ঢাকার একমাত্র মেট্রোরেল লাইনটি এলিভেটেড। সড়ক থেকে কমবেশি ৭০ ফুট ওপর দিয়ে চলে। যাঁরা এই গণপরিবহনে চড়েছেন, সেবা নিয়েছেন, তাঁদের কাছে মুগ্ধতা ছাড়া সমালোচনা শুনিনি।
পরিচ্ছন্ন স্টেশন, টিকিট কাটা থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে নিয়মশৃঙ্খলা, সময় ধরে ট্রেন আসা, ভিড়ের সময়ও বগির ভেতরে এসির ঠান্ডা বাতাসের ছোঁয়া—গণপরিবহনে এই অভিজ্ঞতা! ভাবা যায়!
মেট্রোরেলের সঙ্গে নিচের রাস্তার গণপরিবহন বা যান চলাচল-ব্যবস্থার তুলনা করলে পার্থক্যটি যেন আকাশ আর পাতাল! কিন্তু আকাশে (মেট্রোরেলে) তো আর সব সময় থাকা যায় না, আপনাকে মাটিতে নামতেই হবে। এরপর আপনার জন্য কী অপেক্ষা করছে?
কোনো গণপরিবহনই আপনাকে গন্তব্যের দোরগোড়ায় নামাবে না। আপনি নামবেন গন্তব্যের কাছাকাছি কোথাও। বাকি পথটুকু হয় হেঁটে যেতে হবে, অথবা বেশি দূর হলে ধরতে হবে নতুন কোনো বাহন।
একটি দৃষ্টান্ত দিই। ধরুন, কোনো একজন যাত্রী মিরপুর থেকে মেট্রোরেলে উঠেছেন। তাঁর গন্তব্য পান্থপথের বসুন্ধরা সিটি শপিং কমপ্লেক্স অথবা সেখানকার কোনো ক্লিনিক বা হাসপাতাল।
কম সময়ে এবং কোনো ধরনের ঝক্কিঝামেলা ছাড়াই তিনি কারওয়ান বাজার স্টেশনে এসে নামলেন। স্টেশনের চারপাশ ঘিরে নানা দিকে নামার বেশ কিছু পথ আছে। পান্থপথের যে পাশে বসুন্ধরা সিটি, সেখানেও একটি সিঁড়ি নেমে গেছে।
যে যাত্রীর কথা বলছিলাম, মনে করুন তিনি সেই সিঁড়ি দিয়ে নেমে ফুটপাতে এসে দাঁড়ালেন। তাঁর গন্তব্য বসুন্ধরা সিটি বা পান্থপথের কোনো ক্লিনিক বা হাসপাতাল যা-ই হোক, তিনি হেঁটে যাবেন এটাই স্বাভাবিক। তিনি যদি বসুন্ধরায় যেতে চান, কী অভিজ্ঞতা হবে তাঁর?
মেট্রো স্টেশনের সিঁড়ি যেখানে নেমেছে, তার পর থেকে বসুন্ধরা পর্যন্ত পুরো ফুটপাত হকারের দখলে। দোকানপাট এমনভাবে বসানো যে আপনি হাঁটতে পারবেন না। ফুটপাতও ভাঙাচোরা। আর দেখবেন, দোকানপাট বসানো ও দখলের সুবিধার জন্য নানা জায়গা উঁচু-নিচু করে রাখা হয়েছে। এই পথটুকু যেতে আপনাকে যেন পাহাড় ডিঙাতে হবে। মেট্রোরেল আপনাকে যে স্বস্তি দিয়েছিল, তার সবটাই উবে যাবে দুই মিনিটের হাঁটাপথে।
আগেই বলেছি, গণপরিবহন কখনোই আপনাকে গন্তব্যের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে পারবে না। আর আপনিও আপনার দোরগোড়া থেকে গণপরিবহনে উঠতে পারবেন না। বাস স্টপেজ হোক বা মেট্রোরেলের স্টেশন, সেখানে নেমে আপনাকে হাঁটতে হবে অথবা নতুন কোনো বাহন ধরতে হবে। অথবা একইভাবে এসে আপনাকে বাস বা ট্রেন ধরতে হবে।
বিশেষজ্ঞদের মুখে সেই কবে থেকেই শুনে আসছি যে মেট্রোরেলের সুফল পুরো নিশ্চিত করতে হলে এর স্টেশনগুলোকে ঘিরে কিছু পরিকল্পনা থাকতে হবে। সাধারণ মানুষ হাঁটাপথে, বাসে, ব্যক্তিগত গাড়ি বা সিএনজিচালিত অটোরিকশা অথবা রিকশায় করে কীভাবে মেট্রো স্টেশনে আসা-যাওয়া করবে, তার বিহিত করতে হবে। মেট্রোরেল চালু হওয়ার আগেই সেই পরিকল্পনা করা উচিত ছিল, সেটি হয়নি।
যা হয়নি, তা নিয়ে কথা বলে কোনো লাভ নেই। কিন্তু আপাতত কী করা যায়? কয়েক দফা মেট্রোরেলে চড়া ও স্টেশনগুলোতে আসা-যাওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে, স্টেশনকেন্দ্রিক ফুটপাতগুলো হাঁটার উপযোগী ও হকারমুক্ত করা এই সময়ের সবচেয়ে জরুরি কাজ।
আমরা জানি, শুধু ঢাকা শহর নয়, পুরো দেশেই সড়ক-মহাসড়কে যানজটের একটি বড় কারণ রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে বসানো দোকানপাট। আমরা এটাও জানি যে এই সমস্যার তাৎক্ষণিক বা সহজ কোনো সমাধান নেই। চাইলে এখনই দেশের সব ফুটপাত বা সড়ক-মহাসড়ক হকারমুক্ত করা যাবে না। এর সঙ্গে অনেক মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত। কিন্তু ফুটপাত ও সড়ক-মহাসড়ক দখলের যে নৈরাজ্য এখন চলছে, সেটাও তো চলতে পারে না। সময় নিয়ে বা পর্যায়ক্রমে হলেও এখানে শৃঙ্খলা আনতেই হবে।
আমরা জানি, শুধু ঢাকা শহর নয়, পুরো দেশেই সড়ক-মহাসড়কে যানজটের একটি বড় কারণ রাস্তা ও ফুটপাত দখল করে বসানো দোকানপাট। আমরা এটাও জানি যে এই সমস্যার তাৎক্ষণিক বা সহজ কোনো সমাধান নেই। চাইলে এখনই দেশের সব ফুটপাত বা সড়ক-মহাসড়ক হকারমুক্ত করা যাবে না। এর সঙ্গে অনেক মানুষের জীবন-জীবিকা জড়িত।
কিন্তু ফুটপাত ও সড়ক-মহাসড়ক দখলের যে নৈরাজ্য এখন চলছে, সেটাও তো চলতে পারে না। সময় নিয়ে বা পর্যায়ক্রমে হলেও এখানে শৃঙ্খলা আনতেই হবে। তা করতে হলে স্বল্প পরিসরে এবং কোথাও না কোথাও থেকে কাজটি শুরু করতে হবে। পুরো ঢাকা শহরে হাত না দিয়ে এই কাজ শুরু হতে পারে মেট্রোরেলের স্টেশনকে কেন্দ্র করে। সরকার মেট্রোরেলের স্টেশনকে ঘিরে বৃত্তাকারে এক কিলোমিটার এলাকাকে হকারমুক্ত ঘোষণা করতে পারে।
উন্নত দেশগুলোতে মেট্রো স্টেশনকে কেন্দ্র করে বিশেষ বাণিজ্যিক ভবন ও আবাসনব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। সেখানে উঁচু ভবন তৈরির অনুমতি দেওয়া হয়, যাতে মেট্রো স্টেশনের চারপাশে অনেক মানুষের বসবাস ও কর্মস্থল নিশ্চিত করা যায়।
বাংলাদেশেও মেট্রোরেল স্টেশনকে কেন্দ্র করে টিওডি বা ‘ট্রানজিট ওরিয়েন্টেড ডেভেলপমেন্ট’-এর পরিকল্পনার কথা আমরা শুনেছি। এই পরিকল্পনায় স্টেশনগুলোর চারপাশের নির্দিষ্ট এলাকায় উচ্চ ঘনত্বের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে ভবন ও অবকাঠামো নির্মাণ করার কথা বলা আছে।
এসব বড় পরিকল্পনা কবে বাস্তবায়িত হবে কে জানে! কিন্তু মেট্রোরেল থেকে নেমে হেঁটে গন্তব্যে পৌঁছানোর স্বস্তি অন্তত আপাতত নিশ্চিত করা যায়। স্টেশনগুলোকে ঘিরে এক কিলোমিটার পর্যন্ত ফুটপাত হাঁটার উপযোগী করার কাজটি হয়তো দুই সিটি করপোরেশন করতে পারে। কিন্তু এই ফুটপাতগুলো হকারমুক্ত করার দায়িত্ব কে নেবে? সাধারণভাবে বলা যায় কাজটি করা উচিত ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ বা ডিএমপির।
কিন্তু ফুটপাত দখল করে যে হকাররা বসেন, তাঁদের পেছনের খুঁটিগুলো খুবই শক্ত। বাংলাদেশ হকার্স ফেডারেশনের দাবি, ঢাকার ফুটপাতের বিক্রেতাদের কাছ থেকে দিনে প্রায় আট কোটি টাকা চাঁদা আদায় করা হয়। বছরের হিসাবে তা তিন হাজার কোটি টাকার মতো। হকারদের অনেকে বলেছেন, ফুটপাতগুলো ইজারা দেওয়ার একটি অনানুষ্ঠানিক ব্যবস্থা রয়েছে। ফুট হিসাবে চাঁদা ধরা হয়। সংগঠনটির সভাপতি আবুল কাসেম ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতারা ‘লাইনম্যানের’ মাধ্যমে ঢাকার ফুটপাত থেকে এই চাঁদাবাজি করে থাকেন (সূত্র: ঢাকা ট্রিবিউন)।
চাঁদাবাজির টাকার যে পরিমাণ এবং এর সঙ্গে পুলিশ ও স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের যুক্ততার কারণে হকারদের নিয়ে কোনো পরিকল্পনা করা বা একে শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসার কাজটি যে খুবই কঠিন, তা পরিষ্কার। কিন্তু মেট্রোরেলের সুফল নাগরিকদের পুরোপুরি দিতে হলে এই ‘কঠিন’ কাজটি করতে হবে। পুলিশ-রাজনীতিক চক্র মিলেমিশে হকারদের নিয়ে চাঁদাবাজির যে ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে, তা ভাঙতে এখন দরকার শক্ত রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। সেই সঙ্গে ডিএমপির সদিচ্ছা।
● এ কে এম জাকারিয়া প্রথম আলোর উপসম্পাদক