চার দিনের ভারত সফর শেষে ঢাকায় ফিরেছেন জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদের। তিনি দিল্লিতে থাকতে ঢাকায় তাঁর দল নিয়ে একটি অসমাপ্ত চিত্রনাট্য তৈরি হয়েছিল; যদিও শেষ পর্যন্ত সেটি রুপালি পর্দায় দেখানো যায়নি। তার আগেই জাতীয় পার্টির দুই পক্ষ স্থিতি অবস্থা রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, জি এম কাদেরের ভারত সফরটি নানা কারণে তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। তাঁর দিল্লিযাত্রার এক দিন আগে জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদে বিরোধী দলের নেতা রওশন এরশাদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠক করে বলেছেন, তাঁর দল আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে। এর আগে দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিবের বক্তৃতা-বিবৃতিতে মনে হয়েছিল, জাতীয় পার্টি তার আগের অবস্থান থেকে সরে আসতে পারে।
২০১৪ সালে একতরফা নির্বাচনে জাতীয় পার্টিই আওয়ামী লীগের ‘ত্রাতা’ হিসেবে আবির্ভূত হয়; যদিও দলের প্রতিষ্ঠাতা এরশাদ সাহেব দলীয় প্রার্থীদের প্রতি মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। ২০১৮ সালেও তাঁরা মহাজোটের সঙ্গী হিসেবে নির্বাচন করে সংসদে বিরোধী দলের আসনে বসেছেন। এই সংসদে ১৪ দলের শরিকদের অবস্থান ছিল না ঘরকা, না ঘাটকা। তারা সরকারি দলেও ছিল না, আবারও জাতীয় পার্টির নেতৃত্ব মেনে বিরোধী দলেও বসেনি। সংসদীয় রাজনীতিতে এটা নজিরবিহীন ঘটনাও বটে।
২০ আগস্ট ভারত সফরে গিয়েছিলেন জি এম কাদের। তাঁর সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী শেরিফা কাদের ও চেয়ারম্যানের আন্তর্জাতিকবিষয়ক উপদেষ্টা মশরুর মাওলা। এর আগে কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিদলও দিল্লি ঘুরে এসেছে। নির্বাচনের আগে কেবল বিদেশিরাই বাংলাদেশে আসেন না, বাংলাদেশের নেতারাও নানা বিষয়ে পরামর্শ করতে বিদেশে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের আগামী জাতীয় নির্বাচনের বিষয়ে ভারতের চাওয়া সম্পর্কে জি এম কাদের বলেন, ‘ওনারা একটা ভালো নির্বাচন দেখতে চান বাংলাদেশে এবং সময়মতো যাতে হয়। নির্বাচনের আগে ও পরে যাতে কোনো সহিংসতা বা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় অনিশ্চিত কিছু না হয়। এটা হলে ওনারা খুশি হবেন। কারণ, এখানে ওনাদের অনেক ধরনের বিনিয়োগ আছে।’
জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের কথায় মনে হয়, বাংলাদেশে ভারতের বিনিয়োগ আছে বলে তারা এখানে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা চায়। একই সঙ্গে তারা নির্বাচনের সময় ও আগে-পরে যাতে সহিংসতা না হয়, সে বিষয়েও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। এর মধ্য দিয়ে ভারত সম্ভবত ২০০১ সালের নির্বাচন-পরবর্তী সহিংসতার ইঙ্গিত দিয়েছে। ওই সময় ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা ব্যাপক সহিংসতা-নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। সে ধরনের পরিস্থিতি কোনোভাবে কাম্য নয়।
গণতান্ত্রিক সমাজে ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি। সেই সঙ্গে এই নিশ্চয়তাও থাকতে হবে যে সেই ভোটকে কেন্দ্র করে কোনো ধর্মীয় বা জাতিগত সংখ্যালঘুরা নির্যাতন-নিগ্রহের শিকার হবেন না। বিরোধী দলের নেতা–কর্মীদের দেশ ছেড়ে পালাতে হবে না।
বাংলাদেশে কেবল ভারত নয়, আরও অনেক দেশের বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্য আছে; তারাও নিশ্চয়ই এখানে স্থিতিশীলতা দেখতে চাইবে। বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, চীন, জাপানসহ আরও অনেক দেশের বিনিয়োগ আছে। সেসব দেশও নিশ্চয়ই বাংলাদেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় থাকবে সেটা চাইবে। এতে দোষের কিছু নেই। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের যে আমানত ভোটের অধিকার, সেটাও নিরাপদ রাখতে হবে। সরকারের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের নেতারা প্রায়ই বলেন, নির্বাচন নিয়ে তাঁরা বাইরের হস্তক্ষেপ মেনে নেবেন না। কিন্তু তাঁরা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন সুষ্ঠু নির্বাচন, মানবাধিকার, শান্তিপূর্ণ সভা–সমাবেশ, স্বাধীনতা ও সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষার কথা বলা নিশ্চয়ই অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ নয়।
তবে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের একটি কথার সঙ্গে আমরা একমত হতে পারলাম না। তিনি দিল্লিতে কার কার সঙ্গে বৈঠক করেছেন, সেটি প্রকাশ করেননি। বলেছেন, ভারতে বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর খোলামেলা আলোচনা হয়েছে। কিন্তু কার কার সঙ্গে সে আলাপ-আলোচনা হয়েছে এবং কী বিষয়ে হয়েছে, সে সম্পর্কে তিনি বিস্তারিত কিছু বলতে পারবেন না। জি এম কাদের বলেন, ‘কেননা, ওই আলাপগুলো ওভাবেই করা হয়েছে। ওনারা যদি প্রকাশ করতে চান, করবেন। আমার পক্ষ থেকে ওনাদের পারমিশন (অনুমতি) ছাড়া কোনো কথা বলতে পারব না। এ ছাড়া আমি নিজের নৈতিক অবস্থান থেকেও কোনো বৈঠকের বিষয়ে বিস্তারিত কিছু বাইরে বলি না।’
আমরা যতটা জানি, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের এটা গোপন সফর ছিল না। তিনি সেখানে গেছেন ভারত সরকারের আমন্ত্রণে। তাহলে কাদের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে, সেটা কেন বলতে পারবেন না? বর্তমানে নির্বাচন নিয়ে যে সংকট দেখা দিয়েছে, সেটি তো আসলে নির্বাচনের সংকট নয়, গণতন্ত্রের সংকট। গণতন্ত্র মানে একসঙ্গে চলা, সব পক্ষের মধ্যে ন্যূনতম বোঝাপড়া থাকা। মনে রাখা প্রয়োজন, দেশটা সবার। সবাই মিলেই বাংলাদেশের উন্নয়ন করতে হবে। এর মধ্যে যদি কোনো দল মনে করে, তারাই একমাত্র দেশপ্রেমিক, তারা ক্ষমতায় থাকলেই দেশের উন্নতি হবে, অন্যরা ক্ষমতায় এলে দেশ ধ্বংস হয়ে যাবে, তাহলে তো ভোটের প্রয়োজন হয় না।
কেবল বিদেশিরা চায় বলেই সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে, বিষয়টা এমন নয়। ভোট দেওয়া মানুষের মৌলিক অধিকার। এ থেকে কেউ বঞ্চিত করলে সেটা যেমন সংবিধানবিরোধী, তেমনি মৌলিক অধিকারেরও পরিপন্থী। সুষ্ঠু নির্বাচনের কথা কেবল বিদেশিরা নয়, দেশের ভেতরেও নানা শ্রেণি ও পেশার মানুষ বলছেন। কিন্তু স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও সেই সুষ্ঠু নির্বাচনটি কীভাবে হবে, সে বিষয়ে রাজনৈতিক নেতৃত্ব একমত হতে পারেনি।
আওয়ামী লীগের নেতারা তো হামেশা সুষ্ঠু ভোটের কথা বলে আসছেন। আওয়ামী লীগের যেসব সহযোগী দল আছে, তারাও সুষ্ঠু ভোটের কথা বলছে। বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলো সুষ্ঠু ভোটের দাবিতে এক দফার আন্দোলন করছে। সুষ্ঠু ভোটের জন্য যুক্তরাষ্ট্র নতুন ভিসা নীতি চালু করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন বলেছে, সুষ্ঠু ভোট হলে জিএসপি-প্লাস সুবিধা পাবে বাংলাদেশ। ভোট সুষ্ঠু না হলে কি পাবে না, সেটা তারা খোলাসা করেনি।
ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও মন্ত্রীরা প্রায়ই বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আছে বলেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশ এগিয়ে চলেছে, মৌলবাদী চিন্তাধারা সমাজ থেকে উৎপাটিত হয়েছে। কিন্তু বাস্তব অবস্থা কী? যুদ্ধাপরাধের দায়ে আজীবন কারাদণ্ড ভোগ করা জামায়াত নেতা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মৃত্যুর পর ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা কীভাবে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন, সেটাও নিশ্চয়ই আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব প্রত্যক্ষ করেছে। যাঁরা প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধ সংগঠন ব্যবস্থা নিয়েছে। ইতিমধ্যে ছাত্রলীগের কয়েক শ কর্মীকে বহিষ্কার করা হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে দেখলাম, একজন সংসদ সদস্যও জামায়াত নেতা সাঈদীর পাণ্ডিত্যের প্রশংসা করেছেন।
পশ্চাৎপদ চিন্তাকে পরাস্ত করতে হয় উন্নত চিন্তা দিয়ে। গায়ের জোরে ভিন্নমত দমন করলে ফল উল্টোই হয়।
● সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি