বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য বলছে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৪২ হাজার মানুষ যক্ষ্মায় মারা যান। সেই হিসাবে দেশে প্রতি ১২ মিনিটে একজন ব্যক্তি যক্ষ্মায় মারা যাচ্ছেন।
বাংলাদেশে যক্ষ্মা নিয়ে নানা চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে। সরকারের জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির সঙ্গে যক্ষ্মা নিয়ে কাজ করছে আইসিডিডিআরবি পরিচালিত ইউএসআইএস অ্যালায়েন্স ফর কমব্যাটিং টিবি ইন বাংলাদেশ কর্মসূচি।
অপুষ্টির কারণে, ঘনবসতিপূর্ণ পরিবেশে বসবাস করলে যক্ষ্মায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। একনাগাড়ে দুই সপ্তাহের বেশি কাশি হওয়া, ক্ষুধামান্দ্য, রাতে ঘাম ও জ্বর হওয়া, ওজন হারানো এবং কফের সঙ্গে রক্তের উপস্থিতি যক্ষ্মা রোগের সাধারণ লক্ষণ। তবে শিশুদের যক্ষ্মার লক্ষণ অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ যক্ষ্মার মতো হয় না। বিপদটা এখানেই, লক্ষণ প্রকাশ না পেলে মা–বাবারা কেউ চিকিৎসকের কাছে যান না। আবার অনেকে যক্ষ্মা রোগের লক্ষণ সম্পর্কেও খুব একটা ওয়াকিবহাল নন।
অনেকেই মনে করেন যক্ষ্মা ফুসফুসের অসুখ, যা আসলে ভুল ধারণা। ফুসফুস ছাড়াও যক্ষ্মা ফুসফুসবহির্ভূত অন্যান্য বিভিন্ন অঙ্গে হতে পারে। হাঁচি বা কাশি দেওয়ার মাধ্যমে যক্ষ্মার জীবাণু বাতাসে ছড়িয়ে যায়। আরেকজন যখন শ্বাসপ্রশ্বাস নেয়, তখন জীবাণুটা আমাদের শরীরের ভেতরে ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। এভাবে ফুসফুসের যক্ষ্মা হয়। অন্যদিকে ফুসফুসবহির্ভূত যক্ষ্মা আমাদের শরীরের পাঁচকতন্ত্র বা পাকস্থলী থেকে শুরু করে যেকোনো জায়গায় হতে পারে।
স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় যক্ষ্মার প্রাদুর্ভাব অনেক বেশি। প্রতিবছর সারা পৃথিবীতে এক কোটির বেশি মানুষ যক্ষ্মায় আক্রান্ত হচ্ছেন। যার মধ্যে মারা যান ১১ লাখের বেশি মানুষ। যাদের একটু সচ্ছলতা কম, শুধু তাদের যক্ষ্মা হয় বলে ভুল ধারণা আছে। গরিবের রোগ বলে অবহেলা করেন অনেকেই। আসলে ধনী-গরিব যে কারও এই যক্ষ্মা হতে পারে। অনেক রোগীকে শনাক্ত করা যাচ্ছে না বলে চিকিৎসা দেওয়া যাচ্ছে না।
সাধারণ অভিভাবকদের অসচেতনতা বা অজ্ঞতার কারণে বাংলাদেশে শিশুদের যক্ষ্মাকে অবহেলা করতে দেখা যায়। শুধু বাংলাদেশেই নয়, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের যক্ষ্মা শনাক্ত করা একটি বৈশ্বিক সমস্যা। শিশুদের কফ সংগ্রহ করা কঠিন কাজ। তা ছাড়া অনেক অভিভাবক ও মা–বাবা শিশুদের কফ নেওয়ার বিষয়ে সহযোগিতা করতে চান না। সরকারি উদ্যোগে শিশুদের যক্ষ্মার পরীক্ষা বাড়ানো এবং চিকিৎসার ব্যাপারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। শিশুদের যক্ষ্মার ব্যাপারে দেশের শিশু চিকিৎসকদের আরও সহযোগিতা দরকার।
বাংলাদেশে যক্ষ্মায় আক্রান্তদের প্রায় ১০ শতাংশ শিশু যক্ষ্মা রোগী হওয়ার কথা। তবে বাংলাদেশে ৪ শতাংশের বেশি শিশুর যক্ষ্মা শনাক্ত করা যাচ্ছে না। অর্থাৎ শনাক্তের বাইরে থেকে যাচ্ছে বেশির ভাগ শিশু। শনাক্ত করতে না পারায় চিকিৎসার আওতায় আনা যাচ্ছে না কোমলমতি শিশুদের।
