ধরা যাক, উদ্যোগ নেওয়া হলো দেশের ৬৪ জেলাকে ফাইভ-জি নেটওয়ার্কের আওতায় নিয়ে আসা হবে এবং ৬৪ জেলায় ৬৪০ জন সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে দক্ষ জনবল তৈরি করা হবে। দেখা যাবে ব্যয় বেশি হলেও যত সহজে এ দেশে ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক স্থাপন করে ফেলা যাবে, তত সহজে ১০০ জন সাইবার নিরাপত্তা পেশাজীবী তৈরি করা যাবে না।
কারণ, ফাইভ-জির ক্ষেত্রে নেটওয়ার্ক সরঞ্জাম সরবরাহকারী ভেন্ডরদের তাড়না থাকবে, বিদেশি কোম্পানির লবিস্টদের দৌড়ঝাঁপ থাকবে। নিজস্ব প্রযুক্তি তৈরি নয়, আমরা এখনো প্রযুক্তি ব্যবহারকারী হওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছি; কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ ব্যয় করে আমরা প্রযুক্তি ব্যবহারে মানুষকে উৎসাহিত করে চলছি কার্যত বিদেশি কোম্পানির ব্যবসাক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য।
যত সহজে আমরা বলতে পারি সারা দেশে কয়েক হাজার ল্যাব তৈরি হয়ে গেছে, তত সহজে আমরা বলতে পারি না সারা দেশে কয়েক হাজার প্রোগ্রামার বা গ্রাফিক ডিজাইনার তৈরি হয়ে গেছে। ল্যাব প্রস্তুতে শত শত কোটি টাকার হার্ডওয়্যার-বাণিজ্য আছে, দক্ষ জনবল প্রস্তুতে বাণিজ্য কম, পরিশ্রম বেশি। ল্যাব বা অবকাঠামো তৈরির প্রয়োজন আছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন আছে দক্ষ জনবল তৈরির।
বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলো এখানে শুধু বেশি দামে পণ্য বিক্রিই করে না, বিক্রয়–পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণ বা ত্রুটি সারাইয়ের জন্যও বড় অঙ্কের অর্থ নিয়ে যায়। অন্তত রক্ষণাবেক্ষণ বা ত্রুটি সারানোর অংশটুকু যেন আমাদের লোকবল দিয়ে করানো যায়, সে প্রশিক্ষণটুকু দেওয়া উচিত।
সাম্প্রতিক দুটি উদাহরণ দেওয়া যাক। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সংযুক্ত আরব আমিরাতের একটি প্রতিষ্ঠান থেকে ২১৮ কোটি টাকার কাস্টমস আধুনিকায়ন সফটওয়্যার কিনতে যাচ্ছে (প্রথম আলো, ৫ জুলাই ২০২৩)। অন্যদিকে, বিটিআরসি টিএমএস বাস্তবায়নের জন্য কানাডাভিত্তিক একটি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ৭৭ কোটি টাকার পণ্য ও সেবা নিতে যাচ্ছ (টেকশহর, ২১ মার্চ ২০২৩)। এ রকম ব্যাংকিং খাতসহ আরও বিভিন্ন খাতে বিদেশ থেকে আমদানি করা শত শত কোটি টাকার ডিজিটাল পণ্য ব্যবহার করে চলেছি আমরা।
এটি ঠিক যে দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্ট কাজের সক্ষমতা না থাকলে বাধ্য হয়েই বাইরের প্রতিষ্ঠানের ওপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু এ নির্ভরতা আর কত দিন? দারিদ্র্যের দুষ্টচক্রের সঙ্গে আমরা পরিচিত। স্বল্প উৎপাদনের ফলে স্বল্প আয়, স্বল্প আয়ের কারণে স্বল্প বিনিয়োগ ও স্বল্প পুঁজি, তার ফলে চক্রাকারে আবারও স্বল্প উৎপাদন। এই একই ধরনের চক্রের আবির্ভাব হতে চলেছে আমাদের ডিজিটালাইজেশন-সংশ্লিষ্ট খাতেও। অভিযোগ আছে, দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা থাকার পরও আমাদের দপ্তরগুলোর প্রবণতা থাকে বিদেশি সফটওয়্যার বা সার্ভিস ক্রয়ের প্রতি। বিদেশি প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করলে গ্রাহক যে দাম দিতে চান, সে একই পণ্য দেশীয় প্রতিষ্ঠান সরবরাহ করতে গেলে এক-চতুর্থাংশ দাম দিতেও রাজি হন না।
তবে দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়ও কম নয়। তাদের পণ্যের মান নিয়ে গ্রাহকদের তরফে প্রশ্ন ওঠে। বিক্রয়–পরবর্তী সহায়তা বা রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রেও তাদের অনীহার কথা শোনা যায়। অন্যদিকে, দরপত্র ধরার জন্য প্রয়োজনের চেয়ে কম বাজেটে ও কম সময়ে পণ্য সরবরাহে চুক্তিবদ্ধ হয় কিছু প্রতিষ্ঠান। এতে মানহীন হয়ে পড়ে সফটওয়্যার বা তাদের সেবা।
এর প্রতিক্রিয়ায় দেশি ফার্ম থেকে আগের দামেও আর পণ্য কিনতে চান না গ্রাহক, দাম আরও কমানোর চেষ্টা করেন। কম খরচে যে উৎপাদন, তা কম মানসম্মত পণ্য সৃষ্টি করে। এসব পণ্য গ্রাহকপর্যায়ে অসন্তোষ ও অনাস্থা তৈরি করে এবং আরও কম বাজেটে ও কম সময়ে ডিজিটাল পণ্য তৈরির যে সংস্কৃতি গড়ে ওঠে, তা হয়ে ওঠে এক দুষ্টচক্র।
অথচ আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠানগুলোই আবার আন্তর্জাতিক বাজারের জন্য প্রস্তুত করে যাচ্ছে মানসম্পন্ন ও গ্রাহকসমাদৃত পণ্য। এ অবস্থায় কী সরকারি, কী বেসরকারি, সব পর্যায়েই আন্তরিকভাবে ও গুরুত্ব দিয়ে কিছু দিকে নজর দেওয়া দরকার।
প্রথমত, সংখ্যার ধারণা থেকে বের হয়ে মানের দিকে নজর দেওয়া। কয়েক হাজার ল্যাব তৈরি করা হলো, এই সংখ্যার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো সেখান থেকে কী মানের দক্ষতা অর্জন করা যায় সেটি। দ্বিতীয়ত, নির্দিষ্ট খাতে মনোযোগ বা ফোকাস রেখে কাজ করা। বিষয়ভিত্তিক জ্ঞান বা ডোমেইন নলেজ খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠানের আকার অনুযায়ী অল্প কয়েকটি ডোমেইনে ফোকাস রেখে কাজ করে গেলে সে খাতের জন্য মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন সম্ভব। তৃতীয়ত, কার্যকর নীতি সহায়তা।
ধরা যাক, দেশীয় প্রতিষ্ঠানের অভিজ্ঞতা না থাকায় কোনো একটি দপ্তরের কাজ বাইরের প্রতিষ্ঠান সম্পন্ন করল। পরবর্তী সময়ে ওই দপ্তর যদি শর্তজুড়ে দেয়, আগে তাদের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্নরাই নতুন কাজের জন্য বিবেচিত হবে, তাহলে কখনোই কি আমাদের দেশি প্রতিষ্ঠান সেই দপ্তরের কাজ আর পাবে?
অনেক ক্ষেত্রে বিদেশি প্রতিষ্ঠানকে দেশীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করার বাধ্যবাধকতা দেওয়া হয়। এর ফলে বিদেশি প্রতিষ্ঠান এ দেশে নিবন্ধিত একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। এ ক্ষেত্রে কি শুধু নামমাত্র শর্ত পূরণ করা হয় নাকি দেশীয় প্রতিষ্ঠানটি কার্যকরভাবে যুক্ত থাকে সেই নজরদারি জরুরি।
বাইরের প্রতিষ্ঠানগুলো এখানে শুধু বেশি দামে পণ্য বিক্রিই করে না, বিক্রয়–পরবর্তী রক্ষণাবেক্ষণ বা ত্রুটি সারাইয়ের জন্যও বড় অঙ্কের অর্থ নিয়ে যায়। অন্তত রক্ষণাবেক্ষণ বা ত্রুটি সারানোর অংশটুকু যেন আমাদের লোকবল দিয়ে করানো যায়, সে প্রশিক্ষণটুকু দেওয়া উচিত।
ড. বি এম মইনুল হোসেন অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়