আওয়ামী লীগ আমলের মেগা প্রকল্পগুলোর মধ্যে মেট্রোরেল ও পদ্মা সেতুর বিরুদ্ধে থাকা মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। পদ্মা সেতু নিয়ে দেশের প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী দল বিএনপি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কটু কথা বললেও তাতে যে ভীষণ প্রতিক্রিয়া হয়েছে, এমনটা বলা যাবে না। আর মেট্রোরেল নিয়ে তেমন সমালোচনা শোনাই যায়নি।
মেগাসিটি ঢাকার উত্তর দিকে অবস্থিত উত্তরা থেকে ৩০ মিনিটে দক্ষিণে বাণিজ্যিক কেন্দ্র মতিঝিল যাওয়া মাস কয়েক আগেও ছিল স্বপ্নাতীত। আর এখন প্রতিদিন হাজারো যাত্রী নির্ধারিত স্থান থেকে নির্ধারিত দামে টিকিট কিনে লাইনে দাঁড়িয়ে স্বয়ংক্রিয় গেট দিয়ে প্ল্যাটফর্মে প্রবেশ করছেন।
হোমরাচোমরা আর আমাদের মতো আমজনতা সবার জন্যই একই ব্যবস্থা। স্টেশনে খুব সুন্দর করে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় যাত্রীদের জন্য নির্দেশনা লেখা। সামান্যতম লেখাপড়া অথবা সাধারণ জ্ঞান বুদ্ধি থাকলে একজন যাত্রী মেট্রোরেল স্টেশন অথবা ট্রেনে কোনো প্রকার সমস্যায় পড়বেন বলে মনে হয় না।
প্ল্যাটফর্মে ডিজিটাল স্ক্রিনে ট্রেনের গন্তব্য লেখা থাকে। কতক্ষণের মধ্যে ট্রেনটি প্ল্যাটফর্মে আসবে, সেটিও দেখানো হয়। কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া, দুই মিনিট বললে দুই মিনিটের মধ্যেই ট্রেন হাজির। এক মিনিটের মধ্যেই ছেড়ে যায়। কথা আর কাজের কী দারুণ মিল! যা বাংলাদেশে বিরল।
তবে এই নিবন্ধ লেখার উদ্দেশ্য মেট্রোরেলের যাত্রা ব্যাখ্যা করা নয়। বরং সবার অগোচরে মেট্রোরেল যে একটি বিরাট উদাহরণ স্থাপন করেছে, তা ব্যাখ্যা করা। যা আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখাতে পারে।
আমি বলব, এই মেট্রোরেল বাঙালি জাতির ব্যাপারে সমাজে বিদ্যমান সব নেতিবাচক ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণ করেছে। কীভাবে, সেটি বলাই উদ্দেশ্য।
তবে সেটি বলার আগে একটি বাস্তব অভিজ্ঞতা পাঠকদের সঙ্গে ভাগাভাগি করতে চাই। ২০০৭ সালের কথা। যত দূর মনে পড়ে, মাসটা ছিল মার্চ বা এপ্রিল। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স স্টাডিজের একটি অনুষ্ঠান কাভার করতে যাই বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রতিবেদক হিসেবে গুলশানের একটি হোটেলে। বিষয় বাংলাদেশে দুর্নীতি দূর করার উপায়।
একটি রাজনৈতিক সরকারকে হটানোর পর দুর্নীতি দূর করা ছিল সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ের একটি। দেখছিলাম সবার মধ্যে একটিই প্রবণতা, দুর্নীতির জন্য একমাত্র রাজনীতি ও রাজনীতিবিদেরাই দায়ী। সেদিনের ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বেশ কয়েকজন বিদেশি কূটনীতিক। সবাই চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করছেন দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতাদের। আবহটি এমন ছিল ‘যা কিছু হারায় গিন্নি বলেন, কেষ্টা বেটাই চোর’। এখন যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও সুশীল সমাজের তুলোধুনো করা হচ্ছে, অনেকটা সে রকম।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি ছিলেন তৎকালীন প্রধান উপদেষ্টার একজন সচিব। পরে তিনি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান হন। নাম অথবা পদটি সুস্পষ্ট করে উল্লেখ করতে চাই না। কারণ, তিনি আর বেঁচে নেই। ওই পদে আসীন হওয়ার আগে বিএনপি সরকারের সংস্থাপন সচিব ছিলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তাঁকে সচিব হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। ছিলেন সরকারের খুব বাধ্য। ক্ষমতার পট পরিবর্তন হওয়ার পর সেই বাধ্য কর্মকর্তাই বলা শুরু করলেন, কীভাবে বাংলাদেশে দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়েছে বিএনপি সরকার।
ওই অনুষ্ঠানে তাঁর বক্তব্যের একপর্যায়ে উনি ইংরেজি ভাষায় যা বলতে লাগলেন, সেটির বাংলা অনুবাদ এমন—‘তোমরা বিদেশিরা জানো না আমরা কতটা দুর্নীতিগ্রস্ত। আমাদের যত ভালো ব্যবস্থা (সিস্টেম) দাও না কেন, আমরা এটাকে নষ্ট করার উপায় খুব তাড়াতাড়ি বের করে ফেলব। আমরা যেকোনো ভালো ব্যবস্থা নষ্ট করতে একেবারে সিদ্ধহস্ত (উই আর দ্য মাস্টার অব ম্যানুপুলেটিং অ্যানি গুড সিস্টেম)।’
এই বক্তব্য শুনে সামনের চেয়ারে বসা বিদেশি কূটনীতিকেরা মুচকি হেসেছিলেন। বিষয়টি লক্ষ্য করে ওই কর্মকর্তা তাঁদের দিকে তাকিয়ে আরেকটু সিরিয়াস হয়ে ইংরেজিতে বললেন, ‘সত্যি বলছি, তোমরা জানো না। আমি জানি।’
আমরা কয়েকজন তাঁকে প্রশ্ন করলাম, কেন তিনি বিএনপি সরকারের আমলে পাস হওয়া দুর্নীতি দমন কমিশনের ব্যবস্থাপনায় মন্ত্রীদের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে মন্ত্রীরা থাকলেও দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে? তখন তিনি উল্টো বলেছিলেন, দুর্নীতি দমন কমিশনকে অনেক ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।
উত্তরে উনি যা বললেন, সেটি আবার বাংলায়। সম্ভবত বিদেশিরা যাতে না বোঝেন সে জন্য। বললেন, সে সময় সরকার চেয়েছে, তাই তিনি করেছেন।
বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের কাছ থেকে নেতিবাচক কথা শুনতে শুনতে আমি নিজেও বাংলাদেশের মানুষ সম্পর্কে কখনো কখনো হতাশ হয়ে যেতাম। মনে করতাম, বাংলাদেশের মানুষ কি মেট্রোরেলের মতো সুন্দর ব্যবস্থা রক্ষা করতে পারবে! নাকি বাংলাদেশ রেলওয়ের ট্রেনের মতো সিট ছিঁড়বে, বিভিন্ন ময়লা টেবিলের নিচে মুছবে, কলম দিয়ে বিভিন্ন অশ্লীল কথা লিখবে, পানের পিক ফেলবে!
২০২২ সালের ডিসেম্বরে উত্তরা উত্তর থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত মেট্রোরেল আংশিক চালু হওয়ার পর থেকে আমি মেট্রোরেলের নিয়মিত যাত্রী। তবে প্রথম দিন যেদিন উঠলাম, দেখলাম সবার মধ্যে উচ্ছ্বাস যেন ঈদের চাঁদ হাতে পেয়েছে। পুরো স্টেশন ঝকঝকে। কম্পার্টমেন্টগুলো তকতকে। কোথাও বিন্দু পরিমাণ ময়লা নেই। নেই চিপসের ঠোঙা, খালি পানির বোতল।
মনে হয় আমি ছাড়া কেউ সেলফি অথবা ছবি তুলতে বাদ ছিলেন না। অনেকেই ভিডিও কল করে স্বজনদের দেখাচ্ছিলেন যে মেট্রোরেল কীভাবে চলে।
অনেকেই বলছিলেন, ‘প্রথম তো। দেখেন কিছুদিন, কী অবস্থা দাঁড়ায়।’
তবে মেট্রোরেল সেই ধারণা ভুল প্রমাণ করেছে। প্রতিদিন স্টেশনে উপস্থিত হয়ে দেখতাম কোথাও কোনো ময়লা-আবর্জনার দুর্গন্ধ আছে কি না। কম্পার্টমেন্টে কোনো ময়লা রয়েছে কি না। আবার অমুক যোগ তমুক লেখা আছে কি না। কিন্তু না।
আমি মেট্রোরেলের নিয়মিত যাত্রী হয়ে দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, পুরো ট্রেনের ছয়টি কম্পার্টমেন্ট তন্ন তন্ন করে খুঁজেও একটি পেনসিলের দাগ পর্যন্ত পাবেন না। ট্রেনে প্রবেশ করলে কোনো দুর্গন্ধ পাবেন না। পিক আওয়ারে গায়ে গায়ে নারী-পুরুষ দাঁড়ালেও পাবেন না কোনো ইতরামির অভিযোগ। কোনো বিদেশিকে সরাসরি মেট্রোরেলের উঠিয়ে দিলে তাঁরা সেটিকে কমপক্ষে সিঙ্গাপুরের মেট্রো বলতে দ্বিধা করবেন না।
মেট্রোরেলের সঙ্গে বাংলাদেশের গণপরিবহন ব্যবস্থার তুলনা করতে গিয়ে মিরপুর-১২ থেকে সদরঘাট রুটে চলাচলকারী বিহঙ্গ পরিবহনের এক কন্ডাক্টর একদিন আমাকে যা বললেন, ‘শোনেন ভাই, মেট্রোরেলে কোনো চুদুরবুদুর (এটি কোনো অশ্লীল শব্দ নয় বলে স্পিকার সংসদে বলেছেন) নাই। তুমি মন্ত্রী হও, আর যা-ই হও না কেন, টিকিট কাটতে হবে। এক পয়সাও কম নাই। তারপর স্টেশনে ঢুকতে পারবে। না হলে যাও। এখানে কোনো ভিআইপি নাই। আর রাস্তায়-বাসে-ট্রেনে মন্ত্রী ও ভিআইপির শেষ নাই। তারপর আছে ছাত্র, আতি নেতা, পাতি নেতা, আরও কত কী।’
যখন কোনো সিস্টেম সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ করা হয়, তখন মানুষ সেটি মেনে নেয়। রক্ষা করে। মেট্রোরেলের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। মানুষ এই ট্রেনকে ভালোবাসে, নিজেদের মনে করেন। এর বাইরে গোটা দেশ আর রাষ্ট্রীয় সেবার একক ভোক্তা হলেন ভিআইপি, ভিভিআইপিরা। তাঁরা ঠিকই সিস্টেমের বাইরে গিয়ে নিজেদের সুবিধা আদায় করে যাচ্ছেন।
ক্ষমতাবান মানুষদের বিশেষ ব্যবস্থায় লালবাতি জ্বলা অবস্থায় খাতির করে পুলিশ পার করে দেয়। উল্টো দিকে চললেও ক্ষতি নেই। মেট্রোরেল ছাড়া বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত একটি ব্যবস্থাও দেখানো কঠিন হবে, যেখানে ভিআইপি অথবা ভিভিআইপিদের জন্য ব্যতিক্রম হয়নি।
আমাদের নীতিনির্ধারকদের উচিত বিষয়টি অনুধাবন করা। বাংলাদেশিরা উন্নত গণতন্ত্রের যোগ্য নন, তাঁরা গণতন্ত্র রক্ষার জন্য উপযুক্ত নন—এই ধারণা সঠিক নয়। যদি নিয়ম মেনে সবার জন্য সমানভাবে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে তাঁরাও বিশ্বের উন্নত দেশের নাগরিকদের মতো যেকোনো ভালো ব্যবস্থা মানেন, রক্ষা করেন। ওই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব বেঁচে থাকলে বিষয়টি প্রত্যক্ষ করে যেতে পারতেন।
কামরান রেজা চৌধুরী সাংবাদিক ও লেখক।