এখনো নানা সামাজিক ও প্রচলিত কুসংস্কারসহ ভুল ধারণা, শিশুদের যক্ষ্মা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব, রোগনির্ণয়ে সীমাবদ্ধতা, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবাদানকারী ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা যক্ষ্মা শনাক্তকরণের বাধাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এসব বাধা জয় করে আমাদের যক্ষ্মামুক্ত বাংলাদেশ তৈরির জন্য সবাইকে এক হয়ে চলতে হবে।
এমনিতে যক্ষ্মা রোগীদের জন্য সরকার বিনা মূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। অনেক যক্ষ্মা রোগী প্রাইভেট সেক্টর বা বেসরকারি হাসপাতাল থেকে সেবা নিচ্ছেন। সম্ভাব্য যক্ষ্মা রোগীরা বেশির ভাগই প্রথমে চিকিৎসার জন্য প্রাইভেট চিকিৎসকদের কাছে যান। রোগ শনাক্ত হওয়ার পর কেউ কেউ নিজের মতো করে ওষুধ কিনে খান। তাঁরা জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির মনিটরিংয়ের বাইরে থেকে যাচ্ছেন। এতে ঝুঁকি কিন্তু আরও বাড়ছে। যক্ষ্মা রোগীদের নির্দিষ্ট সময় ধরে নিয়মিত ওষুধ সেবন করতে হয়।
জাতীয় যক্ষ্মা নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির আওতায় থাকা রোগীরা স্বাস্থ্যকর্মীদের সহায়তায় নিয়মিত ওষুধ সেবন করেন, এতে নজরদারির ব্যবস্থা আছে। যক্ষ্মার চিকিৎসা সরকারিভাবে পুরোপুরি বিনা মূল্যে দেওয়া হচ্ছে। আমি মনে করি, আক্রান্ত রোগী ও তাঁদের পরিবারের এ ক্ষেত্রে ব্যাপক আকারে সচেতনতা প্রয়োজন।
শহর কিংবা গ্রাম, সবখানেই যক্ষ্মা নিয়ে এখনো অনেক রকমের কুসংস্কার ও সামাজিক ভ্রান্তি প্রচলিত আছে। এসব কুসংস্কারের কারণে অনেকে যক্ষ্মার চিকিৎসা নিতে আগ্রহী হন না। আবার যক্ষ্মা হলে কখনো কখনো রোগী ও তার পরিবারকে কুসংস্কারের কারণে একঘরে করে ফেলি আমরা। সামাজিক সচেতনতার অংশ হিসেবে আমাদের যক্ষ্মা নিয়ে আরও বেশি প্রচার-প্রচারণা বাড়ানোর কাজ করা প্রয়োজন।
এখনো নানা সামাজিক ও প্রচলিত কুসংস্কারসহ ভুল ধারণা, শিশুদের যক্ষ্মা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব, রোগনির্ণয়ে সীমাবদ্ধতা, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবাদানকারী ও অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা যক্ষ্মা শনাক্তকরণের বাধাগুলোর মধ্যে অন্যতম। এসব বাধা জয় করে আমাদের যক্ষ্মামুক্ত বাংলাদেশ তৈরির জন্য সবাইকে এক হয়ে চলতে হবে।
একসঙ্গে কাজ করার মাধ্যমে আমরা পারি যক্ষ্মা ও যক্ষ্মাসংশ্লিষ্ট আর্থসামাজিক সংকট মোকাবিলা করতে। সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে যক্ষ্মার হাত থেকে আগামী প্রজন্মকে রক্ষার জন্য কাজ করতে পারি।
● ড. সায়েরা বানু সিনিয়র সায়েন্টিস্ট ও হেড, প্রোগ্রাম অন ইমার্জিং ইনফেকশনস, আইডিডি, আইসিডিডিআরবি ও ফেলো, বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি