয়, তাহলে আর্মেনিয়ার সঙ্গে ইরানের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেবে। ইরানের তাবরিজ শহরের প্রতিনিধি আলিরেজা মোনাদি বলেছেন, এ ধরনের কোনো করিডর করতে দেবে না ইরান।
আইআরজিসি আরও সরাসরি অবস্থান নিয়েছে। রেভল্যুশনারি গার্ড তাদের দাপ্তরিক টেলিগ্রাম চ্যানেলে আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভকে ‘আর্মেনিয়ার বিরুদ্ধে পরিচালিত হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডের’ বিরুদ্ধে খোলাখুলি হুমকি দিয়েছে।
দক্ষিণ আর্মেনিয়ায় আজারবাইজান যদি বড় ধরনের হামলা চালায়, সেটা প্রতিরোধ করবে ইরান। কিন্তু এ ধরনের কোনো পরিস্থিতি এড়াতে ইরান কতটা চেষ্টা করবে, সেটা এখনো পরিষ্কার নয়।
ইরানের দিক থেকে উদ্বেগের কারণটা খুব সরল। আজারবাইজান যদি দক্ষিণ আর্মেনিয়ার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে, তাহলে দক্ষিণ ককেশাসে তেহরানের অবস্থান অনেকটাই বিপদে পড়বে এবং সেটা ইরানের ওপর অস্তিত্বগত হুমকি সৃষ্টি করবে।
ইরানের উত্তর দিক তুর্কি জাতি অধ্যুষিত দেশ দ্বারা পরিবেষ্টিত। আর ইরানের ভয় হচ্ছে, আজারবাইজান ভবিষ্যতে ইরানের ওপর আক্রমণ করার জন্য তাদের ভূমি ইসরায়েলকে ব্যবহার করতে দিতে পারে। ইরানের চিরশত্রু ইসরায়েলের সহযোগিতায় আজারবাইজান এরই মধ্যে তাদের সামরিক ও গোয়েন্দা সামর্থ্য বৃদ্ধি করেছে।
আজারবাইজান-ইসরায়েল সহযোগিতার ঘটনায় ইরান যদি চোখ বন্ধ করে রাখে, তাহলে সেটা তেহরানের জন্য দুর্বলতার লক্ষণ বলে বিবেচনা করা হতে পারে। সে কারণে ইরান যে ওই অঞ্চলে তাদের সামরিক শক্তি অব্যাহতভাবে বৃদ্ধি করবে, সেটা প্রত্যাশিতই। আর্মেনিয়ার ভূখণ্ডগত অখণ্ডতা যেকোনো মূল্যেই রক্ষা করবে ইরান।
এ ক্ষেত্রে সময় সম্ভবত ইরানের পক্ষেই। সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি কেবল নাগারনো-কারাবাখকে কেন্দ্র করে ঘটেছে। আজারবাইজানের বাহিনী আর্মেনিয়ার সঙ্গে নাগারনো-কারাবাখের সংযোগকারী করিডরে বিকল্প সড়ক নির্মাণের কাজ বন্ধ করে দিতে পেরেছে।
এখন যে পরিস্থিতি, তাতে কূটনৈতিক পদক্ষেপই প্রত্যাশিত। ১১ মার্চ আজারবাইজানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাকুতে ইরানের রাষ্ট্রদূতকে তলব করেন। বিতর্কিত এলাকায় ইরানের যুদ্ধবিমান কেন উড়েছে, তা নিয়ে প্রতিবাদ জানান তিনি।
এ বছরের শুরুর দিকে, তেহরানে আজারবাইজানের দূতাবাসে অস্ত্রধারীদের হামলায় প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিহত ও আরও দুজন আহত হওয়ার ঘটনায় ইরান থেকে দূতাবাস সরিয়ে নেয় আজারবাইজান। সেই থেকে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রেও উত্তেজনা সৃষ্টি হয় এবং দুই পক্ষই সময়ে সময়ে উত্তেজনার আগুনে ঘি ঢেলে চলেছে।
এখন প্রশ্ন হলো, সব পক্ষকে খাদের কিনারা থেকে সরিয়ে আনতে কূটনীতি কি যথেষ্ট? ইরানে বসবাসরত জাতিগত আজারবাইজানিদেরকে তেহরনের বিরুদ্ধে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে বাকু।
গত বছরের নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট আলিয়েভ বলেন, ‘ইরানসহ বিদেশে বসবাসরত আজারবাইজানিদের অধিকার, স্বাধীনতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে যা কিছু করা দরকার, তা–ই করবে আজারবাইজান।’ তাঁর এই বিবৃতি ইরানের বিরুদ্ধে সরাসরি বার্তা।
অন্যদিকে ইরান তাদের দিক থেকে শিয়াদেরকে আজারবাইজানের বিরুদ্ধে ট্রাম্প কার্ড হিসেবে ব্যবহার করেছে। কিন্তু সেটা হিতে বিপরীত হচ্ছে। কেননা আজারবাইজান মাঝেমধ্যেই শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠীর সদস্যদের অন্তর্ঘাত পরিকল্পনার অভিযোগে গ্রেপ্তার করছে।
যাহোক, এই প্রেক্ষাপটে ইরান যদি আজারবাইজানের ওপর কোনো হামলা করে বসে, তাহলে এমন একটা দেশের সঙ্গে তারা খোলাখুলি সংঘাতে জড়িয়ে পড়বে যে দেশটি শুধু ইসরায়েল নয়, ন্যাটোর সদস্য দেশ তুরস্কেরও শক্ত সমর্থন পায়।
এ কারণেই তেহরানের নীতিনির্ধারকদের দক্ষিণ ককেশাসে কোনো পদক্ষেপ নেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার ভাবতে হবে। সরাসরি সংঘাত তখনই এড়ানো সম্ভব, যদি ঠান্ডা মাথা জেতে।
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত
নিকোলা মিকোভিচ সার্বিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষক